কয়েক মাস ধরেই মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতবিরোধ এর অন্যতম কারণ। এতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে আটকে গেছেন বড় বিনিয়োগকারীরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নানা গুজবে দেশের শেয়ারবাজারের পতনপ্রবণতা আরও বেড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক এতটাই দানা বেঁধেছে যে বিএসইসি আশ্বাস দেওয়ার পরও তা কমছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করে এমন কোনো পদক্ষেপ বিএসইসি নেবে না। এমন বার্তা আসার পরও পতন থামেনি। অজানা শঙ্কায় আশা-নিরাশার দোলাচলে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। ফলে কমে গেছে লেনদেনের গতি।
বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটানোর লক্ষ্যে একটি কুচক্রী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে নেতিবাচক গুজব ছড়ায় বাজারে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দেয়। এতে অনেকে কম দামে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ান, যা সার্বিক বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আবার বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ টানা দরপতনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এসব বিনিয়োগকারীর একটি অংশ ২০১০ সালের ভয়াবহ পতনের সময় বড় ধরনের লোকসান দেয়। তাদের একটি অংশ এখন কম দামে শেয়ার বিক্রি করে টাকা অলস ফেলে রাখছেন। তারা নতুন করে শেয়ার না কেনায় বাজারে কমে গেছে লেনদেনের গতি।
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা নিয়ে এক ধরনের মতোবিরোধ দেখা দেয়। যার জেরে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পতনের মধ্যে পড়ে বাজার। শেয়ারবাজারে দরপতন চলার মধ্যেই ১০ নভেম্বর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের তথ্য চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাল্টা চিঠি দিয়ে এ ধরনের তথ্য চাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। ফলে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার তথ্য ছড়িয়ে পড়ে শেয়ারবাজারে। যার প্রভাবে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন হতে থাকে। অক্টোবরে শুরু হওয়া পতনপ্রবণতা চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিতে থাকে। এর মধ্যে বাজারে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ৮ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা নেগেটিভ ইক্যুইটি রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এসব নেগেটিভ ইক্যুইটি শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। শেয়ারবাজারে এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ায় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ান। ফলে বাজারে আবার নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। এ নিয়ে বাজারে গুজব ছড়ানো হয়। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়াকে। ইউক্রেনে হামলা শুরুর পরই জ্বালানি তেলের ব্যারেল একশ ডলারে উঠে যায়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি চক্র শেয়ারবাজারে গুজব ছড়ায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ এই সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। ফলে আতঙ্কিত হয়ে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ লোকসানে শেয়ার বিক্রির চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে বেড়ে যায় পতনের মাত্রা।
এ পরিস্থিতিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি বিএসইসি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। যেটা পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অন্তরায় বলে মনে করে বিএসইসি। তাই স্বল্পতম সময়ে এই নেগেটিভ ইক্যুইটি বিষয়ক সমস্যা সমাধান করা হবে।
আর বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, নেগেটিভ ইক্যুইটি সমন্বয় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যুদ্ধের জন্য শেয়ারবাজারে সূচকের পতন যৌক্তিক নয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ হলেও তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই কম। তাই আমাদের অর্থনীতিতে কম প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত কমিশন নেবে না। সবার আগে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তাই নেগেটিভ ই্ক্যুইটি সমন্বয় নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন বার্তা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে পারছে না। ফলে গত সপ্তাহজুড়েই শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। এই পতনের মধ্যে পড়ে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজগুলোর দাম এক সপ্তাহেই কমেছে ১১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে কমেছে ২৮ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা।
বিশ্বাস নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, ২০১০ সালে অনেক টাকা লোকসান দিয়েছি। ২০১০ সালের সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। এখন যেভাবে দরপতন হচ্ছে, তাতে আবারও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। তাই লোকসান দিয়ে পোর্টফোলিওতে থাকা সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছি। বাজার আবার ভালো হলে তখন কিনবো। আপাতত না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সোহাগ নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, এক মাস আগেও আমার পোর্টফোলিওতে ৫৭ হাজার টাকা লাভ ছিল। কিন্তু দেখতে দেখতে সব শেষ। লাভের টাকা তো গেছেই আসলও নেই। এক লাখ টাকার ওপরে লোকসানে আছি। শেয়ার কেনা দামে আসলে বিক্রি করে দেবো, কয়েকদিন ধরে এমন চিন্তা করছি। কিন্তু আসল দামে তো আসছেই না, বরং প্রতিদিন লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। কবে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবো জানি না।
আব্দুর রাজ্জাক নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, দিন যত যাচ্ছে লোকসানের পাল্লা তত ভারী হচ্ছে। লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি করতে পারছি না, যদি দাম বাড়ে এই আশায় আছি। আসলে এখন যে দরপতন হচ্ছে, এর কোনো যৌক্তিক কারণ আছে? আমার তো মনে হচ্ছে কম দামে সাধারণ পাবলিকের কাছ থেকে শেয়ার কেনার পরিকল্পনায় এমন দরপতন ঘটানো হচ্ছে।
এই বিনিয়োগকারী আরও বলেন, কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজার ও পোর্টফোলিও দেখা ছেড়ে দিয়েছি, যা হওয়ার হবে। আমি লোকসানে শেয়ার বিক্রি করবো না। বাজার কত পড়ে দেখবো।
শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্প্রতি ফেসবুকে এক পোস্ট দিয়ে ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য প্রভাব না থাকলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই অপেক্ষায় আছে কম দামে ভালো শেয়ার কীভাবে কেনা যায়। তবে বাজার তার আপন শক্তিতে ঘুরে দাঁড়াবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে এখন যে দরপতন হচ্ছে তার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। কিন্তু এটাও সত্য আমাদের শেয়ারবাজার কোনো ব্যাকরণ মেনে চলে না। আমাদের বাজারের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী না বুঝে বিনিয়োগ করেন।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আমাদের শেয়ারবাজারে খুব একটা পড়ার কথা নয়। তবে মনস্তাত্ত্বিক একটা প্রভাব আছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটানোর চেষ্টা করছে কি না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির খতিয়ে দেখা উচিত। বাজারে একদিকে পতন হচ্ছে, অন্যদিকে বছরের পর বছর লভ্যাংশ দেয় না, লোকসানে রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ছে।
এ নিয়ে সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মাদ হেলাল উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই ভুল নীতির কারণে বুদবুদ তৈরি হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশেও বুদবুদ ও ধস তৈরি হয়েছিল ভুল পলিসির কারণে। সম্ভবত এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালার ক্ষেত্রে অতিরক্ষণশীল অবস্থানে থাকে, পুঁজিবাজারে সূচক একটু বাড়লেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বাস্তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। বাজারে বেশিরভাগ শেয়ারের মূল্য এখনো যৌক্তিক পর্যায়ের নিচে। গত এক দশকের মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য বিষয় সমন্বয় করা হলে সূচক এমনিতেই সাড়ে ৭ হাজার থাকার কথা, দৈনিক গড় লেনদেন হওয়ার কথা ৩ হাজার কোটি টাকার উপরে।