ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই লোক দেখানো এবং দুনিয়াবী স্বার্থ পরিহার করে, শুধু মাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ই‘তিকাফ করতে হবে।
ইতিকাফ মানুষকে দুনিয়াবী ব্যস্ততা পরিহার করে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মগ্ন হওয়া শিক্ষা দেয় এবং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। এতে আল্লাহর প্রতি মহববত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআলা তার বান্দার গুনাহ মাফ করিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ দিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এ মাসের শেষ দশকের বরকতময় রজনী ‘লায়লাতুল কদর’ (ليلة القدر) যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সেই রজনী পাবার জন্য ইতিকাফ এক বিশেষ ব্যবস্থা।
ইতিকাফের পরিচয়
ইতিকাফ العَكْفُ ধাতু হতে উৎপন্ন। যা বাবে ইফতি আল এর মাসদার। অর্থ : নিজেকে কোনো স্থানে বদ্ধ রাখা। শারঈ পরিভাষায় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে মসজিদে ইবাদত ও তেলাওয়াতের মধ্যে বদ্ধ রাখাকে ইতিকাফ বলা হয়। (ফিক্বহুস্ সুন্নাহ ১ম খন্ড, (কায়রো, মিশর : দারুল ফাতাহ), পৃঃ ৫৩৯)
আর যে ব্যক্তি এভাবে আবদ্ধ থেকে মসজিদে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে তাকে বলা হয় মুতাকিফ (معتكف) বা আকিফ (عاكف)। (আল-মিছবাহুল মুনীর ২/৪২৪; লিসানুল আরব ৯/২৫২)
ইতিকাফের শারঈ বিধান
ইতিকাফ (الإعتكاف) শরিয়াত নির্দেশিত একটি ইবাদত। আল্লাহ তাআলা বলেন-وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ-
অর্থ: ‘আর আমরা ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, এখানে অবস্থানকারীদের জন্য এবং রুকূকারী ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো’ (সূরা: বাকারা, আযাত: ১২৫)
উল্লেখিত আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইতিকাফের বিধান শরিয়াত সিদ্ধ ও প্রাচীন। বিধায় আল্লাহ তাআলা ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-কে ইতিকাফকারীদের জন্য আল্লাহর ঘরকে পাক-পবিত্র রাখতে বলেছেন।
নবী করিম (সা) প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করেন। এমনকি যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেন। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- يَعْتَكِفُ فِىْ كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِىْ قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ يَوْمًا
অর্থ: ‘রাসূল (সা.) প্রতি রমজান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন’। বুখারি হা/২০৪৪; সহিহ ইবনু খুযাইমা হা/২২২১)
ইতিকাফের উদ্দেশ্য
ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। নিজের গুনাহ মাফ করে নেয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো ইতিকাফ। তাবেঈ মাসরূক (রহ.) বলেন, ব্যক্তির জন্য করণীয় হলো সে এমন কোনো স্থানে একাকী হবে, যেখানে সে নিজের গুনাহ স্মরণ করে তা হতে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (সিলসিলা আসারুস সহিহাহ, আসার নম্বর ৩৪৫) এক্ষেত্রে ইতিকাফ এক উত্তম মাধ্যম। আর এর মাধ্যমে ‘লাইলাতুল কদরকে’ অন্বেষণ করা যায়।
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কদরের রাত অন্বেষণের উদ্দেশ্য তার কাছে স্পষ্ট হবার পূর্বে রমজানের মধ্যেই দশ দিন ইতিকাফ করলেন। দশ দিন অতিবাহিত হবার পর তিনি তাবু তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। অতএব, তা গুটিয়ে ফেলা হলো। অতঃপর তিনি জানতে পারেন যে, তা শেষ দশ দিনের মধ্যে আছে। তাই তিনি পুনরায় তাঁবু খাটানোর নির্দেশ দিলেন। তাবু খাটানো হলো। এরপর তিনি লোকদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে লোক সকল! আমাকে কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল এবং আমি তোমাদের তা জানানোর জন্য বের হয়েছিলাম। কিন্তু দু’ব্যক্তি পরস্পর ঝগড়া করতে করতে উপস্থিত হলো এবং তাদের সঙ্গে ছিল শয়তান। তাই আমি তা ভুলে গেছি। অতএব তোমরা তা রমজান মাসের শেষ দশ দিনে অন্বেষণ কর। (বুখারি হা/২০১৮; মুসলিম হা/১১৬৭)
ইতিকাফের প্রকারভেদ
ইতিকাফ দুই প্রকার। যথা- ১. সুন্নাত ও ২. ওয়াজিব। (ফিকহুস্ সুন্নাহ, ১/৫৪০ পৃঃ)
(১) সুন্নাত: সুন্নাত ইতিকাফ হলো যেটা রাসূল (সা.), তার স্ত্রীগণ এবং সাহাবায়ে কেরাম করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন- اَنَّ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَواَخِرِ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ، ثٌمَّ اِعْتَفَ اَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ-
অর্থ: ‘রাসূল (সা.) মৃত্যু পর্যন্ত রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করেছেন। অতঃপর তার পরে তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন’। (বুখারি হা/২০২৬; মুসলিম হা/১১৭২)
(২) ওয়াজিব: ওয়াজিব ইতিকাফ হলো, যা ইতিকাফকারী নিজের উপর আবশ্যক করে নেয়। যেমন- যদি কেউ কোনো ভালো কাজের উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করার মানত করে তাহলে তার মানত পূরণ করা আবশ্যক। ইবনু ওমর (রা.) বলেন- اَنًّ عُمَر سَأَلَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُنْتُ نَذَرْتُ فِي الجَاهِلِيَةِ أَنْ أَعْتَكِفَ لَيلةً فِي الْمَسْجِدِ الْحَرامِ قَالَ فَأَؤفِ بِنَذْرِكَ
অর্থ: ‘ওমর (রা.) নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি জাহেলী যুগে মসজিদুল হারামে এক রাত ইতিকাফ করার মানত করেছিলাম (আমি কি তা পূরণ করব?) নবী করিম (সা.) বললেন, তোমার মানত পূরণ কর’। (বুখারি, হা/২০৩২)
ইতিকাফের স্থান
মসজিদেই ইতিকাফ করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন- وَلَا تُبَاشِرُوْهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُوْنَ فِي الْمَسَاجِدِ
অর্থ: ‘আর যতক্ষণ তোমরা ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা কর না’ (বাকারা ২/১৮৭)
রাসূল (সা.) মসজিদে ইতিকাফ করতেন। তদ্রূপ তার স্ত্রীগণ মসজিদে ইতিকাফ করেছিলেন। আয়েশা (রা.) বলেন- كَانَ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّم يُصْغِى اِلَى رَاسِهِ وَهُوَ مُجَاوِرُ فِى الْمَسْجِدِ فَأَرَجِّلُهُ وَاَنَا حَائِضٌ
অর্থ: ‘মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় নবী করিম (সা.) আমার দিকে তার মাথা ঝুঁকিয়ে দিতেন আর আমি ঋতুবতী অবস্থায় তার চুল আঁচড়িয়ে দিতাম’। বুখারি হা/২০২৮; মুসলিম হা/২৯৭)
যেকোনো মসজিদে ইতিকাফ করা জায়েয। (সহিহ ফিকহুস্ সুন্নাহ পৃঃ ১৫১) কেননা আল্লাহ তাআলা সাধারণভাবে (فِى المَسَاجِدِ) ‘মসজিদ সমূহে’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৭) উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস এবং হাসান (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে যে, সালাত (তথা জামাত) হয়, এরূপ মসজিদ ব্যতীত ইতিকাফ হবে না। (বায়হাক্বী হা/৮৩৫৫, ৪/৩১৬; বিস্তারিত দ্রঃ মিরআত হা/২১২৬-এর আলোচনা ৬/১৬৪-১৬৬)
ইতিকাফকারীর মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়া
ইতিকাফ স্থলে সূর্যাস্তের পূর্বে প্রবেশ করবে এবং ঈদের আগের দিন বাদ মাগরিব বের হবে। রাসূল (সা) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (বুখারি হা/২০২৫, মুসলিম; মিশকাত হা/২০৯৭)
আর শেষ দশক বলতে শেষ দশ রাত্রিকে বুঝানো হয় (সূরা: ফজর, আয়াত: ২)। আর ২০ তারিখ সুর্যাস্তের মাধ্যমে ২১ তারিখ শুরু হয় এবং ১লা শাওয়ালের চন্দ্রোদয়ের মাধ্যমে শেষ হয়। কোনো কোনো বিদ্বান আয়েশা (রা.) কর্তৃক রাসূল (সা.) ইতিকাফের ইচ্ছা করলে ফজরের সালাত আদায় করার পর তার ইতিকাফস্থলে প্রবেশ করতেন (আবুদাঊদ হা/২৪৬৪, ইবনু মাজাহ হা/১৭৭১) মর্মে বর্ণিত হাদিসটি থেকে ফজরের পর ইতিকাফ শুরুর ব্যাপারে মত প্রকাশ করলেও তার জবাবে ওলামায়ে কেরাম বলেন, রাসূল (সা.) আগের দিন সূর্যাস্তের সময় মসজিদে প্রবেশ করে ফজর পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করতেন এবং এরপর স্বীয় ইতিকাফস্থলে একাকী হতেন। (নববী, শরহ মুসলিম ৮/৬৮, ফিক্হুস সুন্নাহ ২/৪৩৭)
নারীদের ইতিকাফের বিধান
নারীদের জন্য ইতিকাফ করা শরিয়াত সম্মত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর স্ত্রী আয়েশা (রা.) বলেন- أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم ذَكَرَ أَنْ يَعْتَكِفَ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، فَاسْتَأْذَنَتْهُ عَائِشَةُ فَأَذِنَ لَهَا،
অর্থ: ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের শেষ দশদিন ইতিকাফ করবেন বলে উল্লেখ করলেন। তখন আয়েশা (রা.) তার কাছে ইতিকাফের অনুমতি চাইলে তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। (বুখারি হা/২০৪১-৪৫)
তিনি আরো বলেন- اَنَّ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّى اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللهُ، ثٌمَّ اِعْتكَفَ اَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ
অর্থ: ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্য পর্যন্ত রমজান মাসের শেষ দশদিন ইতিকাফ করেছেন। অতঃপর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন’। (বুখারি হা/২০২৬; মুসলিম হা/১১৭২)
অতএব নিরাপদ পরিবেশ ও পৃথক ব্যবস্থাপনা থাকলে নারীরাও ইতিকাফ করতে পারবে।
ইতিকাফ করার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য শর্ত
(ক) স্বামীর অনুমতি: স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নারীরা ইতিকাফ করতে পারবে না। যেমন- আয়েশা (রা.) ইতিকাফের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করছিলেন। তদ্রূপ হাফসাহ ও যায়নাব (রা.)ও অনুমতি চেয়েছিলেন। (বুখারি হা/২০৩৩, ২০৪১-৪৫; মুসলিম হা/১১৭২-৭৩)
(খ) ফিৎনার আশংকা না থাকা: নারীর জন্য ইতিকাফ করা বৈধ হবে না, যদি তার ব্যাপারে কোনো আশংকা কিংবা তার কারণে অন্য কোনো পুরুষ ফিৎনায় পড়ার আশংকা থাকে। সব ধরনের ফিৎনা থেকে নিরাপদ হলে নারীদের ইতিকাফ করা বৈধ হবে। (সহিহ ফিকহুস্ সুন্নাহ পৃঃ ১৫২)
নারীদের জন্য পর্দা দিয়ে মসজিদে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। রাসূল (সা.) এর স্ত্রীগণ যখন ইতিকাফ করতেন তখন মসজিদে তাদের জন্য আলাদা তাঁবু টাঙ্গানো হতো। কেননা মসজিদে পুরুষরা সালাতের জন্য উপস্থিত হয়। তাই মসজিদে নারীদের জন্য এমন স্থান নির্ধারণ প্রয়োজন যেখানে পুরুষরা তাদেরকে দেখতে পাবে না। মূলতঃ নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকাই উত্তম। (ফিকহুস্ সুন্নাহ ল্লিন্নিসা (মাকতাবাতুৎ তাওফিকিয়্যাহ), পৃঃ ২৪৭)
যেসব কাজ করলে ইতিকাফ বাতিল হয়
নিম্নোক্ত কাজের যেকোনো একটি করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। যেমন-
(ক) স্ত্রী সহবাস: স্ত্রী সহবাস করলে ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। (তাফসীরে কুরতুবী, বিদয়াতুল মুজতাহিদ ১/৪৭০; ফতহুল বারী ৪/২৭২; আস-সায়লুল জারার ২/১৩৬)
আল্লাহ তাআলা বলেন- وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ
অর্থ: ‘আর তোমরা স্ত্রীগমন করো না যখন তোমরা মসজিদে ইতেকাফ অবস্থায় থাক’। (সূরা: বাকারা, আয়াত:ধ১৮৭)
(খ) শারঈ ওজর ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হওয়া: ইতিকাফকারী কোনো অবস্থাতেই মসজিদ থেকে বের হবে না। তবে পানাহার, প্রস্রাব-পায়খানা এবং শারঈ কোনো ওজর থাকলে বের হতে পারবে। আয়েশা (রা.) বলেন- كَانَ النَّبِيَ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّم يُصْغِى اِلَى رَاسِهِ وَهُوَ مُجَاوِرُ فِى الْمَسْجِدِ فَأَرَجِّلُهُ وَاَنَا حَائِضٌ
অর্থ: ‘মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় নবী করীম (সা.) আমার দিকে তার মাথা ঝুকিয়ে দিতেন আর আমি ঋতুবতী অবস্থায় তার চুল আঁচড়িয়ে দিতাম’। (বুখারি হা/২০২৮)
তিনি আরো বলেন-
اَلسُّنَّةُ عَلَى المُعْتَكِفِ : اَنْ لاَ يَعٌوْدَ مَرِيْضًا، ولاَ يَشْهَدَ جَنَا زَةً، وَلاَ يَمَسَّ إِمْرَأَةً، وَلا يُبَاشِرَهَا، وَلَا يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ،اِلاًّ لمَا لَابُدَّ مِنهُ، وَلَا اِعْتِكَافَ اِلَّا بِصَوْمٍ، وَلَا اِعْتِكَافَ اِلَّافِى مَسْجِدٍ جاَمِعٍ
অর্থ: ‘ইতিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হচ্ছে, সে কোনো রোগীর সেবা করতে মসজিদ থেকে বের হবে না। কোন জানাজায় উপস্থিত হবে না। স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করবে না। (শারঈ) প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না। সিয়াম ব্যতীত কোনো ইতিকাফ নেই। জামে মসজিদ ব্যতীত কোন ইতিকাফ নেই। (আবু দাউদ হা/২৪৭৩ সনদ সহিহ; বায়হাক্বী ৪/৩১৫)
ইতিকাফকারীর জন্য যা বৈধ
(ক) মসজিদের একাংশে তাঁবু টাঙ্গানো: রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ইতিকাফের ইচ্ছা করতেন তখন আয়েশা (রা.) মসজিদে তাঁবু টাঙ্গিয়ে দিতেন। (বুখারি হা/২০৩৩)
মসজিদের পেছন দিকে ইতিকাফকারী ছোট্ট তাঁবু টানিয়ে সেখানে ইতিকাফ করতে পারবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ইতিকাফ করতেন, তখন আয়েশা (রা.) তার জন্য একটি তাঁবু (خِبَاءٌ) তৈরি করে দিতেন। আর এটি তিনি রাসূল (সা.) এর নির্দেশেই করতেন। (বুখারি, হা/২০৩৩; মুসলিম, হা/১১৭৩) তিনি একবার একটি তুর্কী তাঁবুতে ইতিকাফ করেছিলেন। যার দরজায় একটি চাটাই ঝুলানো ছিল। (মুসলিম, হা/১১৬৭; সহিহ ইবনে খুযায়মা হা/২১৭১, ২২১৯)
(খ) মসজিদে ওজু ও গোসল করা: রাসূল (সা.) এর খাদেম আনাস (রা.) বলেন-تَوَضَّأ النَّبِىُ صَلَّ اللهُ علَيْهِ وَسَلَّمَ فِى الَمَسْجِدِ وُضُوْءًا خَفِيْفًا
অর্থ: ‘রাসূলুল্লাহ (সা) খুব অল্প পানি খরচ করে মসজিদে ওজু করেছেন। সহিহ আহমাদ ৫/৩৬৪)
(গ) মসজিদে বিছানার ব্যবস্থা করা: ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদে বিছানা বিছানো যায়। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়- فَلَمَّا كَانَ صَبيحةً عِشْرِيْنَ نَقَلْنَا مَتَاعَنَا
অর্থ: ‘একুশতম দিনের সকালে আমরা আমাদের বিছানা পত্র সরিয়ে দিলাম’। (বুখারি হা/২০৪০)
(ঘ) শারঈ প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া: মসজিদে পেশাব-পায়খানার ব্যবস্থা না থাকলে পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে। এছাড়া শারঈ কোনো প্রয়োজনে বের হওয়া যাবে। (আবূদাঊদ হা/২৪৭৩)
(ঙ) স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা: রাসূলুল্লাহ (সা) তার স্ত্রী সাফিয়া (রা.) এর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাফিয়া (রা.) বলেন, রমজান মাসের শেষ দশ দিনে তিনি একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখতে আসলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সঙ্গে অনেক্ষণ কথা বললেন। এরপর তিনি উঠে গেলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সঙ্গে উঠলেন এবং মসজিদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। (বুখারি হা/২০৩৫; সহিহ মুসলিম, হা/২১৭৫)
(ঙ) মুস্তাহাজা নারীর ইতিকাফ করা জায়েয: মুস্তাহাজা নারীর ইতিকাফ করা জায়েয। তবে তাকে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন মসজিদে নাপাকী না লাগে। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে তার এক মুস্তাহাজা স্ত্রী ইতিকাফরত অবস্থায় ছিলেন। তার লাল ও হলুদ বর্ণের রক্ত প্রবাহিত হতো। সালাত আদায়কালে আমরা অনেক সময় তার নীচে পাত্র রাখতাম। (বুখারি হা/৩০৯; সুনান দারেমী হা/৮৭৭)
ইতিকাফকারীর শিষ্টাচার : ইতিকাফকারীর জন্য করণীয় হলো, সর্বদা আল্লাহ তাআলার ধ্যানে মগ্ন থেকে বেশি বেশি সালাত আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির এবং আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। বিশেষ করে বেজোড় রাত্রিগুলোতে লায়লাতুল কদর অন্বেষণ করা।
উল্লেখ্য, শুধু ঘুমালে ইতিকাফের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। অনেককে দেখা যায়, ইতিকাফে বসে দুনিয়াবী অহেতুক কথা, কাজ বা খোশ-গল্পে মত্ত থাকে, যা ইতিকাফের বৈশিষ্ট্য পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিগণের ইতিকাফ এরূপ ছিল না।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শরিয়াতের বিধান মেনে ইতিকাফ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সূত্র: মাসিক আত তাহরীক