তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে অন্তরায় তামাক--০১

আড্ডায় তামাকে আসক্ত তরুণ-তরুণী

মোঃ এমদাদ উল্যাহ,পিবিএ: আনিসুর রহমান, আবুল কালাম, গিয়াস উদ্দিন, আরিফুর রহমান ও কামাল হোসেন। তারা একে অপরের বন্ধু। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নামকরা একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। তারা বিদ্যালয়ে টিফিন বিরতির সময় পাশের টং দোকানে বসে প্রায় প্রতিদিনই ধূমপান করে। গত ৩১ মার্চ বৃহস্পতিবার এমন চিত্র দেখা গেছে। বন্ধুদের আড্ডায় ধূমপানে আসক্ত হয়েছে তারা। এমনই দাবি করেছেন টং দোকানদার। একইভাবে ছাত্রীদেরও অনেকে ধূমপানে আসক্ত।

জানা গেছে, প্রত্যেকে পড়ালেখা বা অন্য কাজে মানুষের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। এরমধ্যে ভালো বন্ধুর সাথে অপরজন ভালো থাকে। অনেক সময় ধূমপানে আসক্ত বন্ধুর পাল্লায় পড়ে অন্যরাও ধূমপানে জড়িয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই জানে না ধূমপানের ক্ষতিকর দিক। আবার একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধূমপানে আসক্ত হবার পেছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করে। গবেষকদের মতে, ডিপ্রেশান ধূমপানে আসক্ত হবার অন্যতম কারণ। হতাশা, মানসিক চাপ, তীব্র দুঃখ, ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থতা ক্রমশ একজন সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। ডিপ্রেশান এক ভয়ংকর ব্যাধি। যে মানুষ একবার ডিপ্রেশানের কালো অন্ধকার জগত দেখেছে, তার পক্ষে সেখান থেকে বের হওয়া মুশকিল। একবার পেয়ে বসলে ব্যক্তির বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব ধূসর হয়ে যায়। ডিপ্রেশানের কালো থাবায় নিমিষে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় বিবেকবান মানুষ। আর এই হিতাহিতশূন্য অবস্থায় হাতছানি দেয় মাদক। সিগারেট আজকাল সহজলভ্য হওয়ায় ব্যক্তি হাতে তুলে নেয় সিগারেটের মরণব্যাধির ধুম্রশলাকা। চুমুকে চুমুকে নিঃশেষ করে দিতে চায় প্রাণ বায়ু। মূলত, সিগারেটের নিকোটিন হতাশা, ক্ষোভ, রাগ প্রশমনে সহযোগিতা করে।

গবেষণায় জানা গেছে, যখন কেউ ধূমপান করে, নিকোটিন মাত্র দশ সেকেন্ডে তার মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। আর এই নিকোটিন মস্তিষ্কের পরিস্কার অংশকে উত্তেজিত করে ডোপামিন হরমোন ক্ষরণে ভূমিকা রাখে। যার ফলে ব্যক্তি নিমিষে আনন্দ অনুভব করে। প্রথমদিকে, নিকোটিন ব্যক্তির মানসিকতা এবং মনোযোগে প্রভাব ফেলে। পেশীদের শান্ত করে দেয়, রাগ-হতাশা কমায়। একই সাথে ক্ষুধার আগ্রহকে কমিয়ে দেয়। এভাবে নিয়মিত নিকোটিনের প্রভাবে ব্যক্তির মস্তিষ্ক পরিবর্তিত হতে থাকে। ব্যক্তির অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটায়। যা ধীরে ধীরে উইথড্রয়াল সিম্পটোমের দিকে প্ররোচিত করতে থাকে। এই সিম্পটোমের ফলে কিছু মারাত্নক লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন-অবসাদ, বমির ভাব, ক্ষুধায় অনীহা, বিরক্তি অনুভব করা, কাজে অমনোযোগ, ঘুমের সমস্যা, ঘাম বেড়ে যাওয়া, পেশীতে ব্যাথা ইত্যাদি। এইসব লক্ষণ ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে প্রায় সবক্ষেত্রেই একই কান্ড দেখা যায়। এই সব থেকে বাঁচতে ব্যক্তি ফের সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়ে।

২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং নারীর মস্তিষ্কের আয়তন যথাক্রমে ১২৬০ ঘন সে.মি এবং ১১৩০ ঘন সে.মি। যত বেশি সময় ধরে কেউ ধূমপান করে তত দ্রুত তার মস্তিষ্কের আয়তন কমতে থাকে। এর কারণ হচ্ছে মস্তিষ্কের কোষ এবং টিস্যুর সংকোচন বা শুকিয়ে যাওয়া। ধূমপান মস্তিষ্কের সাব-কর্টিকাল অংশে প্রভাব ফেলে।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, ৩০ বছর ও তদূর্ধ্ব ব্যাক্তিদের মধ্যে তামাকজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। তামাকসেবীদের মধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, যক্ষা, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ প্রধান সাতটি রোগের ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি। আর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ১০৯ শতাংশ বেশি ঝুঁকি থাকে। ১৫ বছরের কম বয়সী ৪ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত নানান রোগে ভুগছে। যাদের মধ্যে আবার ৬১ হাজারের বেশি শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বিশ্বে প্রতি বছরে কম করে ৮ লক্ষ মানুষ মারা যায় শুধুমাত্র তামাকজাত দ্রব্য সেবন করে। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জনের মৃত্যু হয়। পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ঘরের ভেতরের দূষণের অন্যতম কারণ এই সিগারেট। ধুমপায়ীদের প্রতি দু’জনের এক জন তার নির্ধারিত আয়ুর প্রায় ১৪ বছর আগেই মারা যায়। তবে আশার দিক হলো; আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে সরকার বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপও হাতে নিয়েছে।

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, ‘ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়ের কারণে বর্তমান সমাজে তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন নেশায় ঝুঁকে পড়েছে। তারমধ্যে তামাকের নেশা অন্যতম। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য অভিভাবকসহ আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে’।

আরও পড়ুন...