পৃথিবীর যে কোনো পরিবহনের মধ্যে আকাশ পরিবহন সবচেয়ে নিরাপদ ভাবা হয়। সারা বিশ্বে আকাশপথে চলাচলকারী উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ উড়োজাহাজই সবসময় আকাশে বিচরণ করে থাকে। আর প্রতিটি উড়োজাহাজই আইকাও কোড কিংবা আয়াটা প্রদত্ত কোড ব্যবহার করে চলাচল করে থাকে। সারা বিশ্বের সব উড়োজাহাজই চলন্ত অবস্থায় কোনো না কোনো এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে সংযুক্ত থাকে।। যখনই কোনো উড়োজাহাজ কোনো কন্ট্রোল টাওয়ারের থেকে বিচ্যুতি ঘটে কিংবা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় তখনই উড়োজাহাজটি দূর্ঘটনায় পতিত হয়।
আকাশ পরিবহনে দূর্ঘটনার হার অন্যান্য পরিবহনের তুলনায় খুবই কম। তারপরও বিমান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিমান ভ্রমণ ও বিমানের যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সবসময়ই ব্যতিব্যস্ত থাকে। প্রতিটি দূর্ঘটনার পর কারণ অনুসন্ধানে উচ্চপদস্ত বিশেষজ্ঞদ্বারা কাজ করে থাকে। নতুন কোনো উপাত্তের আবির্ভাব ঘটে থাকলে সারা বিশ্বের সকল এয়ারলাইন্স এর জন্য নতুন একটি নিরাপত্তা নির্দেশক হিসেবে পলিসি অন্তর্ভূক্ত করে থাকে আইকাও। কারণ হিসেবে একই ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
সড়ক দূর্ঘটনা কিংবা নদী পথের দূর্ঘটনার থেকে আকাশ পথের দূর্ঘটনায় সাধারণ মানুষ বেশী উৎকন্ঠায় থাকে। কি কারণে উড়োজোহাজের দূর্ঘটনা ঘটে থাকে? অনেকেরই জানার আগ্রহ থেকে। সাধারণত তিনটি কারনে বিমান দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। হিউমান এরর বা মনুষ্য সৃষ্টির কারণে, টেকনিক্যাল এরর বা প্রকৌশলগত ত্রুটি এবং ব্যাড ওয়েদার বা খারাপ আবাহাওয়ার কারনে সাধারণত উড়োজাহাজগুলো দূর্ঘটনায় পতিত হয়।
উপরোক্ত তিনটি কারণ ছাড়াও আরো নানা কারনে উড়োজাহাজগুলো দূর্ঘনার সম্মুখীন হয়। সাধারণ যাত্রী কিংবা যাদের এভিয়েশন নিয়ে চরম আগ্রহ রয়েছে তাদের জানার আগ্রহ থেকেই কয়েকটি বিষয় বা কারণ নিয়ে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা কেন কিংবা কি কি বিষয় নির্ভর করে তা উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
উড়োজাহাজের অবকাঠামোগত ত্র্র্র্রুটির জন্য মারাত্নক দূর্ঘটনায় পতিত হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট লাইফ সাইকেল থাকার পরও উড়োজাহাজের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে ফাটল দেখা দিতে পারে, কিন্তু বাহির থেকে তা দেখা না যেতে পারে। যদিও উড়োজাহাজের সি-চেক,ডি-চেক করার সময় প্রতিটি কম্পোনেন্ট চেক করা হয়, তারপরও অবকাঠামোগত ত্রুটির জন্য দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয় উড়োজাহাজ। অনেক সময় লাইফ সাইকেল থাকার পরও উইন্ডশিল্ড ভেঁঙ্গে যায়, ফলে উড়োজাহাজটি দূর্ঘটনায় পতিত হয়। দক্ষ পাইলট হলে বিমানটিকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। উইন্ডশিল্ড ভাঙ্গার খবর বিভিন্ন সময় পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে আসে।
বার্ড হিট বা বার্ড স্ট্রাইক এর কারণে অনেক দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। সাধারণতঃ বিমানবন্দর এলাকায় ফ্লাইট উড্ডয়ন কিংবা অবতরণের সময় বার্ড হিট হয়ে থাকে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বার্ড হিট থেকে
উড়োজাহাজকে রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী ব্যবহার করে থাকে, তারপরও বার্ড হিট হয়ে থাকে। বার্ড হিটের কারণে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যেতে পারে, উইন্ডশিল্ড ভেঁঙ্গে যেতে পারে।
সন্ত্রাসী ব্যক্তি কিংবা হাইজ্যাকের কারনে উড়োজাহাজের দূর্ঘটনা শিকার হতে পারে। যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী আক্রমন প্রতিরোধ করার জন্য বিমানবন্দরে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়, তারপরও সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা গোষ্ঠি দ্বারা উড়োজাহাজের ক্ষতি সাধন দেখা যায়।
বর্তমান সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি অস্ট্রেলিয়াতেও প্রায় প্রতি বছর দাবানল দেখা যায়। তাতে আগ্নেয় ছাই হতে উদ্গত ধোয়া উড়োজাহাজের প্রপেলার, ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ছাই ভষ্মের কারনে উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ব্যাড ওয়েদারের সময় বিমানের রক্ষণাবেক্ষনে নিয়োজিত বিভিন্ন ইক্যুপমেন্ট যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারনে সেগুলি দ্বারা উড়োজাহাজের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সঠিক ক্ষতি নিরূপন না করে পরবর্তী সিডিউল ফ্লাইট পরিচালনা থেকে বিরত থাকাই উত্তম। রানওয়েতে পরিত্যাক্ত ধাতব দ্রব্য উড়োজাহাজের ক্ষতি সাধন করতে পারে।
আমরা সব সময় ট্রাভেল করার সময় দেখে থাকি কেবিন ক্রুরা ঘোষণা দিয়ে থাকেন, ভ্রমণ কালীন সময় যেকোনো ধরনের ইলেকট্রোনিক ডিভাইস বিশেষ করে মোবাইল, রিমোট কন্ট্রোল জাতীয় কোনো যন্ত্র, ল্যাপটপ ব্যবহার থেকে বিরত থাকার জন্য। কারণ হিসেবে উড়োজাহাজের কম্পাস সিস্টেমকে বিঘ্নিত করতে পারে এধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস।
কোনো পাইলট নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকলে, উড়োজাহাজ চালানোর সময় ভুল করে ফেলতে পারে। যার কারনে মারাত্নক দূর্ঘটনার শিকার হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ককপিটে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয় না। এভিয়েশনের ইতিহাসে দেখা যায় পাইলট কিংবা কো-পাইলট আত্নঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে উড়োজাহাজকে দূর্ঘটনায় ফেলার রেকর্ডও আছে।
উঁচু পাহার কিংবা সুউচ্চ ইমারতের উপর দিয়ে উড়োজাহাজ নিয়ে যাওয়ার সময় পাইলট নেভিগেশনাল ইক্যুপমেন্ট এর ভূল নির্দেশনায় মারাত্নক রকমের দূর্ঘটনায় পড়তে পারে। একজন পাইলট বিভ্রান্ত হতে পারেন, যদি প্রিন্টেড ডকুমেন্ট কিংবা ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র ও সংকেতের মাধ্যমে কিংবা গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে প্রেরিত ত্রুটিপূর্ণ নির্দেশনা অথবা তথ্যগত যেকোনো ভুলের কারনে ঘটতে পারে মারাত্নক দূর্ঘটনা।
বজ্রপাতের জন্য ইঞ্জিনের ক্ষতি হতে পারে, ককপিটের ইক্যুইপমেন্টের ক্ষতি হতে পারে। ঘটতে পারে দূর্ঘটনা। আবার খারাপ আবহাওয়ায় শীলা বৃষ্টি, ভারী বর্ষণ, টর্নেডোর মতো অতি দ্রুতগতি সম্পন্ন বায়ুপ্রবাহ উড়োজাহাজকে দূর্ঘটনায় ফেলতে পারে।
অনেকসময় ভুল বশতঃ সামরিক বাহিনীর আক্রমণের শিকার হতে হয় যাত্রীবাহী বিমান কিংবা কার্গো বিমানের।
উড়ন্ত অবস্থায় জ্বালানী তেলের স্বল্পতা কিংবা ইঞ্জিন বিকল হয়ে যেতে পারে। তৎক্ষনাৎ পাইলট নিকটবর্তী কোনো বিমাবন্দরে জরুরী অবতরণ করার সিদ্ধান্ত না নিলে মারাত্নক দূর্ঘটনার শিকার হতে পোরে। এছাড়া তুষারপাতে কিংবা বরফ ঝরে উড়োজাহাজ না চালানোই সঠিক সিদ্ধান্ত। নতুবা বিপদকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ফলে ঘটতে পারে দূর্ঘটনা।
অবতরন ও উড্ডয়নের সময় রানওয়ের অবস্থান ও সীমানা সম্পর্কে ভুল ধারনা দূর্ঘটনার কারন হতে পারে। এছাড়া ল্যান্ডিং এর সময় পাইলট সঠিক রানওয়ে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে দূর্ঘটনার শিকার হতে হবে।
একটি উড়োজাহাজ যেকোনো কারনেই দূর্ঘটনার সম্মখীন হতে পারে। সারাবিশ্বের সব বিমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষ নিরাপদ বিমান পরিচালনার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। নিরাপদ সেবা দেয়ার জন্য নিরাপদ বিমান ভ্রমণের সকল কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
নিরাপদ ভ্রমণ আপনার, আমার, সকলের প্রত্যাশা। বিশ্বের আকাশপথ হোক নির্ভাবনার। আনন্দময় ভ্রমণ হোক, সবার ইচ্ছার প্রতিফলন।
লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম,মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স