আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৪ অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। তবে এ অধ্যাদেশে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে শাস্তির সুপারিশের বিধান রাখা হয়নি।
বুধবার (২০ নভেম্বর) সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে খসড়াটি অনুমোদন দেয়া হয়। এটি গেজেট আকারে প্রকাশের পর আইনে পরিণত হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর সংজ্ঞা যুগোপযোগীকরণ, অপরাধের দায় নির্ধারণ, অডিও ও ভিডিও’র মাধ্যমে বিচারকাজ ধারণ ও সম্প্রচার, বিদেশি কাউন্সেলের বিধান, বিচারকালে অভিযুক্তের অধিকার, অন্তর্বর্তীকালীন আপিল, সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা-সংক্রান্ত বিধান, তদন্তকারী কর্মকর্তার তল্লাশি ও জব্দ করার বিধান, পর্যবেক্ষক, সাক্ষীর সুরক্ষা, ভিকটিমের অংশগ্রহণ ও সুরক্ষার বিধান সংযোজন করে সংশোধনীর খসড়াটি করা হয়েছে।
সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৭৩ সংশোধন করা হয়েছে। আমরা এটার প্রয়োজন অনুভব করেছি। কারণ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এ আইনে যখন বিচার করা হয় তখন এ আইনটির ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে অনেক সমালোচনা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেছে। আমরা যেহেতু একটা স্বচ্ছ বিচার করতে চাই সে তাগিদ থেকে সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা যতটা সম্ভব মানুষের মতামত নিয়েছি। আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ অনেকের মতামত আমরা গ্রহণ করেছি। এরপর আমরা দেশি-বিদেশি আইনজীবীদের কাছেও সেগুলো পাঠিয়েছি। সকলের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি ড্রাপ্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করা হয়েছে। সেখানে এটা গৃহীত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তাবিত সংশোধনে বলা হয়েছে- কোনো সংগঠনকে যদি শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন মনে করে তাহলে ট্রাইব্যুনাল শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করতে পারবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বলা হয়েছে আমরা এ বিচারকে অন্যকোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাই না। রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন এলে এ আইনকে অযথা প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না। আমরা একদম ডিসেন্ট ও ফেয়ার ওয়েতে বিচারটা করতে চাই। এজন্য বিধানটা বাতিল করা হয়েছে।
কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠন তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্য যদি নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হয় বা নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে সমাজে। তাহলে আমাদের অন্যান্য আইন রয়েছে সন্ত্রাসদমন আইন, নির্বাচনী আইন-১৯৭৮ পলিটিক্যাল পার্টি অর্ডিনেন্সেও রয়েছে। কাজেই এখানে বিধানটা নেই বলে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ থাকলো নাÑ সেটা না। কিন্তু অন্যান্য প্রচলিত আইন দেশে রয়েছে সেটা আমরা রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে জনদাবি বিবেচনা করা হবে। এটা আইনের ভেতরে অন্তর্ভুক্তের বিষয় না।
আসিফ নজরুল বলেন, এ আইনে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। সেটা হচ্ছে- ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটি ও জেনোসাইডের সংজ্ঞায়। একদম আন্তর্জাতিক স্ট্যাটাস মেইন্টেইন করে আমরা ডিফাইন করেছি। এছাড়াও এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে- অভিযুক্ত পক্ষকে প্রসিকিউশনের সমান সুযোগ দেয়া হয়েছে। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে যেখানে প্রসিকিউশনকে অনেক সুবিধা দেয়া হয়েছিল। এবং ভিকটিম প্রটেকশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা করলে বিচার কার্যটা অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ড করতে পারবেন। ওনারা প্রচার করতে চাইলে সেটা প্রচারও করতে পারবেন। তবে পক্ষগুলোর ডিগনিটি তারা নিশ্চিত করবেন।
তিনি বলেন, আমরা ডেফিনেশনটা ক্লিয়ার করেছি। তিন ধরনের বাহিনীকে বিচারের আওতায় আনার বিধান করা হয়েছে। একটা হচ্ছে- ডিসিপ্লিন ফোর্স, ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি আরেকটা হচ্ছে- অক্সেলিয়ারি ফোর্স। এটাকে আমরা খুব ভালো করেই ডিফাইন করেছি। এগুলো যেহেতু উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত হয়েছে সেটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হলে আইনে পরিণত হবে।
এছাড়াও প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স চাইলে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন। আরেকটা চমৎকার বিধান হচ্ছে- অবজারভারের বিধান আছে। আন্তর্জাতিক বা দেশীয় অর্গানাইজেশন চাইলে বিচার সঠিকভাবে হচ্ছে কি না সেটি তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
এ সময় সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আইনে শত শত বছর ধরে এ বিধান রয়েছে, আমরা কোনো নতুন বিধান করিনি। জুলাই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে তাদের শাস্তির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচারই তো শেষ হয়নি, শাস্তি পাবে কীভাবে? কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে।
এছাড়াও সংবিধান সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘু এবং বিশেষ করে আদিবাসী যারা আছেন তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই কেন এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে। আমাদের অন্যান্য কমিশনে তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
সরকারি সাত কলেজের আন্দোলনের বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, তিতুমীর কলেজে যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক। সম্প্রতি এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানাবো তারা যেন কোনো ধরনের উস্কানির মধ্যে না পড়েন।
এতগুলো কমিশন হলেও শিক্ষা কমিশন হয়নি এমন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, কমিশন করা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ। আমরা বেশি কমিশন করলেও অনেকে প্রশ্ন তোলেন।
তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যায় করার প্রশ্নে তিনি বলেন, জনমানুষকে জিম্মি করে, অসহনীয় যানযট সৃষ্টি করে মানুষকে ভোগান্তিকে ফেলে রাতারাতি একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বানিয়ে ফেলা এটা কতটুকু সমীচীন ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ জানাই।
শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, বেতন না দিলে শ্রমিক তো বসে থাকবে না এটা তো স্বাভাবিক। বেক্সিমকো গ্রুপের দুই মাসের বেতন ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আমরা এটা এভাবেই চলতে দিতে চাই না। সেজন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা হবে। অনেকগুলো কারখানা আছে যাদের আর চলমান রাখার বাস্তবতা নেই। যেগুলো রাখা সম্ভব না সেগুলো নিরূপণ করে শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে বন্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এই কমিটি এই প্রস্তাবনা দেবে।
এদিকে উপদেষ্টা পরিষদে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ- ২০২৪’এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। উক্ত আইনের ধারা-৫ অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান, একজন সার্বক্ষণিক সদস্য এবং ৫ জন অবৈতনিক সদস্য সমন্বয়ে মানবাধিকার কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে।