দীঘিনালার সীমানা পাড়া পেরিয়ে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা ’তুয়ারি মাইরাং ঝরনা”

চাইথোয়াই মারমা,খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার সীমানা পাড়া পেরিয়ে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা প্রাকৃতিক গতভাবে স্থানীয় ত্রিপুরা ভাষায় ’তুয়ারি মাইরাং ঝরনা”। আলুটিলা রিছাং ঝরনার পর তৈদুছড়া ঝরনা পরে তুয়ারি মাইরাং ঝরনার সন্ধান পায়।

পাহাড়ের পর পাহাড়ে সাজানো সবুজ অরণ্য দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে এ জনপদকে করেছে আলাদা। ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের ফলে স্বতন্ত্র এলাকা হিসেবে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। দেশের এ পাহাড়ি অঞ্চল পর্যটকদের কাছে বরাবরই দারুণ আকর্ষণীয়। এ জনপদ পর্যটকদের কাছে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি স্থানীয়দের কাছে ‘ভূস্বর্গ’। জেলাতে দিন দিন যখন বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যা, তখন তৈদুছড়া ঝরনা ও বাদুড় গুহার পরে দীঘিনালার সীমানা পাড়ায় সন্ধান মিলেছে প্রায় শত ফুট উঁচু ‘তুয়ারি মাইরাং ঝরনা’। যা ইতোমধ্যে পাহাড়ের পর্যটকদের কাছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।

অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে নতুন সন্ধান পাওয়া শত ফুট উঁচু এ ঝরনা দেখতে স্থানীয় পর্যটনপিপাসু ছাড়াও বাইরে থেকে অনেকেই আসছেন। এসব পর্যটকদের নিরাপত্তা ও গাইড সুবিধা দিচ্ছে স্থানীয়রা। নির্জন লোকালয় থেকে হেঁটে দীঘিনালার সীমানা পাড়ার নতুন ঝরনায় পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ১(এক) ঘণ্টা। প্রাকৃতিক লতা বেয়ে নামতে হয় পাহাড় থেকে। কয়েকটি পাথুরে জায়গা পারাপাওে একমাত্র ভরসা সেই লতা। তবে এসব জায়গায় মোটা দড়ি ব্যবহার করা ঝুঁকিমুক্ত। পাহাড় থেকে লতা বেয়ে নেমে হাঁটতে হয় পাহাড়ি ঝিরিতে। পাহাড়ি ঝিরিতে গা ছমছম অনুভূতি।

ঝিরিতে শত বছর ধরে আটকে আছে বড় বড় পাথরের খন্ড। পাথর ও ক্যাসকেড বেয়ে নামছে পানির স্রোতধারা। উঁচু পাহাড় আর গভীর অরণ্যের কারণে ঝিরি পর্যন্ত পৌঁছে না সূর্যের আলো। ঝিরিপথে হাঁটার পরপরই দেখা মিলবে সুবিশাল ঝরনার। এতো উঁচু ঝরনা দেখে চোখ আটকে যাবে যে কারো। ঝরনার উল্টো দিকে পাথুরে স্তুপ আর পাহাড়। এমন ঝরনা দেখে মুগ্ধ হবেন পর্যটকরা।

দীঘিনালার এ ঝরনা দেখতে আসা পর্যটক মারিয়া, মুশফিকা ও শান্তু’রা জানান, করোনার মধ্যে দীর্ঘদিন যান্ত্রিক জীবনে আটকে ছিলেন তারা। এ ঝরনায় এসে সেই যান্ত্রিক জীবনের মুক্তি মিলেছে তাদের। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের নতুন স্বাদ দেবে এ ঝরনা।

নেচার ট্র্যাভেলস বাংলাদেশের টিম লিডার ডা. মইনুল হাসান জানান, এটি অত্যন্ত প্রাকৃতিক গত সুন্দর ঝরনা। চারপাশটা বেশ রোমাঞ্চকর। পুরো পথজুড়ে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও ঝিরি এবং ক্যাসকেড বেয়ে নামতে হয়। এসময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। বন্ধুর পথ পেরিয়ে ঝরনা দেখে মুগ্ধ হবেন যে কেউ।

পর্যটকদের যাতায়াতে অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। আগত পর্যটকদের গাইড সুবিধাও দেবেন তারা।

স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য হতেন ত্রিপুরা জানান, এটি পাহাড়ের নতুন ঝরনা। স্থানীয়রা বেড়াতে আসলেও বাইরের পর্যটকদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। এখানে যাতায়াত অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারের পক্ষ থেকে রাস্তা উন্নয়নসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের অন্যতম স্পট হিসেবে জায়গা করে নিতে পারবে। তৈরি হবে মানুষের নতুন কর্মসংস্থান।

ঝরনায় যাতায়াতে অবকাঠামো উন্নয়নের কথা জানিয়েছেন দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার(ইউএনও) মোহাম্মদ উল্ল্যাহ। তিনি জানান, দীঘিনালায় তৈদুছড়া ঝরনা ও বাদুড় গুহাসহ বেশ কিছু পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। তবে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পর্যটকদের যাতায়াতে অসুবিধা হয়। তুয়ারি মাইরাং ঝরনা পর্যটকদের কাছে নতুন আর্কষণ হতে পারে। ট্রেকিং প্রিয় পর্যটকরা এটি ঘুরে আসতে পারেন।

সামনে চোখ জুড়ানো দিগন্ত জোড়া সবুজ পাহাড় দৃশ্য। পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসা ঝরনাধারা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঝরনাটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললে পাহাড়ের সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে-এমনটিই মনে করছেন স্থানীয়রা। সবুজের বুকে আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু পথ শেষে অবস্থিত এ তুয়ারি মাইরাং ঝরনা। সবুজে ঘেরা বাঁশের ঝোঁপ, নাম না জানা নানা ধরনের পার্থিব ডাক আর পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনার কলকল শব্দ মিলিয়ে হারিয়ে যাওয়ার এক অনন্য স্থান।

তুয়ারি মাইরাং ঝরনাকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার দাবি উঠেছে স্থানীয়দের মধ্যে। তাদের মতে, তুয়ারি মাইরাং ঝরনাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হলে ভিড় করবে দেশ-বিদেশের হাজারও ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা। বদলে যাবে দীঘিনালা উপজেলার সীমানা পাড়ায় আর্থ-সামাজিক অবস্থা।

স্থানীয় সমাজকর্মী কমল বিকাশ চাকমার মতে, তুয়ারি মাইরাং ঝরনা ছাড়াও এখানে রয়েছে একাধিক ছোট ছোট ঝরনাধারা। যা ইতোমধ্যে স্থানীয়দের ভ্রমণের উৎস হয়ে উঠেছে। তুয়ারি মাইরাং ঝরনাকে ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে বেড়াতে আসা অনেকেই উপভোগ করছেন এর সৌন্দর্য।

দীঘিনালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা অওয়ামীলীগের সভাপতি মো: আবুল কাশেম বলেন, তুয়ারি মাইরাং ঝরনা দেখতে দলে দলে পর্যটকরা ঐ জায়গায় ছুটছেন। এখানেও দলবেঁধে মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসবেন। এখানকার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ন্যুনতম নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থিত ‘তুয়ারি মাইরাং ঝরনা”এ জনপদে অর্থনীতির দুয়ার খুলে দিতে পারে।’

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার(ইউএনও) মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, ‘ছড়া-পাহাড়-নদী আমাদের সরকারি সম্পদ। তুয়ারি মাইরাং ঝরনা এক সম্ভাবনাময় জায়গা। পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘ তুয়ারি মাইরাং ঝরনা” পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় সম্ভাব্যতা যাচাই করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

পিবিএ/এমএসএম

আরও পড়ুন...