মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, পিবিএ, কানাডা : ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা (MILD) দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সে জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মনে হতে পারে যে এ সবকিছুই ঘটে গেছে রাতারাতি। কিন্তু এই দিনটিকে ইউনেস্কোর কাছে তুলে ধরতে, তাৎপর্য বোঝাতে, বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার যে কত প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতটা কাজ করতে হয়েছে তা অনেকেরই অজানা।
অনেকেই জানেন না মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা সোসাইটি (MLLWS) যে সংগঠনটি ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য কাজ করেছে তা গঠিত হয়েছিল কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে। অনেকেই জানেন না আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবনা এবং অদ্যাবধি বাস্তবায়নে গ্রেটার ভ্যাঙ্কুভারের বাঙ্গালিদের অবদানের কথা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রধান উদ্যোক্তা, প্রস্তাবক রফিকুল ইসলাম ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশী-কানাডিয়ান এই দেশপ্রেমিক মানুষটি স্বদেশ থেকে বহুদূরে থেকেও স্বদেশ ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতেন। তিনিই মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আরেক বাংলাদেশী-কানাডিয়ান আব্দুস সালামসহ ভিন্ন ভাষী ১০ জন ব্যক্তিকে নিয়ে কমিটি গঠন করেন।
১০ সদস্য বিশিষ্ট তৎকালীন কমিটিতে ছিলেন – রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম (ভাষা বাংলা), অ্যালবার্ট ভিনজেন এবং কারমেন ক্রিস্টোবাল ( ট্যাগালগ), জেসন মনির এবং সুজান হগকিন (ইংলিশ), কেলভিন চ্যাও (ক্যান্টোনিজ), রেনাটে মার্টেনস (জার্মান), করুণা জোশী (হিন্দি), নাজীন ইসলাম (কাচি)।
২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা বাঙালিদের জন্য নিয়ে আসে এক অভূতপূর্ব জাগরণ। স্থানীয়ভাবে তো বটেই, আন্তর্জাতিক এবং বৈশ্বিকভাবেও ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারি যেন ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে আসে। সাড়া বিশ্বে বাঙালিরা আরেক নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে বাঙালি হিসেবে এটা আমাদের গর্বের বিষয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার যে বীজ একুশে ফেব্রয়ারি বুনে দিয়েছিল, পরবর্তী প্রজন্মকেও সে ইতিহাস অনপ্রাাণিত করবে। বর্তমানে পৃথিবীতে বাংলাভাষার অবস্থান ষষ্ঠ এবং এই ভাষায় পৃথিবীতে ২৫ কোটি মানুষ কথা বলে।
এদিক থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিসহ পৃথিবীর সকল মাতৃভাষাভাষীদের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি এক অনন্য উপহার। ২০০০ সালে সর্বপ্রথম প্যারিসে ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। সেখানে সম্মানিত অনেক অতিথির সাথে মোঃ রফিকুল ইসলাম এবং তার পত্নী বুলি ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। তারপর থেকে প্রতিবছর ইউনেস্কোর নেতৃত্বে প্রতিটি দেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ভাষাসচেতন সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে ।
উল্লেখ্য যে, ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা সোসাইটি, কানাডা’কে একুশে পদকে ভূষিত করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০১১ সালে রফিকুল ইসলামের ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং দুই বছর পরেই ২০১৩ সালের ২০শে নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রফিকুল ইসলামের মৃত্যুতে শুধুমাত্র (গখখডঝ) নয়, পৃথিবী হারিয়েছে একজন চিন্তাশীল, মুক্তমনা এবং মানবতাবাদী মানুষকে। তিনি আজ এই নশ্বর পৃথিবীতে নেই কিন্তু মানুষ তাকে স্মরণ করে, ভালবাসে, শ্রদ্ধা জানায়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার রফিকুল ইসলামকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘স্বাধীনতা পদক’-এ ভূষিত করেন। তার স্ত্রী বুলি ইসলাম এবং সহযোদ্ধা আব্দুস সালাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাঙালি জনমনে এক প্রনোদনা নিয়ে আসে। অনেক দেশেই মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা সোসাইটির কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কনসেপ্ট নিয়ে বাংলাদেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়াতে ভাষাসৌধ স্থাপন করা হয়। এছাড়া (গখখডঝ)-এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার স্যারী শহরে ২০০৯ সালে নির্মিত হয় কানাডার প্রথম অডিওভিস্যয়াল ভাষাসৌধ ‘লিঙ্গুয়া আকুয়া’। কানাডা সরকারের ‘কালচারাল ক্যাপিটাল অব কানাডা অ্যাওয়ার্ড’ থেকে সিটি অব স্যারী এই ভাষাসৌধ নির্মাণে ১৩০,০০০ কানাডিয়ান ডলার আর্থিক অনুদান দেয়। অন্যান্য অনেক দেশের মতো কানাডাতেও অনেকগুলো ভাষা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে, অনেকগুলো ভাষা বিলুপ্তপ্রায়। এদেশে আদিবাসীদের ৮৯টি ভাষার মধ্যে মোটামুটিভাবে ৮৫টি ভাষা টিকে থাকলেও পুরোপুরি হারিয়ে গেছে অন্য ৪টি ভাষা। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই ৪টি ভাষার মধ্যে ৩টি ভাষাই ছিল ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়। বাকি ৮৫টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষাকে সঙ্কটাপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে আবার ৭টি ভাষাই ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়। ব্রিটিশ কলাম্বিয়াকে বলা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূতিকাগার, উদ্ভবস্থান।
যেহেতু সেখানে এই মৃতপ্রায় ভাষাগুলোকে রক্ষা করা, সংরক্ষণ করা, উন্নীত করা একান্ত জরুরি। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যথার্থ প্রতিফলন এবং বাস্তবায়নের জন্য এ যেন এক পরীক্ষাক্ষেত্র। সংগঠনের জন্য বিষয়টা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ আবার চ্যালেঞ্জিংও বটে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্তর্নিহিত আদর্শ এবং উদ্দেশ্যকে ধারণ করে তাই আমিনুল ইসলাম এক বিশাল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। গত পনের বছর ধরে নিরলসভাবে তিনি স্থানীয় স্যারী সিটিসহ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার স্থানীয়, প্রাদেশিক এবং কানাডিয়ান সরকারের সাথে কাজ করে চলেছেন। আমিনুল ইসলাম এবং তার (MLLWS) টিম ‘বিসি মডেল’ নামে ভিন্নধর্মী একটা মডেল তৈরি করেছেন। মডেলটি দুইটি পর্বে সম্পন্ন।
প্রথম পর্বটি হচ্ছে- দওহঃবমৎধঃরড়হ ড়ভ ওগখউদ (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আত্মীকরণ-যেটা স্থানীয়ভাবে ওগখউ গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যবোধ এবং জনসচেতনতা তৈরি করবে। এই পর্যায়ে ওগখউ আনুষ্ঠানিক ঘোষণাসহ অভূতপূর্ব সহযোগিতা পেয়েছে স্থানীয় গভর্ণমেন্টের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। ২০১৫ সালে কানাডার প্রাদেশিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম সরকারিভাবে স্বীকৃতি আসে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশ থেকে। এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন কানাডার রাষ্ট্রপ্রধান রানীর প্রতিনিধি, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ২৯তম লেফটেন্যান্ট গভর্ণর জুডিথ গুইচন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল ও তৎকালীন আইনমন্ত্রী সুজেন এন্টন।
দ্বিতীয় পর্বটি মূলত ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার স্কুল ডিস্ট্রিক্টগুলোতে ওগখউ বাস্তবায়নের রূপরেখা। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুলকে প্লাাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেখানে ওগখউ এর বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। শিশুরাই মাতৃভাষার বাহক। তাই শিশুদের চেতনায় মাতৃভাষার বিষয়টি প্রোথিত করা জরুরি।
মাতৃভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য, ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে ব্রিৃটিশ কলাম্বিয়ার স্কুলগুলোর বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে এবং পাঠ্যসূচিতে ওগখউ অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। তবে আমাদের লক্ষ্য- ইউনেস্কোর শিক্ষা-২০৩০ ফ্রেমওয়ার্কে ‘বিসি মডেল’কে অন্তর্ভূক্ত করা এবং তার প্রতিফলন ঘটানো। সম্প্রতি মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের চিঠির জবাবে ধন্যবাদ জানিয়ে ইউনেস্কোর ইউনেস্কোর Assistant Director General (ADG/Education) লিখেছেন, “the amount of work undertaken by the Mother Language Lovers of the World Society to raise awareness about mother languages and preserve linguistic diversity in British Columbia and Canada.” Concerning the “B.C. Model” for IMLD implementation, the UNESCO letter urged “to continue efforts locally and globally on IMLD implementation using BC Model.”. বর্তমানে কানাডার ফেডারেল গভর্ণমেন্টের সাথে কাজ চলছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিক এবং সর্বোতভাবে কানাডায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। ইতোমধ্যেই সম্মানিত সিনেটর মাননীয় মবিনা জাফরের ইরষষ ঝ-২৪৭ কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে এনেছে, সেখানে বিলটি দ্বিতীয় দফায় পাশও হয়েছে।
এখন অপেক্ষা শুধু ঝবহবঃব ঝঃধহফরহম ঈড়সসরঃঃবব-এর চূড়ান্ত পর্যালোচনার জন্য। “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা ওয়ার্ল্ড সোসাইটি” মহান একুশ তথা ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’কে বিশ্বায়নের ব্যপারে তাদের কার্যক্রম কানাডাকে অতিক্রম করে বহির্বিশ্বে সম্প্রসারিত করার জন্য দৃঢ় প্রত্যাশি। এই পর্যায়ে তাদের কোনো এক রাষ্ট্রের সহযোগীতা একান্ত প্রয়োজন।
মাতৃভাষা দিবসের উদ্যোক্তারা আশা করে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশি দুতাবাসগুলো যদি তাদেরকে সামান্যতম লজিষ্টিক সহযোগিতা করে, তবে একুশকে বিশ্বায়ন নিতান্তই সময়ের ব্যাপার মাত্র। সুতরাং যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হন্তক্ষেপেই একদা ইউনেস্কো থেকে ওগখউ-এর স্বীকৃতি এসেছিল, সেহেতু তিনি যদি আর একবার প্রবাসের বাংলাদেশের সকল হাইকমিশনকে আমাদের সহযোগীতার জন্য নির্দেশ দেন, তবে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে বিশ্বায়ন বিষয়টাকে আমরা এগিয়ে নিতে যেতে পারবো ইনশাল্লাহ।
লেখক : মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা সোসাইটি, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, কানাডা।
পিবিএ/জেডআই