প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বাজারে গিয়ে যাচাই-বাছাই করে সূলভ মূল্যে নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয় করতো। যুগের পরিবর্তনের সাথে বাজার ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন হতে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বাজার ব্যবস্থায় যোগ হয় সুপারশপ, শপিং মল, সুপার মার্কেট, মেগা মল। পাশাপাশি, তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে নগদ অর্থ লেদেনের বিকল্প হিসেবে চালু হয় ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। বাজারে গিয়ে সরাসরি পণ্য ক্রয়ের পাশাপাশি মানুষজন বর্তমানে অনলাইনে পণ্য অর্ডার করে ঘরে বসেই পণ্য হাতে পেয়ে যাচ্ছে। সরাসরি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতারা বিভিন্ন পণ্য যাচাই-বাছাই করে কাঙ্খিত পণ্য ক্রয় করতে পারে। কিন্তু অনলাইনে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রেতার অনলাইনে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পণ্য অর্ডার করতে হয়। সরাসরি পণ্য যাচাই-বাছাই করার সুযোগ না থাকায় কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি কাঙ্খিত পণ্য সরবরাহ না করে অর্থ আত্মসাৎ বা নিম্নমানের পণ্য সরবরাহসহ বিভিন্ন ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। তাই অনলাইন কেনাকাটায় ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাকাটার প্রচলন ও জনপ্রিয়তার কারণ:
সত্তরের দশকের শেষ দিকে টেলিফোন সংযোগের মাধ্যমে অর্ডার গ্রহণের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে প্রথম ই-কমার্স এর ধারণা প্রবর্তিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে অনলাইনে কেনাকাটারও প্রচলন শুরু হলেও মূলত একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। অ্যামাজন, ই-বে, আলিবাবাসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় অনলাইন শপিং প্লাটফর্ম এবং বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়ে বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে অনলাইনে কেনাকাটার প্রবনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমান বিশ্বে খুচরা কেনাকাটার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ হয় অনলাইনের মাধ্যমে। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনলাইনে কেনাকাটার প্রচলন শুরু হলেও দেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নের ফলে এর ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় এবং করোনাকালে এটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনলাইনে ঘরে বসে কয়েক ক্লিকে সহজেই পণ্য ক্রয় করা যায়, বাইরে যাওয়া লাগে না; পণ্য বহন বা দরদামও করতে হয় না। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে বিক্রেতার দেয়া পণ্য সম্পর্কিত তথ্যাদি ও কাস্টমার রিভিউ দেখে পণ্যের গুনাগুন ও মূল্য নিয়ে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়। মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড বা ক্যাশ অন ডেলিভারির মাধ্যমে পণ্যের দাম পরিশোধ করা যায়; মার্কেটপ্লেসগুলোতে থাকে বিভিন্ন ধরণের অফার/ডিসকাউন্ট। কোনও দোকান বা শোরুমের প্রয়োজন না থাকায় দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে পণ্য ক্রয়/বিক্রয় করা যায়। অনলাইন শপ যেমনঃ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট বা ফেইসপুক পেইজ এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেস যেমনঃ দারাজ, চালডাল, রকমারি, ফুডপান্ডাসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতারা ভার্চুয়ালি পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করছে। গৃহস্থলীর যে কোন উপকরণ থেকে শুরু করে পোষাক, বই-পুস্তক, ইলেকট্রনিক্সপণ্য এমনকি গাছের চারা, গবাদি পশুও এখন অনলাইনে কেনা যাচ্ছে। এসব কারণে সকল শ্রেনি/পেশার মানুষের মধ্যেই অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে ই-ক্যাব নিবন্ধনকৃত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ২ হাজার; ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত ৫০ হাজারের অধিক পেইজ/প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সূত্রমতে, ২০২২ সালে দেশের ই-কমার্স বাজারের আকার ছিল প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকার যা ২০২৬ সাল নাগাদ দেড় লক্ষ কোটি টাকায় পৌছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অনলাইন কেনাকাটায় মানুষ কিভাবে প্রতারিত হচ্ছে?
দেশে অনলাইন কেনাকাটার বিস্তৃতির সাথে সাথে প্রতারণার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেস/শপে পোষাক, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন ভালো মানের পণ্যের ছবি ও বর্ণনা দিয়ে ছেড়া, নষ্ট, পঁচা বা নিম্নমানের পণ্য সরবারাহের কারণে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে। ভুয়া কাস্টমার রিভিউর কারনে গ্রাহকদের সহজেই প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত সময়ের চেয়ে গ্রাহকের নিকট বিলম্বে পণ্য সরবরাহ করা হয়। মাঝে মাঝে পেমেন্টের পর কা কাঙ্ক্ষিত পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে গ্রাহকের নাম্বার বা আইডি ব্লক করে দিয়ে অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগও পাওয়া যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কার্যালয়, শোরুম বা কাস্টমার সার্ভিস না থাকায় ক্রেতারা কেনাকাটার পরবর্তীতে বিক্রয়োত্তর সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানকে বিশাল ছাড়, ক্যাশব্যাক ও বিভিন্ন ধরণের অফার দিয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে প্রতারণা করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতার নিকট পণ্য সরবরাহ করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের পর বিপুল সংখ্যক ক্রেতার অর্থ হাতিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার নজিরও রয়েছে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা ও ইভ্যালিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন অপ্রতিষ্ঠিত সাইট/শপ কর্তৃক গ্রাহকের ব্যাংকিং তথ্যসহ ব্যক্তিগত তথ্য চুরি বা বিভিন্ন ফিশিং লিংক এর মাধ্যমে তাদের আইডি ও প্রয়োজনীয় তথ্যাদিও হ্যাক করা হচ্ছে।
প্রতারিত হলে প্রতিকার লাভের উপায়:
অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হওয়ার পর আইনগত প্রতিকার প্রাপ্তি সম্পর্কিত অজ্ঞতা বা বাড়তি সময় ব্যয় এড়াতে অনেকেই কোন অভিযোগ দায়ের করেন না। অভিযোগ না করার ফলে প্রতারকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে বারংবার প্রতারণা করে যাচ্ছে। যেকোন ধরণের প্রতারণার ব্যাপারে আইনগত সহায়তা প্রাপ্তি প্রত্যেক ব্যক্তির নাগরিক অধিকার। অনলাইনে যেকোন ধরণের কেনাকাটার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কেনাকাটার সময় বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার, ওয়েবসাইট/পেইজের টজখ সংরক্ষণ করতে হবে; শপ/পেইজের স্ক্রিনশট, অর্থ পরিশোধ ও অর্ডার কনফার্ম সংক্রান্ত স্ক্রিনশট, চ্যাটিং এর স্ক্রিনশট সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতারণা বুঝতে পারার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদিসহ দ্রুত নিকটস্থ থানায় জিডি/অভিযোগ করতে হবে। পাশাপাশি, জিডি/অভিযোগের কপি নিয়ে ভুক্তভোগী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহের সাইবার সেলেরও সহায়তা নিতে পারেন। অপরাধীকে শনাক্ত করা গেলে পরবর্তীতে ভুক্তভোগীরা প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করার মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবেন। এছাড়াও, ভুক্তভোগী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ বা আদালতে প্রতারণার মামলা দায়ের করতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি:
অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আইনে ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশনা, ক্ষতিপূরন প্রাপ্তি ও প্রতারণায় সংশ্লিষ্টদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। *ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১* এ অনলাইন কেনাকাটায় কোনটি ভোক্তার অধিকার আর কোনটি প্রতারণা সে বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে। এছাড়াও, গ্রাহককে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার সময়সীমা, অগ্রীম মূল্য পরিশোধ, মার্কেটপ্লেসে পণ্য/সেবা উপস্থাপন সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া আছে। *দন্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪২০ ধারায়* প্রতারণার ক্ষেত্রে থানায় এজাহার দায়ের করে মামলা করা অথবা আদালতে সরাসরি মামলা দায়েরের বিষয়ে বলা আছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে উক্ত আইনে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। প্রতারিত ব্যক্তি ‘দ্যা সেলস অফ গুডস অ্যাক্ট-১৯৩০’অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। *ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯* অনুযায়ী ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করলে বা প্রতারণার আশ্রয় নিলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।
অনলাইন কেনাকাটায় যে সকল সর্তকতা অবলম্বন প্রয়োজন:
অনলাইনে যেকোন ধরণের কেনাকাটার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করে পণ্য ক্রয় না করে যাচাই-বাছাই করে পণ্য ক্রয় করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত/জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস বা পেইজ থেকে পণ্য কেনার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী অফিস আছে কিনা, বিক্রেতার আইডি সঠিক কিনা, ওয়েবসাইটের অথেনটিসিটি নিশ্চিতকরণে এসএসএল (Secure Sockets Layer) সার্টিফাইড কিনা তা যাচাই করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, পরিচিতি, যোগাযোগের নাম্বার সংরক্ষণ এবং গ্রাহকদের রিভিউ দেখতে হবে; রিভিউসমূহ ভুয়া কিনা তাও যাচাই করতে হবে। অল্প দাম, বিশাল ছাড়, ক্যাশব্যাক বা অন্য কোন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ হওয়া যাবে না। পণ্যের বর্ণনা, ছবি, ভিডিও দেখার পাশাপাশি অন্যান্য মার্কেটপ্লেসে পণ্যটির দাম ও গুনাগুন যাচাই করুন। ডেলিভারি টাইম, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া, রিফান্ড পলিসি ও বিক্রয়োত্তর সেবা সম্পর্কিত তথ্যাদি জানতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির চ্যাটবক্সে গিয়ে চ্যাটিং করে পণ্য সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে যারা পণ্যটি সম্পর্কে জানেন তাদের থেকে পরামর্শ নিন। ব্যক্তিগত/সংবেদনশীল কোন তথ্য শেয়ার না করে ক্যাশ-অন ডেলিভারিতে পণ্য ক্রয় করলে অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। প্রতিষ্ঠিত বা নিরাপদ মার্কেটপ্লেস ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে পূর্বেই পেমেন্ট করা যাবে না। বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট ও পেমেন্ট পদ্ধতি নিরাপদ হলে সেক্ষেত্রে অনলাইনে পেমেন্ট করা যেতে পারে। পণ্য ডেলিভারি পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই করে তার কোন ত্রুটি পেলে সেটি উল্লেখপূর্বক পণ্যটি ফেরত পাঠাতে হবে। প্রতারিত হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দ্রুত অভিযোগ দায়ের করতে হবে। লোভনীয় অফার সম্পর্কিত পপ-আপ বা ই-মেইলে প্রাপ্ত ফিশিং লিংকে ক্লিক করা কিংবা পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার করে অনলাইনে কেনাকাটা না করাই উত্তম। অনলাইনে কেনাকাটার পূর্বে আপনি যত সতর্ক ও সচেতন থাকবেন এবং যত বেশি যাচাই-বাছাই করবেন, ততই কমে যাবে আপনার প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা। আমাদের সকলের সতর্কতা ও সচতনতার মাধ্যমেই অনলাইন কেনাকাটায় গ্রাহকদের প্রাপ্য সেবা নিশ্চিত ও সকল প্রকার প্রতারণা নিয়ন্ত্রণ করে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ অনলাইন মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
লেখক : কমান্ডার খন্দকার আল মঈন, বিপিএম (বার), পিএসসি।