ফেসবুকে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা, গ্রেফতার ২

পিবিএ,ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জ্বিন দিয়ে সব সমস্যার সমাধানের বিজ্ঞাপন দিয়ে দরবেশ পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে দুই প্রতারককে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

গতকাল রাজধানীর উত্তরা ও ভোলায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলো- তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসান ও মো. হাসেম। রবিবার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান।

তিনি বলেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম (৫৯) তিন ছেলে-মেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। সবাই দেশের প্রবাসী। স্বামী নামকরা চিকিৎসক। চাকরি থেকে অবসরের পর আনোয়ারা দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিছুটা পারিবারিক সমস্যায় ও ভুগছিলেন। তিনি এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন।

এমন অবস্থায় হঠাৎ একদিন ফেসবুক স্ক্রল করার সময় তার সামনে একটি বিজ্ঞাপন আসে। বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, একজন সুন্দর সৌম্য চেহারার দরবেশ বেশধারী ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরান হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে না হওয়া, বাচ্চা না হওয়া, লটারি জেতানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। বিজ্ঞাপনে দুজন মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখায় যেখানে মেয়ে দুটিকে বলতে শোনা যায়, তারা এই দরবেশ বাবার কাছ থেকে তাদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।

এটা দেখে আনোয়ারা বেগম তার বাসার গৃহপরিচারির সঙ্গে আলোচনা করেন। সেই মেয়ে তখন তাকে জানায়, জ্বীন-পরীর মাধ্যমে দরবেশ বাবারা এসব সমস্যার সমাধান করে। তার গ্রামের কয়েকজনের এভাবে সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটা শুনে আনোয়ারা উৎসাহিত হোন এবং বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করেন। ফোন দেওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞাপন দেওয়া দরবেশ বাবা বেশধারী ব্যক্তি তার সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চায়। তিনি তখন তার পারিবারিক কিছু সমস্যার কথা উক্ত দরবেশ বাবার সাথে আলোচনা করেন।

দরবেশ বাবা তার সমস্যার কথা শুনে তাকে বলেন, ‘‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার উপর আস্থা রাখো। আমি তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে মা। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। যদি জানাও তবে তোমার সমস্যা সমাধান হবে না। বিপরীতে তোমার সমস্যা আরো বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’’ এরুপ সুন্দর ব্যবহার ও কথা বলে দরবেশ বাবা তার বিকাশ নম্বরে একটা বড় অ্যামাউন্টের টাকা বিকাশ করতে বলে। মিসেস আনোয়ারা বেগম দরবেশ বাবার সুন্দর ব্যবহার ও কথায় তার ভক্ত হয়ে যায়। তখন উক্ত নম্বরে দরবেশ বাবার কথা মতো বিকাশে টাকা পাঠান। এই ভাবে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে দরবেশ বাবা মিসেস আনোয়ারা বেগমকে ফোন করে বিভিন্ন অজুহাতে ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। একসময় আনোয়ারা বেগম যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন, তখন প্রতিকার পাওয়ার জন্য মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। সিআইডিতে আবেদন করেন।

তিনি আরও বলেন, ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম ভুক্তভোগীর অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে আসামীদের সনাক্ত করে। রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারকদের গ্রেফতার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে তানজিদ হাসান সিআইডিকে জানায়, এই চক্রের মূল হোতা হাসেম। হাসেম প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট ছোট অ্যামাউন্টের টাকা নিতো। এরপর বড় অ্যামাউন্টের টাকা নেওয়ার সময় তানজিল আহমেদ আনোয়ারার কাভজে পাঠাতো। তানজিদ হাসান ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেত প্রতিবার। এভাবে ধাপে ধাপে তারা আনোয়ার কাছ থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা নেয়।

প্রতারক হাসেম সিআইডিকে জানায়, সে ২০০৫ সাল থেকে এই কাজ করছে। প্রথম দিকে সে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতো। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি সে ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। প্রতিমাসে ফেসবুকে চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতো এবং পোস্ট বুস্ট করতো যাতে তার বিজ্ঞাপন সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। সে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্প শিক্ষিত প্রবাসী বাঙ্গালীদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দেশ ভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতো। এছাড়াও সে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করতো। এভাবে সে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সাথে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে কথা বলত ও তাদের থেকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতো। দরবেশ বাবারুপী প্রতারক হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন রকম কন্ঠে কথা বলতে পারে। যেমন জীনপরীর কন্ঠ, ২০০ বছরের হুজুরের কন্ঠ, ১০০ বছরের বাবার কন্ঠ।

এই প্রতারক ফ্রান্স প্রবাসী ইমাম হোসেন (৪০) থেকে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে তাকে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আরেক ইতালী প্রবাসীর থেকে একইভাবে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

সিআইডি টিম খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ফ্রান্স প্রবাসী ইমাম হোসেনের পরিবার দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করে। প্রবাসীর বউ বাচ্চা খেয়ে না খেয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিনযাপন করছে। অথচ প্রবাসে তার কষ্টে উপার্জন করা টাকায় ভন্ড দরবেশ বাবা বাড়ি-গাড়ী করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। প্রবাসীইমাম হোসেন এক পর্যায়ে তার বড় বোনকেও দরবেশ বাবার ভক্ত বানিয়ে ফেলে। বড় বোন তার ছেলের ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য জমানো টাকা পর্যন্ত ভাইয়ের কথায় দরবেশ বাবাকে দিয়ে দিয়েছে।

সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, মধ্য প্রাচ্যে এই প্রতারক চক্রের এরকম ২০/২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে, মালয়েশিয়াতে আছে ১০/১২ জন। এর মধ্যে ৫/৬ জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছে যারা গত ৪/৫ বছর ধরে নিয়মিত এই দরবেশ বাবারুপী প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছে।

আরও পড়ুন...