“মা, গল্প বলো” আবদার সাত বছরের ছোট্ট নিয়ন্তার।
“এক যে ছিলো রাজকন্যা”
“মা, বাবা আসবে কখন?”
“একটু রাত হবে।”
“বাবা এতো রাতে আসে আর এতো ভোরে চলে যায় যে আমার সঙ্গে দেখাই হয় না।” অভিমান নিয়ন্তার কণ্ঠে।
ঠিকই তো। বিয়ের পর থেকেই হাসিবের কাজের চাপ প্রজ্ঞার প্রাত্যহিক জীবনকে বর্ণহীন করে দিয়েছে। ছোট্ট নিয়ন্তার বাবার জন্য সে কী আকুলতা।
“গল্প শোন। এক ছিলো রাজকন্যা। আর এক ছিলোৃ”
“মা, নিয়ন্তা অর্থ কী? মিস জানতে চেয়েছিলেন।”
“নিয়ন্ত্রণকারী”
নিয়ন্তা অর্থটা বুঝতে পারে না। ক্লান্ত প্রজ্ঞারও এটা ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছে করছে না। প্রজ্ঞা আবার শুরু করে, এক যে ছিলো রাজকন্যা, আর এক ছিলো রাজপুত্র।
প্রজ্ঞার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এটা অবশ্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
তার স্বপ্নের রাজপুত্র হয়ে নীরব একাকী অপেক্ষমাণ। নীরব গত আট বছরে নীরবে-নিভৃতে প্রজ্ঞার বিবর্ণ জীবনকে রঙধনুর বর্ণিল ছটায় রাঙিয়ে দিয়েছে। হাসিব যখন প্রজ্ঞার ভাবনার পৃথিবীকে পদদলিত করে, নিষ্পেষিত করে, তখনই নীরব সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়, প্রেরণা যোগায়। নীরব প্রজ্ঞার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। ফার্স্ট ইয়ারেই প্রজ্ঞার বিয়ে হয়ে যায়। সে ক্লাস করতে পারেনি। মূলত নীরবের দেওয়া নোট, সাজেশন দিয়েই মাস্টার্স শেষ করা। পরীক্ষা ছাড়া কখনও দেখা হয়নি ওদের। শুধুই ফোনে কথা। নীরব তাকে শিখিয়েছে নিজেকে সম্মান করতে। প্রজ্ঞা যখন বলে, “আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। কথায় আছে না “But sometimes black may take several colours”। নীরব প্রজ্ঞার কাছে গ্রীষ্মের দাবদাহে ছায়ার মতো। ওর কণ্ঠস্বর জীবনকে ভালবাসতে শেখায়। কখন যে ওরা একে অপরকে অনুভব করতে শুরু করেছে নিজেদেরই অজানা।
“মা, তারপর।”
সম্বিৎ ফিরে পায় প্রজ্ঞা। “তারপর”
“মা, বাবাকে ফোন করে দাও।”
“নিয়ন্তা, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? আমাকে? না তোমার বাবাকে?”
“বাবাকে।”
হিংসে হওয়ার বদলে সাহস পায় প্রজ্ঞা। তার কঠিন সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করার জন্য নিয়ন্তার কাছ থেকে এমন জবাবই প্রত্যাশা করছিল সে। শ্রদ্ধাবনত ভালবাসার বর্ষণে ভিজতে চায় সে।
কাল নিয়ন্তার মিস স্কুলে প্রজ্ঞাকে দেখা করতে বলেছেন। প্রজ্ঞার ভয় নিয়ন্তা হয়তো বড় ধরনের কোনো দুষ্টুমি করেছে। সে ঠিক করে রেখেছে, কাল নিয়ন্তার মিসের সঙ্গে দেখা করে ওকে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে বাইরে গিয়ে হাসিবকে ফোন করে বলবে, “তার একটু কাজ আছে। হাসিব যেনো নিয়ন্তাকে স্কুল ছুটির পর বাসায় নিয়ে যায়”। তারপর সে আর নীরব চলে যাবে কোনো এক অজানা পথ ধরে, যেখানে কেউ তাদের খুঁজে পাবে না। নিয়ন্তা বাবার ভক্ত। ও কী মাকে খুঁজবে? না, প্রজ্ঞা এসব ভাবতে চায় না। নিয়ন্তা ঘুমোচ্ছে।
পরদিন মিস প্রজ্ঞার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি নিয়ন্তার মা? আপনি তো অসম্ভব সৌভাগ্যবতী একজন মা। নিয়ন্তার কল্পনায়, চিন্তা-চেতনায় প্রথমেই আপনি আবির্ভূত হন। কাল ক্লাস এ সবাইকে বলেছিলাম ইচ্ছেমতো ছবি আঁকতে। বাইশজন স্টুডেন্টের মধ্যে একুশজনই ডোরেমনের ছবি এঁকেছে। দেখুন ও আপনাকে কতো ভালবাসে। ও এঁকেছে আপনার ছবি”। প্রজ্ঞা দেখল, অনেকগুলো ডোরেমনের ভিড়ে একটি পুতুলের ছবি। নিচে লেখা, “আমার মা, আমার ভালোবাসা”।
প্রজ্ঞার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। নিজেকে কেবলই মনে হচ্ছে একটি কার্টুন চরিত্র। সে দ্রুত ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে।
মোবাইল ফোনটা হাতে নেয় প্রজ্ঞা। নীরবকে ফোন করে বলে, “আমি ভালো আছি, নীরব। এ ক্ষণটি থেকে আমি তোমার অচেনা একজন। ভালো থেকো”। বলেই সে মোবাইলটা বন্ধ করে রাখে।
কিছুক্ষণ পর সময় দেখার জন্য মোবাইলটা অন করতেই নীরবের এসএমএস।
বাসায় ফিরছে প্রজ্ঞা আর নিয়ন্তা।
“মা, ছবিটায় তোমার চোখে একটু পানি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওয়াটার পটের পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই ছবিটা পুরোপুরি তোমার মতো হয়নি”।
“আমার মতোই হয়েছে। আমার চোখে তুমি আর কখনও পানি দেখবে না, মা।”
“সত্যি? রাতে গল্পটি তো শেষ করোনি। এখন বলো।”
প্রজ্ঞা শুরু করে, “এক যে আছে রাজকন্যা। তার নাম নিয়ন্তা। আমার নিয়ন্তা। এক অমোঘ নিয়ন্তা…”।
পিবিএ/শআ