অনিন্দ্যসুন্দর সাত ডোরা প্রজাপতি

গত কয়েকদিন আগে এক সকালে রেল লাইনের ধারে পাখির কিছু ভালো ছবি তোলার আশায় নওগাঁর আহসানগঞ্জ স্টেশনের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিলো আহসানগঞ্জ পুরাতন স্টেশনে। সেখানে রেললাইনের পাশে ঝোপঝাড়ে পাখি বসবাসের জায়গায় গিয়ে অনেক খুঁজেও যাকে খুঁজছি সেই পাখির দেখা পেলাম না। তাই বাধ্য হয়েই রেল লাইনের পথ ধরে রাণীনগর স্টেশনের দিকে হাঁটা দিলাম। দুই ধারে চলতেই বেশকিছু প্রজাপতিকে এ ফুলে ঐ ফুলে ওড়াউড়ি করছে। শরৎ এর রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে যাকে খুঁজতে এসেছি না পয়ে ঘুরে ঘুরে শুভ্র আকাশের বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। এর মধ্যে হটাৎ বৃষ্টি শুরু। ব্যাগ থেকে রেইন কোর্ট বাহির করে ক্যামেরা সেভ করে দিলাম দৌড় ততক্ষণে কাকভেঁজা হয়ে এক বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি খানিক বাদে ছেড়েও গেল৷ সেখানে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল আশে পাশে লেবু গাছ আছে কিনা। বাড়ির মানুষদের জিজ্ঞেস করতেই বললেন খানিক দূরে ছোট একটি লেবু বাগান আছে। সেখানে পৌঁছানোর পর দেখি বাগানটিতে বেশ কয়েকটি গাছে দল বেঁধে প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে। একটি প্রজাপতিকে টার্গেট করলাম প্রথমেই ছবি মিস হয়ে গেল। যা হোক, প্রথমে মিস করলেও অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতিটির ছবি তুলতে মোটেও ভুল করলাম না । সেখানেই ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করে প্রজাপতির মেলা থেকে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে ফিরলাম।

এতক্ষণ যাকে নিয়ে আলোচনা করলাম, সে হলো এ দেশের বহুল দৃশ্যমান অতি সুন্দর এক প্রজাপতি সাত ডোরা বা রুরু। অনেকে বলে দোল বাসন্তী। লেবু বা এ জাতীয় গাছেই বংশবৃদ্ধি করে বলে লেবুর প্রজাপতি নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, এশিয়ার কয়েকটি দেশ, পাপুয়া নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের সুন্দর প্রজাপতিগুলোর মধ্যে সাত ডোরা অন্যতম। সোয়ালো পাখির মতো বিভক্ত লেজওয়ালা পরিবারের সদস্য হলেও এরা লেজবিহীন হলুদ ফোঁটাযুক্ত কালো প্রজাপতি। প্রসারিত ডানা ৮০ থেকে ১০০ মিলিমিটার। আকার ও বর্ণে স্ত্রী-পুরুষ একই রকম। সামনের ডানার ওপর ও নিচে অনিয়মিত হলুদ ডোরা, যা ভেঙে অনিয়মিত বড় ফোঁটা ও কারুকাজ তৈরি হয়েছে। পেছনের ডানার ভূমিকোণ প্রান্তে লালরঙা গোলাকার ফোঁটা ও শীর্ষ প্রান্তে কালোর ওপর নীল ফোঁটা রয়েছে। বয়স্কগুলোর হলদে রং কমলায় রূপান্তরিত হয়। ডানার মতো দেহেও (মাথা, বুক ও পেট) রয়েছে কালো ও লেমন হলুদ ডোরা।

সাত ডোরা প্রজাপতি এ দেশের সবখানেই দেখা যায়। গ্রাম ও শহরের ফুলের বাগান, পার্ক, কৃষিজমি এবং উন্মুক্ত বন- কোথায় নেই ওরা? পাহাড়ি এলাকায় দুই হাজার মিটার উঁচুতেও বাস করতে পারে। দিনভর লেবু ফুলে উড়ে উড়ে লম্বা শুঁড়টি দিয়ে রস পান করে বেড়ায়। রঙ্গন ও অন্যান্য ফুলেও দেখা যায়। দ্রুত উড়ূক্কু ও চঞ্চল প্রজাপতিগুলো কদাচ গাছে বসে। তবে সারা বছর দেখা গেলেও বর্ষা ও বর্ষার শেষেই আনাগোনা বেশি। মূল খাবার ফুলের রস; তবে দলবেঁধে ভেজা মাটির রস চুষতে দেখা যায়।

বেল, পাতি বা জামির লেবু, মটকিলা, বড়ই ইত্যাদি এদের পোষক গাছ। স্ত্রী পোষক গাছের কচি পাতার ওপর দিকে পাতাপ্রতি একটি করে হালকা হলুদ গোলাকৃতি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে তিন থেকে ছয় দিনে শূককীট বেরোয় ও ১৩ থেকে ২৩ দিনে তা মূককীটে রূপান্তরিত হয়। মূককীট থেকে ৮-২২ দিনে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি বেরোয়; যার আয়ুস্কাল মাত্র তিন থেকে ছয় দিন। ডিম পাড়া থেকে মৃত্যু অর্থাৎ পুরো জীবনচক্র ৩০ থেকে ৪৩ দিনে সম্পন্ন হয়।

লেখক : আলোক চিত্রশিল্পী শামীনূর রহমান।

আরও পড়ুন...