আইলার এক দশক: বাঁধের উপর মানুষের মানবেতর জীবন-যাপন

পিবিএ,খুলনা: প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার এক দশকপূর্তি আজ। ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে এ ঝড়। খুলনার উপকূলীয় দুই উপজেলা দাকোপ ও কয়রার অসংখ্য মানুষ আইলার তান্ডবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ঘর-বাড়ি, সহায় সম্পদ হারিয়ে নদী তীরবর্তি বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয় অনেক পরিবার।

ধীরে ধীরে সে সব পরিবারের অনেকেই নিজের বসত ভিটেয় ফিরে গেলেও গত এক দশক ধরে দুটি উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার পরিবার বাঁধের উপর ঝুপড়ি ঘরে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগী, সুতারখালি, কয়রা উপজেলার গোলখালি, পাথরখালি, গোবরা, মঠবাড়ি এলাকার নদী তীরবর্তী বাঁধের উপর গত দশ বছর ধরে বসবাস করছেন দেড় হাজার পরিবার।

এসব পরিবারগুলোর বেশিরভাগ আইলার দূর্যোগে তাদের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়েছেন। আবার আইলা পরবর্তিতে অনেকেই নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। আইলার জলোচ্ছ্বাসে দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামের মুসা শেখ তার বসতবাড়ি হারায়। পরে ভাঙনে তার চার কাঠা জমিও চলে যায় শিবসা নদীগর্ভে। এখন স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন বেড়িবাঁধের পাশে। দিনমজুর মুসা শেখের সামর্থ্য নেই জমি কেনা বা বাড়ি করার। তাই ঝড়-বৃষ্টির সময় ঝুপড়ি ঘরে আতঙ্কে থাকেন তারা।

আইলার এক দশক: বাঁধের উপর মানুষের মানবেতর জীবন-যাপন
বাঁধের উপর মানুষের মানবেতর জীবন-যাপন

একই উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালীবাড়ি গ্রামের অজিত সরদার মারা যান ঘূর্ণিঝড় আইলায়। ভেঙে যায় ঘরবাড়ি। তার স্ত্রী কমলা সরদার মেয়ে শিউলিকে সম্প্রতি বিয়ে দিয়েছেন। এখন ছেলে লিটন সরদারকে নিয়ে বাঁধের ওপরের ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। কমলা নদীতে মাছের পোনা ধরে ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। বাড়ি করার মতো সামর্থ্য তার নেই। তিনি জানান, জোরে বাতাস হলেই এখন তার ঘর উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সামর্থ্য না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে নদীতীরেই বাস করছেন।

শুধু মুসা শেখ বা কমলা সরদারই নন, আইলা দুর্গত খুলনার দাকোপ ও কয়রা উপজেলাবাসীর দুর্ভোগ গত এক দশকেও শেষ হয়নি। অনেক মানুষ এখনও ঘরবাড়ি তৈরি করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ওয়াপদা রাস্তা ও বাঁধের পাশে ঝুপড়ি ঘরে কোনো রকমে জীবন পার করছেন তারা।

ক্ষতিগ্রস্ত অনেক রাস্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিকমতো সংস্কার করা হয়নি। খাবার পানির জন্য এখনও চলছে হাহাকার। বেড়িবাঁধগুলোর অবস্থাও নাজুক। সব মিলিয়ে এখনও অনেক মানুষ আছেন চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।
সূত্র অনুযায়ি, আইলার জলোচ্ছ্বাসে খুলনার দুই উপজেলায় ৫৭ জন নিহত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েক লাখ মানুষ।

স্থানীয় সরকার সূত্র জানায়, বর্তমানে খুলনার কয়রা ও দাকোপসহ উপকূলীয় পাঁচ উপজেলায় সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে মাত্র ১৫৮টি। যাতে মাত্র ৩৯ হাজার ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। প্রয়োজনের তুলনায় সাইক্লোন শেল্টারের সংখ্যা অনেক কম।

এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৮৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টি স্বীকার করে অর্থাভাবে তা মেরামত করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। স্থানীয়রা জানান, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় দুই উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার মানুষ এখনও বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়ি ঘরে বাস করছে। নতুন যে কোনো দুর্যোগে তারা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

সরেজমিন দেখা যায়, কয়রা উপজেলার পাথরখালী এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছে আইলায় গৃহহারা ২২টি পরিবার। গোবরা গ্রামে বেড়িবাঁধের ওপর রয়েছে প্রায় অর্ধশত পরিবার, মঠবাড়িয়া বেড়িবাঁধের ওপর রয়েছে বাস্তুহারাদের সারি সারি ঝুপড়ি ঘর।

এ ছাড়া ৪ নম্বর কয়রা লঞ্চ ঘাট এলাকা, ৬ নম্বর কয়রা, দক্ষিণ বেদকাশী ও মহেশ্বরিপুর গ্রামের বাঁধের ওপরও বাস করছেন দুই শতাধিক পরিবার। রোদ, বৃষ্টি ও ঝড়ে এসব পরিবারের সদস্যরা দূর্বিসহ জীবন কাটান। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য সেখানে বসবাস কষ্টসাধ্য।

আইলাদুর্গত সংহতি মঞ্চের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, জীবন বাঁচাতে এসব মানুষ কোন রকমে মাথা গুজে পড়ে আছে। এসব পরিবারের শিশুরা নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে। কারন জীবিকার তাগিদে বাবা মায়েদের তাদের শিশু সন্তানদের শিক্ষার দিকে খেয়াল করার সময় হয়ে ওঠেনা। আইলার পর ঠিকমতো পুনর্বাসন না হওয়ায় অনেক পরিবার অনিশ্চিত জীবন-যাপন করছেন বলেও জানান তিনি।

খুলনা জেলা প্রশাসক হেলাল হোসেন বলেন, আইলার দুর্গতদের পুনর্বাসনে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও নানা কার্যক্রম চলছে। আইলা ও নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। খুলনা-৬ আসনের (কয়রা-পাইকগাছা) সংসদ সদস্য মো. আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, বিগত দিনে যথেষ্ট বরাদ্দ থাকলেও বেড়িবাঁধ ঠিকমতো সংস্কার করা হয়নি। তিনি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হলে উপকূলবাসীর দূর্ভোগ লাঘব হবে না বলে জানান তিনি।

পিবিএ/এইচআর/আরআই

আরও পড়ুন...