রফিকুল ইসলাম সবুজ: নতুন বছর। স্কুলে স্কুলে বই উৎসব। দুরন্ত শৈশব; নতুন স্বপ্নে নতুন দিন। নতুন বইয়ের গন্ধে উদ্ভাসিত কোমলপ্রাণ। অথচ ব্যতিক্রম ইটভাটা শ্রমিকদের সন্তানরা। ভাটায় ইটের সাথে, মা-বাবার সাথে যেন তারাও পুড়ছে। বইয়ের অভাবে বাংলাদেশে এখন আর কোনো শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম বিঘিœত হয় না, এমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত ভাটা শ্রমিকদের সন্তানেরা। বিশ্বে বিনামূল্যে এত বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবই সরবরাহের দৃষ্টান্ত বিরল হলেও ছোঁয়া লাগেনি ভাটা শ্রমিকদের সন্তানদের ক্ষেত্রে। ইটভাটার দূষণ, হুমকিতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। তবুও থেমে নেই ইটভাটা। ইটভাটা দুষণ ও পরিবেশ হুমকির মুখে হলেও আরেকটি বড় বিষয় আছে যা সকলের চোখ এড়িয়ে গেছে। তবে বিষয়টি এড়ায়নি ফোজিত শেখ বাবুর চোখে।
আর তা হলো ভাটা শ্রমিকদের সন্তানদের লেখা-পড়া। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের সন্তানেরা। যা দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিকর একটি দিক। সহস্র শব্দ যতটা না পারে, একটি আলোকচিত্র পারে তারচেয়ে বেশি কথা বলতে। এমনই অসংখ্য আলোকচিত্রে ফোজিত শেখ বাবু তুলে ধরেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুতর এক অসঙ্গতি। শিশুসন্তান কোলে অসংখ্য নারী কাজ করছেন। ক্ষুধায় কাতর সন্তানের চোখের পানি মায়ের ঘামে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, যা আবার নিমেষেই বাতাস হয়ে উড়ে যাচ্ছে ভাটার আগুনের আঁচে। শিশুর বিকাশের ন্যূনতম পরিবেশই যখন জোটেনি ভাটা শ্রমিকদের সন্তানদের কপালে, শিক্ষাতো দূরের কথা। মূলধারার বাইরে নিরক্ষর বেড়ে ওঠা এই শিশুরা আমাদের লজ্জাজনক অক্ষমতা। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপির রিপোর্ট অনুয়ায়ী দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার।
যদিও এর প্রায় ৫০ ভাগই অবৈধ। আর এই পুরো ৭ হাজার ইটভাটা শ্রমিকের সন্তানই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শীতের প্রথম থেকে বছরের প্রায় ছয় মাস ভাটা শ্রমিকরা ভাটায় কাজ করে। দেশের প্রায় ভাটাগুলোর আশেপাশে ঝুপরি করে শ্রমিকরা থাকে। কাজ শেষ হলে তারা যখন গ্রামে ফিরে যায় তখন বছরের অর্ধেক শেষ। আর এমন সময় কোন স্কুলে ভর্তি নেয়া হয় না। এমতা অবস্থায় সরকারি বা বেসরকারি কোন এনজিও বা সংস্থা তাদের পাশে দাঁড়ালে শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো না। ইটভাটার পাশেই মালিকপক্ষ একটি বড় ঘর করে দিলে আর সেখানে দেশী বা বিদেশী সহায়তায় শিক্ষা কার্যক্রম চললে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বড় একটি অংশ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।
আশির দশকের মধ্যভাগে বইয়ের অভাবে পড়াশোনার পাঠ চুকাতে হয়েছিল ফোজিত শেখ বাবুকে। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের আমূল বদলে যাওয়া এ চিত্র প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে তাকে। তিনি গভীর আবেগ থেকেই শিক্ষায় বাংলাদেশের সফলতার বার্তা তার আলোকচিত্রের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ইটভাটা শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষার দাবিতে ফোজিত শেখের এই প্রদর্শনী একান্তই ব্যক্তিগত প্রয়াস।
সীমিত সামর্থ্যে বাংলাদেশের সংকট ও সাফল্য তুলে ধরার উদ্যোগ ফোজিত শেখ বাবুর এটিই প্রথম নয়। তার প্রথম আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘স্টপ দ্য ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এ বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা শুধু তুলেই ধরেননি, বিপন্ন প্রকৃতিকে রক্ষায় সচেতন হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। তার দ্বিতীয় প্রদর্শনী ‘বাঁচাও নদী শীতলক্ষ্যা’ কলকারখানার রাসায়নিক শিল্পবর্জ্যে নদীদূষণের আত্মঘাতী প্রবণতা সম্পর্কে সতর্ক করার প্রয়াস।
এ প্রদর্শনী জাতীয় জাদুঘরের পর নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যার তীর ও চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেসে আয়োজিত ‘বাঁচাও নদী বুড়িগঙ্গা’ আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে বুড়িগঙ্গাকে দখল ও দূষণমুক্ত করার দাবি জানান। তার আলোকচিত্র প্রদর্শনী শিক্ষায় সফলতামূলক ‘দুরন্ত শৈশবে বই-আনন্দ’ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্যারিসের সৌন্দর্য নিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ‘প্যারিস কেন সুন্দর?’ শীর্ষক স্লাইড সো করে সকলের প্রশংসা কুড়ান ফোজিত শেখ বাবু।
তারপর যুক্তরাজ্যের এইজ হিল ইউনিভার্সিটি ও শিল্পকলা একাডেমি লন্ডনে পৃথকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণহত্যার প্রতিবাদ এবং বিচারের দাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী হু আর দ্যা নিউ ‘বোট পিপল’? করে বিশ্ব সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি বিশাল বার্তা পৌছে দেন। পরপরই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পুনর্বাসনের দাবিতে কানাডার টরেন্টোর ডাউন টাউন মেট্রো হলসহ ৪টি স্থানে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রায় ৩০টি আলোকচিত্র নিয়ে ইটভাটা শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষার দাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘আমরা শিক্ষা চাই’। আলোকচিত্র দিয়ে সহযোগিতা করছেন রেহেনা আক্তার-ফটোসংবাদিক ইত্তেফাক, আবুল হোসেন-ফটোগ্রাফার ও গোলাম কিবরিয়া সাইমুন-ফটোগ্রাফার ।
পিবিএ/বিএইচ