মুমিন জীবনের সর্বত্র সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা আস্থা-ভরসা রাখা একান্ত অপরিহার্য। কারণ আল্লাহর ওপর ভরসা তাওহিদের পর সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ। এটি তাওহিদের প্রাণ ও ভিত। কোনো কাজে প্রয়োজনীয় মাধ্যম গ্রহণ করার পর এর পরিণাম আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়ার নাম তাওয়াক্কুল। কর্মহীনভাবে অলস বসে থেকে আল্লাহর ওপর ভরসা করে থাকার নাম তাওয়াক্কুল নয়। এটি স্পষ্ট ভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। এ ধরনের তাওয়াক্কুলের দীক্ষা ইসলামী শরিয়ত দেয় না। রাসুল (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবিদের এমন শিক্ষা দেননি। কোরআনের আয়াত, সাহাবাদের আমল, মুজতাহিদ ইমামদের কর্মপন্থা আর সালফে সালেহিনের অনুসরণীয় নীতি—সব কিছুই এ কথার সাক্ষ্য বহন করে।
আল্লাহর ওপর ভরসা করার বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সুরা তালাকের ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।’
সুরা ইউনুসের ৮৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহর ওপর ঈমান এনে থাকো, তাহলে তোমরা তাঁরই পর নির্ভর করো।’
সুরা মায়িদার ২৩ নম্বর আয়াতে এসেছে, ‘আল্লাহর ওপরই তোমরা নির্ভর করো, যদি তোমরা মুমিন হও।’
সুরা তাওবার ৫১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর আল্লাহর ওপরই মুমিনদের নির্ভর করা উচিত।’ এভাবে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআলা ঈমান ও ইবাদতের সঙ্গে তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর ওপর ভরসা করার প্রতি জোর নির্দেশ দিয়েছেন।
যেমন—সুরা : হুদ, আয়াত : ১২৩; সুরা : মুলক, আয়াত : ২৯; সুরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ৯ ইত্যাদি।
নবী (সা.) সাহাবাদের আল্লাহর ওপর ভরসা করার কী ধরনের পন্থা শিখিয়েছেন, তা বিবৃত হয়েছে এক হাদিসে। ইমরান ইবন হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের ৭০ হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেই লোকগুলো কারা? তিনি বলেন, যারা ঝাড়ফুঁক গ্রহণ করে না… এবং নিজ প্রভুর ওপর ভরসা রাখে। (মুসলিম, হাদিস : ৩২১)
উমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ তাওয়াক্কুল করতে, তাহলে তিনি পাখিদের যেভাবে রিজিক দান করেন, তোমাদেরও সেভাবে রিজিক দান করতেন। পাখিরা অতি প্রত্যুষে খালি পেটে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে বাসায় ফিরে আসে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪৪)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় তুহফাতুল আহওয়াজি নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, বান্দার রিজিক অর্জিত হয় মহান স্রষ্টার দানের মাধ্যমে; শুধু বান্দার প্রচেষ্টায় কখনোই রিজিক অর্জন হয় না।
আরো পড়ুন:মায়ের সেবায় সাহাবি সৌভাগ্যবান হলেন
ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, এই হাদিস এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, রিজিক অন্বেষণের জন্য সাধ্যমতো প্রচেষ্টা ও মাধ্যম গ্রহণ করতে হবে। কর্মবিমুখ হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার নাম আল্লাহর ওপর ভরসা বা তাওয়াক্কুল নয়।
হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘রিজিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে কোনো উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা তাওয়াক্কুলপরিপন্থী নয়। বান্দার তাওয়াক্কুল যত শক্তিশালী হবে এর সুফলও তত বেশি পরিলক্ষিত হবে। এর দ্বারা বান্দা হালাল উপায়ে রিজিক অন্বেষণে অভ্যস্ত হবে। কারণ বান্দা যখন আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করে এবং পৃথিবীতে আল্লাহর ব্যবস্থার অধীন হয়ে উপায় অবলম্বন করে, তখন সে কেবল হালাল উপায়ই অবলম্বন করবে। বান্দা যখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে, এর বিনিময়ে আল্লাহর ভালোবাসা পাবে। সুরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘…যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও ভরসা রেখে হালাল উপায়ে জীবনাচার করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস