আমাদের ঈদ উৎসব ও সংস্কৃতি

ঈদ মোবারক

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

ঈদ অর্থ আনন্দ, আর উৎসব বলতে সাধারণত সামাজিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যগত প্রেক্ষাপটে পালিত আনন্দ অনুষ্ঠানকে বুঝায়। ঈদ উৎসব – ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ এবং ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ প্রধানত ধর্মীয় উৎসব। তবে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর ব্যাপক ও বিরাট প্রভাব রয়েছে। কেননা, ইসলাম ধর্ম একটি আন্তর্জাতিক ধর্ম হওয়ায় এবং প্রায় একই সময় সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপিত হওয়ায় এই ঈদের আনন্দ বলা যায় গোটা বিশ^কেই স্পর্শ করে। বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের ইতিহাস এদেশে মুসলমানদের আগমন ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বলা যায় হাজার বছর আগ থেকেই এই দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বি সর্বস্তরের মানুষ স্বস্ফূর্তভাবে ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহ্যিক চেতনায় ঈদ উদযাপন করে আসছে। তাই বলা যায়, আমাদের এই স্বাধীন বাংলায় ঈদ উদযাপনের একটি ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতাও রয়েছে।

তবে ঈদ কোন বল্গাহীন আনন্দ-উৎসবের নাম নয় বা এটি গতানুগতিক কোন উৎসব নয়। যেহেতু এগুলো ধর্মীয় উৎসব, তাই এর সাথে আধ্যাত্মিক ভাব-গাম্ভির্যের বিষয় জড়িত।

সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনবোধ ও বিশ্বাসের প্রতিরূপ যা তার আচরণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতি হল মার্জিত জীবনাচার। তবে একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কতটা শিষ্ট ও মার্জিত হবে তা নির্ভর করে তার জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ঋদ্ধতার উপর। কেননা, মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ভাবনা বা ভাল-মন্দের বোধ। মানুষের জীবনবোধের বিন্যাসে এবং একটি জাতির মানস গঠনে ধর্মেরও একটি বিরাট ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কেননা, ধর্ম জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটি বিশিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস প্রদান করে। কাজেই ঈদ উৎসবে ধর্মীয় আদর্শের একটি প্রভাব থাকা স্বাভাবিক এবং যারা ইসলামের ধর্মীয় আদর্শকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তাদের উচিত বল্গাহীন উল্লাসে গা ভাসিয়ে না দিয়ে ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্যকে স্মরণে রাখা এবং তাকে অনুসরণ করা।

ঈদুল ফিতর

ঈদুল ফিতরের প্রচলন কীভাবে হলো এ বিষয়ে নানান জনে নানান মত প্রকাশ করলেও পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ইসলাম ধর্মের যাবতীয় বিধি-বিধান এবং জ্ঞানের মূল উৎস হলেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। নামাজ, রোজা, হজ¦, যাকাত ইত্যাদি বিধানের মত এই ধর্মের অনুসারীদের জন্য দুটি প্রধান উৎসব পালনের নির্দেশদাতাও হলেন আল্লাহ তায়ালা। পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর যে ঈদ আমরা পালন করি তার সুস্পষ্ট নির্দেশদাতা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। যেমন:

‘হে লোক সকল, তোমাদের কাছে তোমাদের আল্লাহ’র কাছ থেকে নসিহত (কোরআন) এসে পৌঁছেছে; এতে রয়েছে অন্তরের রোগের পূর্ণ নিরাময়; আর যে তা কবুল করবে তার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে পথনির্দেশ এবং রহমত। (হে নবী) বল: এটা আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এই প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। এজন্য তো লোকদের আনন্দ-উৎসব করা উচিত। এটা সেসব থেকে উত্তম, যা লোকেরা সংগ্রহ ও আয়ত্ত করে থাকে।- [সূরাহ ইউনুস: আয়াত ৫৮]

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পবিত্র রমজান মাসে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেন। আল কোরআন হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র ঐশীগ্রন্থ যা তার অকৃত্রিম, অবিকৃত ও আসল রূপে বিদ্যমান। মানব জাতির জন্য এটি এক বিরাট ঘটনা এবং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। কারণ, এই ঐশীগ্রন্থের কল্যাণেই আমরা ¯্রষ্টার সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ পেয়েছি। তাই এই মহাগ্রন্থের অবতীর্ণ উপলক্ষেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের নির্দেশে মহানবী (সা.) মুসলমানদের জন্য দুটি উৎসব পালনের ঘোষণা দেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক জাতিরই উৎসব রয়েছে, আমাদের উৎসব হলো ঈদ।’’

ঈদুল ফিতরকে বলা হয় রোজা ভাঙ্গার দিন। এদিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ বরং রোজা ভাঙ্গা বাধ্যতামূলক। দীর্ঘ এক মাস আমরা আমাদের পরম প্রভুর নির্দেশে দিনের বেলা সকল ধরনের পানাহার সহ অন্যসব নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছি। আবার তাঁরই নির্দেশে রোজা ভাঙছি। দীর্ঘ এই এক মাস দিনের বেলা পানাহার বন্ধ রেখে এদিন রোজা ভাঙ্গার আনন্দই ঈদুল ফিতর। ফিতর অর্থ ভাঙ্গা। ঈদুল ফিতর অর্থ তাই রোজা ভাঙার আনন্দ। তবে এই আনন্দ তারাই উপলব্ধি করে থাকেন যারা পুরো রমজান মাস জুড়ে রোজা রাখেন। যারা সারা মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের চেষ্টা করেছেন তাদের নিকট বরং ঈদ হলো পাপমুক্তির আনন্দ। সফলতা ও বিজয়ের আনন্দ। এ বিজয় নাফসের ওপর আকলের, এ বিজয় শয়তানের ওপর ইনসানের।

ঈদুল ফিতরের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো ফিতরা আদায় করা। এটি প্রদান করা প্রত্যেক স্বচ্ছল মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিৎরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিৎরা আদায় করা যায়। ফিৎরার ন্যূনতম পরিমাণ ইসলামী বিধান অণুযায়ী নির্দ্দিষ্ট। সাধারণত ফিৎরা নির্র্দিষ্ট পরিমাণ আটা বা অন্য শস্যের (যেমন: যব, কিসমিস) মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। সচরাচর আড়াই সের আটার স্থানীয় মূল্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম ফিৎরার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। পরিবারের সবার পক্ষ থেকে পরিবার প্রধান এটি আদায় করে থাকেন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন রোজা শুদ্ধ হয়, অন্যদিকে সমাজের গরীব অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়। রোজার মাসে অনাহারে থেকে আমরা অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের দূঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি এবং তাদের প্রতি সহানুভূতির শিক্ষাই লাভ করেছি। ঈদের আগে রমজান মাসে যাকাতও আদায় করতে হয়। এই পবিত্র মাসে দান-খয়রাত করলে অন্য সময়ের তুলনায় ৭০ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। ফলে দেখা যায় সাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠার আগেই যাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত ইত্যাদির উসিলায় ধনীর পকেটের কিছু টাকা গরীবের হাতে যায়। এর ফলে গরীবের মুখেও কিছুটা হাসি ফোটে এবং ঈদ অনেকটা সার্বজনীন হয়ে ওঠে। যদি এসব ব্যবস্থা না থাকতো তাহলে ঈদের আনন্দ শুধু ধনীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো আর গরীবরা থাকতো বঞ্চিত।

আসলে ঈদুল ফিতরের আনন্দ-উৎবের সাথে সিয়াম সাধনার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি আমাদের প্রধান ঈদ উৎসব ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় শিক্ষা ও তাৎপর্যের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব, একটি সুস্থ ও কল্যাণমুখি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে তা বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা ও কোরআন তিলাওয়াত-অধ্যয়ন ও ইবাদত-উপাসনার রোজাদার স্রষ্টার নৈকট্য অনুভব করেন। এর ফলে তাদের মন আগের তুলনায় অনেক নরম হয়, আত্মশুদ্ধির জন্য এই জিনিসটির কোন বিকল্প নেই। আমরা অনেকেই সমাজ বদলের কথা বলি, দিন বদলের কথা বলি। কিন্তু দিন বদলের জন্য সবার আগে যে দিল বদলের প্রয়োজন সে কথাটি ভুলে যাই। মাহে রমজান কিন্তু এই দিল বদলের শিক্ষা ও সুযোগ নিয়েই আমাদের মাঝে হাজির হয়।

তাই দেখা যায়, এই সময় মুসলমানরা আপনাকে নিয়ে বিভোর থাকার পরিবর্তে গরীব আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর নেন, নিজের পরিবারের পাশাপাশি তাদের জন্য কেনাকাটা করেন, সারা বছর খোঁজ না নিলেও ঈদের সময় মা-বাবা, ভাই-বোন সহ আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদ করার জন্য গ্রামের বাড়ীতে ছুটে যান। সকল মান-অভিমান, ঝগড়া বিবাদের কথা ভুলে ঈদের নামাজের পর একে অন্যকে আলিঙ্গন করেন, কোলাকুলি করেন।

চাঁদ দেখা

শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফিতর হলেও এর প্রস্তুতি শুরু হয় আগের দিন চাঁদ দেখার মাধ্যমে। কেননা, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তি ও শাওয়ালের প্রারম্ভ গণনা করা হয়। ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামী পরিভাষায় লাইলাতুল জায়জা (অর্থ: পুরস্কার রজনী) এবং চলতি ভাষায় “চাঁদ রাত” বলা হয়। শাওয়াল মাসের চাঁদ অর্থাৎ সূর্যাস্তে একফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ হয়, এই কথা থেকেই চাঁদ রাত কথাটির উদ্ভব। ঈদের চাঁদ স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈদের ঘোষণা দেয়া ইসলামী বিধান। এই চাঁদ দেখাও ঈদ সংস্কৃতির একটি অংশ। তবে প্রথম দিন চাঁদ দেখা না গেলে পরের দিন রোজা ৩০টি পূর্ণ হয়ে গেলে রমজান মাসের সমাপ্তি হবে। কারণ এই মাস ৩০ দিনের বেশি নয়।

চাঁদ দেখা গেলে আর তারাবীহ পড়তে হয় না। তবে রমজান মাসের শেষ রাতটিতে মাগফিরাতের বিশেষ সুযোগ থাকায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এই রাতটিতেও নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও নেক আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেন।

ঈদের নতুন চাঁদ দেখার সাথে সাথে মুসলিমদের মনে যে আনন্দের ঢেউ ওঠে তা অনন্য। এই চাঁদ যেন খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় মুসলিম জনপদে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মনে ঈদের চাঁদ অপরিসীম আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। অনেকে এই সময় খুশিতে আতশবাজি পোড়ায়। সেই সাথে ঘরে ঘরে টেলিভিশনে বেজে ওঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান-

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয়ে মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।

ঈদের নামাজ

ঈদের দিনের প্রধান কাজ হলো সকালে ঈদের নামজ পড়া। তার আগে চুল-গোফ-লোম ও নখ কেটে, দাঁত ব্রাশ করে গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয়ে সাধ্য মত নতুন বা পরিষ্কার সুন্নতি পোশাক বা পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি পড়ে সুগন্ধি মাখতে হয়। তবে চুল কাটার কাজ আগের দিন সেরে ফেলতে পারলেই ভাল। চাঁদ রাতে ঘুমানোর সময় চোখে সুরমা দেয়া সুন্নত।

ঈদের দিন নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সেমাই, পায়েস বা অন্য কোন মিষ্টান্ন খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে হয়। ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়া সুন্নত। যদি সম্ভব না হয় তাহলে মসজিদে পড়া হয়। আবার একপথে যেয়ে আরেক পথে আসতে হয়। সেই সাথে মনে মনে আল্লাহু আকবার তাক্ববির পড়তে হয়। এসবই সুন্নত। ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়াও সুন্নত।

ঈদের নামাজ দুই রাকাত, ছয় তাকবিরের সাথে পড়তে হয়। ফযরের নামাযের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাযের সময় শুরু হয়। এই নামায আদায় করা ওয়াজিব। ঈদের দিন ইমাম সাহেব মুসল্লিদের উদ্দেশে খুৎবা দেন। তবে ঈদের খুতবা দেয়া হয় নামাজের পরে। খুতবা শোনা ওয়াজিব। সাধারণত: ঈদের নামাজের পরে মুসলমানরা সমবেতভাবে মুনাজাত করে থাকেন এবং একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করে ঈদের সম্ভাষণ বিনিময় করে থাকেন। ঈদের বিশেষ শুভেচ্ছাসূচক সম্ভাষণটি হলো, “ঈদ মুবারাক”। ঈদের দিনে আত্ম-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে, পাড়া প্রতিবেশিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়, একসাথে খেতে হয়। এদিন মৃত আত্মীয় স্বজনদের কবর জিয়ারত করা উত্তম।

ঈদের দিনে ছোটরা বড়দের সালাম করে সালামি গ্রহণ করে। তবে এর ধর্মিয় কোন বাধ্যবাধকতা বা রীতি নেই।
ঈদের দিনে সবচেয়ে প্রচলিত খাবার হলো সেমাই। এছাড়া বিশেষ আরো অনেক ধরনের খাবার ধনি গরিব সকলের ঘরে তৈরী করা হয়। এ উৎসবের আরো একটি রীতি হল আশেপাশের সব বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়া। এবং প্রত্যেক বাড়ীতেই হালকা কিছু খাওয়া। এ রীতি বাংলাদেশে সবাইই মেনে থাকে।

বাংলাদেশ সহ অন্যান্য মুসলিম-প্রধান দেশে ঈদুল ফিতরই হলো বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব। বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে সারা রমজান মাস ধরে সন্ধ্যাবেলা কেনাকাটা চলে। অধিকাংশ পরিবারে ঈদের সময়েই নতুন পোশাক কেনা হয়। পত্র-পত্রিকাগুলো ঈদ উপলক্ষে ঈদ সংখ্যা নামে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ঈদের দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিন বিশেষ অণুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে। ঈদের দিন ঘরে ঘরে সাধ্যমত বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের শহরগুলো হতে ঈদের ছুটিতে প্রচুর লোক নিজেদের আদি নিবাসে বেড়াতে যায়। এ কারণে ঈদের সময়ে রেল, সড়ক, ও নৌপথে প্রচ- ভীড় দেখা যায়।

এক সময় ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ঈদকার্ডের একটি বিরাট ভূমিকা ছিল, তবে বর্তমানে ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবের কারণে ঈদ কার্ডের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে।ঈদের আনন্দ নির্মল, পবিত্র এবং অত্যন্ত মধুময়। ঈদ উপলক্ষে যখন নিজ নিজ গৃহে আত্মীয়জন পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব একে অপরকে দাওয়াত দেয়, পরস্পরে শুভেচ্ছা বিনিময় করে, একে অপরকে উপহার সামগ্রী আদান-প্রদান করে তখন ঈদের আনন্দ আরও মধুময় হয়ে ওঠে। সুদৃঢ় হয় সামাজিক বন্ধন। মনের মধ্যে জমে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ ও তিক্ততা দূর হয় পারস্পারিক ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও সম্মানবোধ জাগ্রত হয়। জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে বয়ে যায় শান্তির সুবাতাস যা প্রভাতের আলোর মতই স্বচ্ছ, নির্মল ও নিষ্কলুষ।

তবে আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই ধর্মের প্রকৃত স্পিরিটকে ধারণ করতে পেরেছি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের ধর্মের মৌলিক ইবাদত গুলোকে নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছি। রমজান মাস কোরআনের মাস হলেও আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই এই সময়ে কোরআন অধ্যয়ন করি। আবার আমাদের তারাবির নামাজগুলোতে যে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে কোরআন তেলায়াত করা হয় তাতে আসলে আল্লাহর কালাম নিয়ে এক ধরনের তামাশাই করা হয়। এ কারণেই দেখা যায় রমজান মাসেও আমাদের চেতনার খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না। বরং দেখা যায় শুধু শুধু জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। অথচ পবিত্র রমজান মাস হলো সিয়াম-সাধনার মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। আত্মসমালোচনার মাস। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেশাবের (আত্মসমালোচনা) সাথে সিয়াম পালন করবে তার পূর্বের ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ আমরা রোজা রাখি ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে এই আত্ম-সমালোচনাটা নাই। এ কারণেই আমরা রোজাও রাখি আবার মিথ্যা কথাও বলি। অনেককে তো এও দেখা যায় যে, সারাদিন রোজা রাখে, কিন্তু নামাজ পড়ে না। এর কারণ কী?

কারণ ঐ আনুষ্ঠানিকতা। ধমের স্পিরিট বা চেতনার চেয়ে লেটারটাকেই তারা বড় করে দেখছে। এ কারণেই রোজার নামে তারা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে মাত্র, সিয়াম সাধনা নয়, আত্মশুদ্ধি বা আত্ম-সমালোচনা নয়। এসব যদি থাকতো তাহলে রমজানে জিনিস-পত্রের দাম বাড়ানোর প্রশ্ন আসতো না। অথচ মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথা কাজ পরিত্যাগ করতে পারলো না, তার শুধুমাত্র পানাহার পরিত্যাগে আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই।’

এ কারণেই রমজানের যে কাক্সিক্ষত প্রভাব আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে, আমাদের নৈতিক চরিত্রে পড়ার কথা তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি না। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা রমজান শেষেই পাই। কারণ মসজিদগুলোতে সেই উপচে পড়া ভীড়, সেই মৌসুমী মুসল্লিদের আর দেখা যায় না। রমজান মাসে যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, রমজান শেষে তাদের অনেককেই আর নামাজ পড়তে দেখা যায় না। এরও কারণ ঐ আনুষ্ঠানিকতা।

ঠিক একই কারণে আমাদের ঈদ উৎসবগুলোতেও ধমের প্রভাব খুব একটা দেখা যায় না। যদিও আমাদের দুটি উৎসবই প্রধানত ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু এ দুটি উৎসবই বর্তমানে প্রধানত লৌকিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। যার কারণে এই উৎসব গুলোর যে সার্বজনীন আনন্দ, এগুলোর যে মাহাত্ম-সৌন্দর্য, তা অনেকটা ম্লান হতে বসেছে। একদিকে উপচে পড়া প্রাচুর্য আর অন্যদিকে অনাহারি মানুষের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। কারণ জাহেলী যুগের মতই এসব উৎসব এখন নিষ্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। লক্ষ টাকা দামের শাড়ি আর ঈদের এক মাস আগ থেকেই নগরীর বড় বড় মার্কেটগুলোতে উপচে পড়া ভীড় মূলত ভোগবাদের লক্ষণ। মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পারিক মমত্ব ও সহানুভূতির এ উৎসব এখন পরিণত হয়েছে অনেকটা ভোগ ও পাশবিক উল্লাসে, যা মূলত কেন্দ্রিভুত থাকছে সমাজের ধনিক শ্রেণীর মধ্যে। যে স্পিরিট নিয়ে যাকাত দেয়ার কথা ছিল তার কিছুই আমরা লক্ষ করছিনা; বরং আমরা দেখছি ধনীর বাড়ীতে তথাকথিত যাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে প্রতি বৎসরই পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষ। অথচ দারিদ্র বিমোচনে যাকাত পালন করতে পারে বিরাট ভূমিকা। এ কারণেই বোধ হয় হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর একটি কবিতায় বলেছিলেন-

ঈদ আসেনি তাদের তরে, যারা পড়েছে নতুন বেশ
খোদার ভয়ে পূর্ণ যে মন, তারই তরে ঈদের রেশ।

আরও পড়ুন...