আকরাম হোসাইন, পিবিএ, রাবি : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, বিভিন্ন জায়গায় সৌন্দর্যবর্ধন, একাডেমিক ভবন বর্ধিত অংশের কাজ, কয়েকটি মূর্যাল নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে নতুনত্ব। তবে এসব উন্নয়ন আর সৌন্দর্যের মাঝেও নানা প্রশ্নের যোগান উঠেছে। বিশেষ করে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ, অডিও ফাঁস, জয় হিন্দ সেøাগানসহ বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্দোলন করে খোদ সরকার দলীয় প্রগতিশীল শিক্ষকদের একাংশই। ফলে বিতর্কেই মধ্যে বছর পার করতে হলো বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকে।
এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান তার কন্যা ও জামাতার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে নিয়োগ প্রদানের অভিযোগ, কর্মচারীদের আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে ৩৫ বছর করে নিয়োগ প্রদান, নিয়োগ বোর্ড না করেই অর্ধশতাধিক নিকট আত্মীয়দের নিয়োগ, ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট ভঙ্গ করে আইন ও ভূমি প্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে নিয়োগ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সভাপতি নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ ওঠে।
শুধু তাই নয়, গত ৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তৃতায় ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানে ফের বিতর্কে জড়ান তিনি। এছাড়া আচার্য’র অনুমতি ছাড়া উপাচার্যের পদ থেকে নিজ বিভাগে যোগদান, আরেকজনকে উপাচাযের্র দায়িত্ব দেওয়া, নিজ সম্পর্কিত বিষয়ে নিজেই সিন্ডিকেটের সভাপতিত্ব করাসহ কয়েকটি অভিযোগে উপাচার্যসহ ৬ জনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সালমান ফিরোজ ফয়সাল এর পক্ষে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী মুহা. মুজাহিদুল ইসলাম।
গত ২ মে আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের সভাপতি পদে নিয়োগ নিয়ে দেওয়ায় উপাচার্যসহ প্রশাসনের ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন সহযোগী অধ্যাপক শাহরিয়ার পারভেজ।
শুধু উপাচার্য নয় আইন বিভাগের নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস নিয়ে বিতর্কে পড়েন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী মো. জাকারিয়াও। এতে নুরুল হুদা নামের সাবেক শিক্ষার্থীর স্ত্রীর সাথে দর-কষাকষির একটি অডিও (ফোনালাপ) ফাঁস হয়। সেখানে ৪৮ সেকেন্ডের অডিওতে কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি। উপরে আল্লাহ তায়ালা, নিচে আমি সংক্রান্ত বিষয় ফুটে ওঠে। তবে উপ-উপাচার্য বরাবরই তা নাকচ করে দেন। নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে উপ-উপাচার্য জাকারিয়া ও আইন বিভাগের সভাপতি ড. আব্দুল হান্নান পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে একে অপরকে দোষারোপ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন ডকুমেন্ট উত্থাপন করে আইন বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ড. আব্দুল হান্নানের উপর দায় এড়ান এবং তা তদন্ত করার দাবি জানান উপ-উপাচার্য। আর নিয়োগ বাণিজ্যের ফোনালাপ ফাঁস থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই উপ-উপাচার্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ তুলেন আইন বিভাগের সভাপতি ড. হান্নান।
তবে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে অভিযোগ উঠে, নূরুল হুদা অনুষদে সেরা, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পেয়েও তার চাকরি হয়নি। কিন্ত এর মধ্যে নিয়োগ পায় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক জাকারিয়ার মেয়ের জামাই সাইমুন তুহিন, রাজশাহী জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর মেয়ে নূর নূসরাত সুলতানা। আর আরেকজন ওই বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী বনশ্রী রানী প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়ে যোগদান করেন।
অডিও ফাঁস ছাড়াও জাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে প্যারিস রোডসহ বিভিন্ন রাস্তায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ঘাস লাগানো, আবার সেই ঘাস উঠিয়ে সেখানেই ফুটপাথ তৈরি করে সরকারি অর্থের অপচয় ও লোপাট করার অভিযোগ ওঠে। এনিয়ে ক্যাম্পাসে তুমুল সমালোচনার হয়। সেই সাথে খোদ প্রগতিশীল শিক্ষকরাই আন্দোলন করে প্রশাসনের পদত্যাগের দাবিতে। যা এখনো চলমান। তাদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ‘লালকার্ড’ দেখিয়ে তাদের অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন। আর এই অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৫৮ জন শিক্ষক অপসারণের দাবি জানান।
রাকসু নির্বাচন:
রাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন। যদিও এ বছরের জানুয়ারি মাসে বিশ^বিদ্যালয় প্রক্টর আহবায়ক করে সংলাপ কমিটি গঠন করা হয়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে মে মাসে ১২ টি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ও ৯টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে সংলাপ করে প্রশাসন। এর পরই থেমে থাকে রাকসু নির্বাচনের মূল কাজ। তাই নির্বাচন আদৌ হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা কাজ করে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে।
অবকাঠামো উন্নয়ন:
তবে বিতর্ক থাকলেও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নসহ বেশ কিছু অনুষ্ঠান বিশ^বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি তুলে এনেছে। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামোর মধ্যে ড. এম ওয়াজেদ মিয়া একাডেমিক ভবনের বাকি অংশ, ইসমাঈল হোসেন সিরাজী একাডেমিক ভবন বর্ধিত অংশ, শেখ রাসেল মডেল স্কুলের নির্মাণ কাজ চলমান, প্রশাসন ভবন, নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী হলের ছাদ পুনরায় তৈরি, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের কাজ সমাপ্ত, প্যারিস রোডের ফুটপাত নির্মাণ, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সৌন্দর্যবর্ধন, বইয়ের মূর্যাল, ওয়েবসাইট নির্মাণ, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় ছবি সংযোজনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এছাড়া গত ৩০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১তম সমাবর্তন হওয়া, সর্বোচ্চ মেধাতালিকা থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) মেধাবৃত্তির জন্য আট শিক্ষার্থীর মনোনীত হওয়া, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মোট ২২২ জনের ফেলোশিপ নির্বাচিত, জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু রেজার মাধ্যমে দেশের প্রথম সাপের বিষের ডাটাবেজ তৈরি, শিক্ষাবিষয়ক তথ্য নিয়ে বিভাগের প্রথম থেকে চতুর্থ বিভাগের সকল প্রয়োজনীয় তথ্যের অ্যাপ, কৃতি শিক্ষার্থীদের ডিনস অ্যাওয়ার্ড প্রদান, চীনের হুয়াজং কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে বিভিন্ন চুক্তি করা হয়েছে।
পিবিএ/এএইচ/জেডআই