ইজাজ মিলনের ‘ জন্মান্ধ চোখের মতো শুষ্ক পৃথিবী’র


মেহেদী ধ্রুব, পিবিএ: ইজাজ আহ্মেদ মিলন একধারে কবি, সাংবাদিক ও গল্পকার। তাঁর লেখার প্রধান নিয়ামক দেশ-কাল-সমাজের বহুমাত্রিক অসঙ্গতি, অতৃপ্ত আত্মার চাওয়া-পাওয়ার বৈপ্যরীত্যে বেঁচে থাকার তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণা, ব্যক্তি মানুষের বেদনাবোধ, একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গ্য-বিলাস, সমাজের নিচুতলার মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, তাদের মর্মবেদনা, কখনো দ্রোহী মনোভাব, শরীরী ও অশরীরী প্রেম, কখনো বিরহের আর্তি ও প্রকৃতির নানামাত্রিক অনুষঙ্গ।

‘জন্মান্ধ চোখের মতো শুষ্ক পৃথিবী’ তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ, যেখানে এসব চেতনা প্রতিভাত হয়েছে; যেখাবে প্রাধান্য পেয়েছে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, বেদনাবোধ, প্রেম-বিরহ ও দ্রোহের সেতুবন্ধ। আলোচ্য গ্রন্থে মোট কবিতা আছে ১০০ টি। দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি কবিতা এক পৃষ্ঠার মধ্যে সমাপ্ত হয়েছে, আবার কোনো কোনো কবিতা অর্ধেক পৃষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, বর্তমান সময়ে দীর্ঘ কবিতার বিপরীতে ছোটকবিতার যে ট্রেন্ড দাঁড়িয়ে গেছে কিংবা কখনো কখনো জাপানি হাইকু বা ম্যাক্সিম স্টাইলে যে ধরনের কবিতা লেখার চেষ্টা চলছে বা হচ্ছে ‘জন্মান্ধ চোখের মতো শুষ্ক পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থেও হালের এ ট্রেন্ড প্রতীয়মান।

কবি ইজাজ মিলনের চোখে এ পৃথিবীতে সুখকর কিছু নেই, পৃথিবীর প্রত্যেক পরতে পরতে সমস্যা বাসা বেঁধেছে। এক ফোঁটা পানির জন্য মরুভূমির কোনো প্রাণি যেভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরে, কবির দেখা পৃথিবীর মরুভূমির কোনো প্রাণির মতো, যে প্রাণি পানির অভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করছে, যেখানে কবির পৃথিবী জলহীন, জন্মান্ধ চোখের মতো শুষ্ক। কবির কাছে আরো মনে হয়, এ পৃথিবীর কোথাও নেই বিশুদ্ধতার কোনো উদাহরণ, প্রেম-প্রকৃতির মর্মে মর্মে তীব্র যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতার অনুবাদ।

এ গ্রন্থের কবিতাগুলোর নাম দেখেই এসব বিষয়-আশয় সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু নাম পড়া যাক : নৈঃশব্দের আলিঙ্গন, একমুঠো অন্ধকার, নিরাশা ও দুঃখের প্রাচীর, দুঃখী প্রেমিক, কিছু অন্ধকার, শোকার্ত ভায়োলিন, আমার দীর্ঘশ্বাসে, শূন্যতার মাতম, দুঃস্বপ্নের মিছিল, দীর্ঘ দেহের শূন্যতা, শতাব্দীর নিদ্রাহীন অসুখ, আমার দুঃখগুলো কেমন আছে, দুঃখের মিনার, জীবনের ধূসরতা, শোক বাক্য, দরদের দুঃখগুলো, আমি ফিরে আসি ঘর শূন্য, মৃত্যুর দখলে, দুঃখের নদীতে ভেজাও, তোমার দুঃসময়, সন্ধ্যাগুলো বড্ড একা ও মানচিত্রের দুঃখের রাজ্য নেই।

এভাবে আরো পড়া যেতে পারে, প্রায় সবগুলো নামের মধ্যেই একটা দুঃখবোধ, একটা বেদনাবোধ, একটা দ্রোহ বা প্রেম-বিরহের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। এ নামগুলো পড়লে হয়তো বাংলা সাহিত্যের দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কথা মনে পড়বে; কবিতার দ্রোহ ও প্রেমের কথা পড়লে হয়তো ষাট-সত্তর দশকের কবি নির্মলেন্দু গুণ, শহীদ কাদরী, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লার কথা মনে পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়ার পর মনে হবে এ স্বর, এ সুর একান্তই ইজাজ আহ্মেদ মিলনের।

গ্রন্থ পাঠান্তে পাঠক এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, এ কবিতা যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বা ষাট সত্তর দশকের কবির কবিতা না, এ কবিতা একুশ শতকের এক তরুণ কবির কবিতা, যে কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা কিংবা হয়ে ওঠা বেদনাকে আলিঙ্গন করে, দুঃখের ঠোঁটে চুম্বন করে; কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় যে কবির এ দুঃখ-বেদনা শেষ পর্যন্ত দেশ-কাল-সমাজের সাথে মিশে সাধারণ্যের হয়ে যায়; অর্থাৎ ব্যক্তির বেদনাবোধ, আত্মগ্লানি ও আত্মমর্যাবোধ মানবিক মানুষের একান্ত মনের কথা হয়ে ওঠে।

ইতোমধ্যে উল্লিখিত হয়েছে যে, এ গ্রন্থের কবি দ্রোহ, নিঃসঙ্গতা, প্রেম-বিরহ ও অভিমানের খেয়ায় চড়ে বেড়ান; সেই চড়ে বেড়ানোর দোলায় দোলায়িত হয়ে ওঠে বর্তমান সমাজ বাস্তবতার নগ্নতা, হিংস্ত্রতা ও পাওয়া না-পাওয়ার ইশতিহার ও অজানা দুঃখের প্রহর। প্রসঙ্গত কিছু কবিতার দিকে নজর দেয়া যাক : প্রথম কবিতা ‘নৈঃশব্দের আলিঙ্গন’-এ কবির উচ্চারণ, ‘শিল্পীর তুলিতে আমার দুঃখ আঁকা’। কবির এ দুঃখবোধ ও বেদনাবোধ পুরো গ্রন্থজুড়ে দেখা যাবে, তবে এ দুঃখ সর্বদা যন্ত্রণা দেয় না, সর্বদা পোড়ায় না, কখনো কখনো এ দুঃখ আবিষ্ট করে, এ দুঃখ নিয়ে যায় এক মায়া জগতে, আচ্ছন্ন করে রাখে এক অজানা দুঃখের কুহকে; তবে এ কুহকের মধ্যেও এক ধরনের প্রশান্তি আছে, লীলাময় সৌন্দর্য আছে।

ফলে ক্রমান্বয়ে কবি ইজাজ মিলন আত্মস্বীকারোক্তি ও আত্মবিশ্বাসের সাথে মনের কথা বলে যান। ‘অভিশাপ মিশে গেছে মেঘের পালকে’ কবিতায় কবির প্রেম ও দীর্ঘশ্বাস অভিশাপ হয়ে মিশে যা মেঘের পালকে, সেই পালকের আঁচড়ে কবির হৃদয়ে দহনের দাগ পড়েনি, পচনের চিহ্ন পড়েনি; বরং সেখানে আছে প্রেম ও বোধের আগুনে পুড়ে যাবার দুর্মর আকাক্সক্ষা, আর আছে এক অভিমানী সুর, ‘আমি কাকে অভিশাপ দেবো!’ নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া, প্রেম-ধর্ম-সম্পর্ক ও সংসার-ধর্মের সাথে বোঝাপড়া, কঠোর পরিশ্রমের পরে প্রাপ্য স্বীকৃতি পাবার জন্য আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ লক্ষ করা যায়; ‘কতটা পথ হাঁটলে পথিক হবো’ কবিতায় দেখা যাবে সেই বোধের দৃপ্ত উচ্চারণ, এ ঘুণেধরা সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রের বানানো নিয়মের বিরুদ্ধে কবির সত্য চরণ বা হৃদয়ের আর্তি ও নিদারুণ প্রশ্ন, ‘হে বিচারক ! কতটা পথ পাড়ি দিলে/অবশেষে আমি পথিক হবো?’ প্রচলিত সমাজকে চ্যালেঞ্জ করে কীভাবে টিকে থাকতে হয়, কীভাবে প্রথার বিরুদ্ধ¯্রােতে ভাসতে হয়, কীভাবে নিজের অহম ও ক্রোধের আগুনে পুড়ে সমস্ত দুঃখ-বেদনা ও অনিয়মের মুখোমুখি হতে হয় কবি তা ভালো করে জানেন, আর জানেন বলেই তাঁর সাহসী উচ্চারণ, ‘আজও বেরুতে পারিনি সেখান থেকে/নেভাতে পারিনি কেউ/আমার ক্রোধের আগুন।’

এ ক্রোধের আগুন কখনো শান্তির নদীতে নিয়ে যায় কবিকে, আবার সেই দুঃখের ক্ষত থেকে সৃষ্টি হয় আরেক নদী; কবির ভাষায় ‘এখানে নদী ছিল না কখনো/অথচ এখন লবণাক্ত পানির দখলে/ক্ষত থেকে সৃষ্টি হওয়া একটি নদী।’ সৃষ্ট নদীর বুকে সাঁতার কেটে কবি দেহমনকে শান্ত করেন; কেননা সমস্ত দুঃখ ও যন্ত্রণাকে সহ্য করার অসধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মিয়েছেন; ফলে বেদনার কোনো আগুন তাঁকে ভষ্ম করতে পারে না, বরং সেই আগুনে পুড়ে নিজেকে খাঁটির সোনর মতো পরিশুদ্ধ করেন, হয়ে ওঠেন আরো খাঁটি; কবির ভাষায়, ‘আগুন আমাকে ভষ্ম করে না…আমি তালিম নিই বিশুদ্ধ জীবনের’।

আলোচনায় উল্লিখিত চরণগুলো লক্ষ করলে অনুধাবন করা সহজ হবে যে, কবি ইজাজ আহ্মেদ মিলনের কবিতার ভাষা ও ছন্দ সহজ, সরল ও সাবলীল, যা পাঠককে তৃপ্তি দিবে। সাম্প্রতিক কবিতাচর্চার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, উত্তর-আধুনিক কবিতার নামে প্রায়শই যে দুবোর্ধ্য কবিতা লেখা হচ্ছে বা যে কবিতার চর্চা চলছে, বা যেসব কবিতা লেখার চেষ্টা চলছে, ইজাজ মিলনের কবিতা সেই ট্রেন্ড থেকে ভিন্ন মাত্রায় চলে। এখানে বরং সাবলীল শব্দ, প্রতীক ও স্নিগ্ধ অলংকারের মাধ্যমে দেশ-কাল-সমাজের ক্ষত, ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, একাত্বিবোধ, বেদনাবোধ, প্রেম-বিরহ ও প্রতিবাদের সুর পরিলক্ষিত হয়।

ফলে যেকোনো কাব্যপ্রেমিক মানুষের কাছে ‘জন্মান্ধ চোখের মতো শুষ্ক পৃথিবী’ যে সুপাঠ্য হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন...