অশান্ত রাখাইন: এক টেবিলে বাংলাদেশ-ভারত-চীন

একে একে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে মিয়ানমার। কোণঠাসা কেন্দ্রীয় বাহিনী তথা জান্তা সরকার। তাদের হাত ছাড়া হচ্ছে এলাকার পর এলাকা। বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলগুলো বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। দু’দিন আগে বাংলাদেশ ঘেঁষা রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে বিদ্রোহীরা। সীমান্ত ঘেঁষা মংডুর ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় দখল প্রতিষ্ঠা করতে তারা সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া।

উত্তেজনা আছে দেশটির শান রাজ্যে। জানুয়ারিতে শান রাজ্যের হোপাং শহরে আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি (ইউডব্লিউএসপি)। ওই রাজ্যের দু’টি শহর তারা তখনই দখল করে নেয়।

ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে চীন সীমান্তবর্তী একটি সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয় দেশটির জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। রাজ্যের মানশি শহরে অবস্থিত ওই ঘাঁটিতে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) ও কাচিন পিপল্‌স ডিফেন্স ফোর্স (কেপিডিএফ) যৌথভাবে আক্রমণ চালায়। কয়েকদিনের তুমুল লড়াইয়ের পর জান্তা সেনারা পিছু হটলে ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা।

মার্চে থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছাকাছি মায়াবতী শহরে জান্তার একটি কার্যালয় ও থানা দখল করে নেয় ওই অঞ্চলে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ) ও তাদের সহযোগীরা। মায়াবতী শহরের থিঙ্গানিনাউঙ্গ অঞ্চলে জান্তার ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ৩৫৫ এর পতন হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং বর্ডারিং কান্ট্রিগুলোর করণীয় ঠিক করতে মিয়ানমারের আশপাশের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি ইনফরমাল বৈঠক বসছে ব্যাংককে। জরুরি ওই আলোচনায় এক টেবিলে বসছে বাংলাদেশ-ভারত ও চীন। সেখানে পূর্ব তিমুরও অংশ নিতে পারে বলে জানা গেছে। ওই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো হয়নি।

তবে কূটনৈতিক সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, ব্যাংককের এক্সট্রাঅর্ডিনারি বৈঠকটি হবে ১৯শে ডিসেম্বর। হোস্ট থাইল্যান্ডের তরফে ইনফরমাল সেই বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর থাকবেন এ বিষয়েও নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ।

তবে চীনের প্রতিনিধিত্ব কে করবেন তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশায় রয়েছে ঢাকা। যেহেতু মিয়ানমার পরিস্থিতিই অত্যাসন্ন বৈঠকের মুখ্য আলোচ্য তাই এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে।

মঙ্গলবার দুপুরে রোহিঙ্গা সংকট ও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মধ্যে এ নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বুধবার বলেন, ‘আমি এটুকুই বলবো যে, গুরুত্বপূর্ণ ওই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, আমি যাচ্ছি। বৈঠক শেষে ফিরে এসে গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানাবো।’ একদিন আগে সিএনএন জানিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ২৭১ কিলোমিটার এলাকা দখল নিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা আরাকান আর্মি।

দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মংডুর সেনা ঘাঁটি দখলে নিয়ে ১৬৮ মাইল এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তারা। এর মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে পুরোপুরি নিজেদের দখল বলবৎ করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। যার মাধ্যমে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় সফলতা অর্জন করলো তারা।

রিপোর্টে বলা হয়, এই রাখাইন রাজ্যকে কেন্দ্র করেই গোটা মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২১ সালে অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটিতে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এরপর থেকে রাখাইনে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। এর নেতৃত্বে রয়েছে আরাকান আর্মি নামের সশস্ত্র সংগঠন।

সশস্ত্র গোষ্ঠীটির এক মুখপাত্র সোমবার অজ্ঞাত এক স্থান থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রোববার মংডু শহরের শেষ সামরিক ঘাঁটিটি দখলের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সীমান্ত এলাকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে গোষ্ঠীটি। মংডুর এই যুদ্ধের পরে প্রায় ৮০ জন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীসহ সরকারি সৈন্যদের পাশাপাশি সামরিক অপারেশন কমান্ড ১৫-এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুনকে গ্রেপ্তার করেছে আরাকান আর্মি। মে মাসের শেষের দিকে মংডু আক্রমণ শুরু করে তারা। মাত্র ছয় মাসের মাথায় সীমান্তবর্তী এই শহরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিলো গোষ্ঠীটি।

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর রিপোর্ট মতে, মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল তথা রাখাইনের এই জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী জানিয়েছে, কয়েক মাসের লড়াইয়ের পর রোববার ভোরে মংডু শহরের বাইরে অবস্থিত মিয়ানমারের জান্তাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন সীমান্তরক্ষী পুলিশের ৫ নম্বর ব্যাটালিয়নের ঘাঁটি দখল করেছে বিদ্রোহীরা। এটি বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন সবশেষ ঘাঁটি ছিল।

রিপোর্ট বলছে, জান্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের মিত্র হিসেবে রোহিঙ্গা মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ), আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করছিল। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তারা হয় পালিয়েছে, না হয় আত্মসমর্পণ করেছে।

জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, রাখাইনের লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে। জান্তা সরকার রাজ্যে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য সরবরাহ বন্ধ করতে সড়ক ও জলপথ অবরোধ করেছে।

রাখাইনে চলমান লড়াই পর্যবেক্ষণকারী সামরিক বিশ্লেষকদের বরাতে বিশ্ব সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য পুনরুদ্ধার রাখাইন রাজ্যের মানুষের দুর্দশা লাঘবে সহায়ক হতে পারে। এক বিশ্লেষক বলেন, রাখাইন রাজ্যে জটিল রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের উচিত বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা করা।

তবে এখন পর্যন্ত (গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) বাংলাদেশ ফরমাল কিংবা ব্যাকডোর চ্যানেলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেনি বলে দাবি করেছেন সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা।

আরও পড়ুন...