পিবিএ,ডেস্ক: নিজ নিজ পেশায় কর্মস্থলে, দায়িত্ব পালনে সমাজ এবং আইনের চোখে আমরা কেউ কর্মকর্তা, কেউ কর্মচারী, কেউ কর্মী বা শ্রমিক। আমরা সবাই পরস্পরের সাথে কিছু লেনদেন এর ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ, প্রত্যেকেরই অপরাপর পক্ষগুলোর উপর আমাদের সম্পাদিত কর্মচুক্তির বদৌলতে কিছু ন্যায় এবং আইনসংগত অর্জিত অধিকার আছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে উভয়ের বিপরীত মুখী স্বার্থ। মালিক চায় শ্রমিকদের কাজে খাঁটিয়ে সবোর্চ্চ মুনাফা অর্জন করতে। অপরদিকে শ্রমিক-কর্মচারীরা চায় নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে। তাই স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণকল্পে তারা সংবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। এ দু’টিপক্ষ সকল সময় বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। এর কারনে উভয়ের স্বার্থ বিপরীতমূখী। মালিকপক্ষ চায় বিনিয়োজিত পুজিঁর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে এবং শ্রমিক-কর্মচারীরা চায় তাদের ন্যায্য পাওনা বা স্বার্থ সংরক্ষণ করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত শ্রেণী হলো শ্রমিক শ্রেণী। ধারাবাহিক শ্রমিক আন্দোলনের ফলে পূর্বের তুলনায় এ দেশের অবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও এখনো মানবেতর অবস্থায়ই শ্রমিকদের দিনগুলো কাটছে। ফলে শ্রমিক-মালিকের পারস্পরিক সমস্যা মানব সমাজের এক প্রাচীনতম ও জটিলতার সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষের চেষ্টার অন্তঃনেই। এই উদ্দেশ্যে রচিত মতবাদেরও কোন অভাব নেই। কিন্তু কার্যত এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য কোন নির্ভুল নীতি আজ পর্যন্ত রচনা করা সম্ভব হয়নি। মানুষ যতই চেষ্টা করছে সমস্যা ততই তীব্রতর ও জটিল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের তেমন কোন উন্নতি হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায় না।
শ্রমিক-কর্মচারীরা প্রারিশ্রমিকের জন্য কাজ করছে। আর মালিক পক্ষ নির্দ্রিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের খাঁটাচ্ছেন। শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিকের মধ্যে পারষ্পারিক সমঝোতা ও হৃদ্যতা বজায় রেখে উভয়ে স্বার্থ সংরক্ষন করলে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শ্রমিক-কর্মচারীকে দেখতে হবে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ আর মালিক পক্ষকে দেখতে হবে শ্রমিক-কর্মচারীর স্বার্থ। শ্রমিক-কর্মচারীকে বুঝতে হবে মালিক পক্ষের সুবিধা অসুবিধা আবার মালিক পক্ষকে বুঝতে হবে শ্রমিক-কর্মচারীদের সুবিধা অসুবিধা। শ্রমিক-কর্মচারীর ও মালিক পক্ষের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতার মনোভাব রক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তা শ্রমিক-কর্মচারীর ও মালিক হলে উভয় পক্ষই লাভবান হবে।
মালিকের সাথে শ্রমিকের আর শ্রমিকের সাথে মালিকের সম্পর্ক কি তা জানা না থাকার কারণে আজকাল শ্রমিক মালিক এর পারস্পরিক সম্পর্ক এক বিরাট জটিল সমস্যা হিসাবে বিদ্যমান। স্বার্থন্ধতার ফলে শ্রমিক ও মালিক আজ দুটি মারমুখী প্রতিদ্বন্দী দলে বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন শ্রমিক ততক্ষণই মালিকের কাছ থেকে তার মানবিকতার মর্যাদা পায় যতক্ষণ কোন মালিক তার কাজ আদায় করে নিতে গিয়ে কোন শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু যখনই এই প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে তখনই কোন কোন মালিক কোন কোন ক্ষেত্রে মেহনতী শ্রমিকের উপর অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালাতেও দ্বিধা করে না। অন্যদিকে শ্রমিক ও মালিকের কাজে ততক্ষনই আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে যতক্ষণ তার জীবিকা কোন মালিকের উপর নির্ভর করে। কিন্তু যেখানেই এই বাধ্যবাধকতা থাকে না সেখানেই শ্রমিক কাজে গাফিলতি ও মালিকের বিরুদ্ধে হরতাল এবং ঘেরাও অভিযান করতেও পিছপা হয় না। যার পরিণতিতে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে এক চিরন্তন দর কষাকষি বিদ্যমান এবং তাদের পরস্পরের কোন সৌহার্দ্যপূর্ণ গঠনমূলক সম্পর্ক কায়েম হয়ে উঠতে পারছে না।
আমাদের পরস্পরের স্বার্থ সংঘাত তখনই কম হবে যখন আমরা প্রত্যেক পক্ষ নিজের এবং আমাদের সঙ্গে জড়িত অপর পক্ষগুলোর অধিকার সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবহিত থাকি। কেউ যদি কাউকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোন অপচেষ্টা চালায়, আমরা সেটা সঙ্গে সঙ্গেই টের পাব এবং আইনগতভাবেই আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে নিতে পারব।
ইসলাম মানুষের জন্য আল্লাহর দেয়া এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তাতে মানুষের সকল প্রকার সমস্যার সমাধানের মূলনীতি বর্তমান রয়েছে। দুনিয়ার সকল মানুষের বিশেষত মুসলমানদের বাস্তব জীবনে ইসলামের অনুসরণ করা একান্ত কাম্য। ইসলাম একটি জীবনাদর্শ হিসেবে শ্রমজীবিদের সকল সমস্যার সঠিক ও ন্যায়ানুগ সমাধানকে দিক নির্দেশ করেছে। ইসলামই করেছে এর ন্যায়ানুগ প্রতিকার। ইসলাম চায় এমন এক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে এবং শ্রমিক ও মালিক সৌহার্দ্যমূলক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন এক বিধানের প্রচলন করতে যেখানে শোষন নেই, নিপিড়ন নেই, সর্বোপরি নেই দুর্বলকে পিষে খতম করার জঘন্য প্রবণতা। শ্রমিক মালিক এর পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সম্ভব নয় ফলে, ঐ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় সফলতা বৃদ্ধি পেতে পারে না। ইসলাম তাদের মধ্যে পারস্পরিক, সহানুভূতির এক সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক কায়েম করে। ইসলাম উভয়কে এমন কতগুলো বিধি বিধান দ্বারা আপবদ্ধ করে দিয়েছে যাতে করে তাদের ঐ ব্যবসাগত সম্পর্ক রুক্ষ ও কঠিন না হয়ে হয়েছে ভ্রাতৃত্বমূলক প্রীতিময়।
শ্রমিকের সম্পর্কে একজন মালিকের কি ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার:
শ্রমিকের ব্যাপারে একজন মালিকের কি ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত সে সম্পর্কে আল্লাহপাক হযরত মুসা ও হযরত শোয়াইব (আঃ) এর ঘটনা উল্লেখ করে ব্যাপক অর্থবহ ইঙ্গিত দিয়েছেন। “হযরত মুসা (আঃ) অনেকদিন পর্যন্ত হযরত শোয়াইব (আঃ) এর নিকট গতর খেটে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তাকে নিয়োগ করার সময় তিনি বলেছেন, “আমি আপনার উপর অহেতুক কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। আল্লাহর মর্জিতে আপনি আমাকে সৎ কর্মশীলদের মধ্য হতে পাবেন”। উক্ত আয়াতে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, একজন মুসলমান মালিকের মঞ্জিলে মকসুদ টাকা নয়, বরং তাকে সৎ কর্মশীল হতে হবে। তাকে সমস্ত কাজ আখেরাতকে লক্ষ্য রেখে সততার সঙ্গে করতে হবে। সে মজুরকে শুধু নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করনেই খাটিয়ে মারবে ন্ াআর সে ততক্ষণ পর্যন্ত সৎ কর্মীদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে না যতক্ষণ না সে শ্রমিককে অধিক বোঝা থেকে বাঁচিয়ে রাখার আবেদন নিজের ভিতরে অনুভব করে।
যে কাজ করে এবং যে মজুরদের দ্বারা কাজ করায় তারা উভয়ই উভয়কে ভাই বলে মনে করবে। দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক তাদের মধ্যেও ঠিক তাই হবে। বিশ্বনবীর এটাই আন্তরিক বাসনা এবং ইসলামের দৃষ্টিতে এটাই সুষ্ঠ মানবিক আদর্শ অন্ততঃ খাওয়া, পরা, থাকা প্রভৃতি বুনিয়াদি প্রয়োজন পূর্ণ করা পর্যন্ত মজুর ও মালিকের আর্থিক অবস্থা একেবারে সমান স্তরের হতে হবে। মালিক নিজে যা খাবে তাই মজুর ও শ্রমিককে খেতে দিবে যা নিজে পরিধান করবে মজুরকেও তাই পরিধান করতে দেবে। এই আদর্শ হতে মজুরের পারিশ্রমিক নির্ধারণের ব্যাপারে ইসলামের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিও নিঃসন্দেহে জানতে পারা যাবে। হযরতের এই আদর্শকে মালিকের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া কোন ক্রমেই ঠিক হবে না। বরং ইসলামী হুকমত আইনের সাহায্যে এইরূপ আচরণকে প্রত্যেক মালিক ও মজুরীর পক্ষ অবশ্যই করণীয় ও বাধ্যতামূলক করে দিবে।
রাসূলে করীম (সাঃ) বলেন, “মজুর-শ্রমিক ও ভৃত্যদের যথারীতি থাকা ও পোষাক দিতে হবে”।
তিনি বলেন, যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন (বুখারী)। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক প্রভু ভৃত্যের নয় বরং তোমরা ভাই ভাই।
সময় কাজের কঠোরতা উভয় দিক দিয়েই মজুরকে সক্ষম ও সমর্থ করে রাখতে হবে। এমন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাজে নিযুক্ত রাখা বা এমন কোন কাজের বোঝা মজুরের মাথায় চাপিয়ে দেয়া যাবে না। যা করতে একেবারে অসমর্থ কিংবা যা করলে সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে বা তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
নবী করিম (সাঃ) বলেন, মজুরদের সাধ্যের অতীত কোন কাজ করতে তাদের বাধ্য করবে না। অগত্যা যদি তা করাতে হয় তবে নিজে সাহায্য কর। (বুখারী)
হযরত আবুযার (রাঃ) একদা তাঁর ভৃত্যক ভৎসনা করেছেন, হযরত নবী করিম (সাঃ) তা শুনে বলেছেন- “তোমার মধ্যে এখনও কি জাহেলী যুগের বদ অভ্যাস বর্তমান রয়েছে”? অর্থাৎ ভৃত্যকে ভৎসনা করা জাহেলী স্বভাব সব বিশেষ। ইসলাম তা বরদাশত করে না অতঃপর প্রত্যেকটি ব্যাপারে পূর্ন সমতা রক্ষা করাই হযরত আবু যারের আজীবন কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে।
নবী করিম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার অত্যন্ত তাকিদের সঙ্গে বলেছেন- “তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে যেমন ব্যবহার করে থাকো তাদের সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করবে”। আর মানুষ হিসাবে তারা তোমাদের চেয়ে কোনক্রমে কম নয়। তোমরা কি দেখ না আমি যায়েদকে আজাদ করে আমার ফুফাত বোনের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছি এবং বিলালকে মুয়াজ্জিন মনোনীত করেছি। কেননা সে আমাদের ভাই। তোমরা আরও দেখ যে, আনাস আমার কাছে থাকে। আমি তাকে নিকৃষ্ট মনে করি না। সে কোন কাজ না করলে আমি তাকে বলি না যে কেন তুমি তা করনি? আর যদি সে হঠাৎ কোন ক্ষতি করে বসে তবুও তার প্রতি আমি রাগ করি না। (বুখারী)
হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বায়তুল মোকাদ্দস সফর কালে উষ্ট্র চালনার কাজ ভৃত্যের সঙ্গে আধাআধি ভাগ করে সওয়ার ঘটনা এক ঐতিহাসিক ব্যাপার। তিনি মদীনার চতুর্দিকে রাত্রি নিশিথে ঘুরে বেড়াতেন। যেখানে কোন মজুর দাসকে কোন কঠিন কাজে নিযুক্ত দেখতে পেতেন তাকে মুক্তি দিতেন এবং কাউকেও তার ন্যায় সংগত মজুরীর কম পেতে দেখলে তার মজুরী বৃদ্ধি করে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন।
অন্য একদিন নবী করমী (সাঃ) বলেছিলেন- “তোমরা অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোন রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না, তাদেরও তোমাদের ন্যায় একটি হৃদয় আছে। ব্যাথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কস্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন কর না। (বুখারী)
ইসলাম মালিককে সহনশীল হতে শিক্ষা দেয়। ক্ষমা সুন্দর মনোভাব নিয়ে শ্রমিকদের দোষত্রুটি মাফ করে দিতে উৎসাহিত করে। একদিন এক সাহাবী এসে নবী করীম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন হুজুর চাকর খাদেমদের অপরাধ কতবার ক্ষমা করব? ঘটনা বর্ণনাকারী বলেন- নবী করিম (সাঃ) তা শুনে চুপ করে রইলেন। ঐ সাহাবী পুনরায় তাই জিজ্ঞেস করলেন। তখন তাপিতদের পরম নির্ভরস্থল মুহম্মদ (সাঃ) ব্যাকুল হয়ে বলে উঠরেন (কত বারের কথা জিজ্ঞেস করেছ) “প্রত্যেক দিন সত্তর বার হলেও তাকে ক্ষমা করে দিও“ (এ যে তোমার ভাই)- তিরমিযী।
নবী করিম (সাঃ) বলেন, আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন যে, কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কঠিন অভিযোগ উপস্থাপন করবো- যে ব্যক্তি আমার জন্য কাউকেও কিছু দান করার ওয়াদা করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করল, কোন মুক্ত স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে যে তার মূল্য আদায় করল এবং যে ব্যক্তি অন্যকে নিজের কাজে নিযুক্ত করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নিল। কিন্তু তার মজুরী দিল না ওরাই সেই তিনজন (মেশকাত)
নবী করিম (সাঃ) অন্য এক জায়গায় বলেন- “মজুর চাকরদের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্বের লক্ষণ”।
মালিকদের অভদ্র আচরণকে তিনি অত্যন্ত ঘৃন্য বলে ঘোষনা করেছেন। তিনি বলেন অসদাচরনকারী মালিক বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। (মাজমাউজ, যাওয়ায়ীদ-লিন হায় ছামী)
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে- “ধনীর সামর্থ থাকা সত্ত্বেও পরের হক আদায় করতে অকারণ বিলম্ব করা জুলুম”।
নবী করীম (সাঃ) স্পষ্ট ভাষায় আদেশ করেছেন “মজুরকে তার ঘাম শুকাবার আগেই মজুরী পরিশোধ করে দাও।” অর্থাৎ মজুরী শেষ করতে অকারণ বিলম্ব করা সঙ্গত নয়্
হযরত আনাস (রাঃ) আরো বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ) এর এখানে দশ বছর ধরে খেটেছি তার খেদমত করেছি কিন্তু তিনি কোন দিন আমাকে ভৎসনা করেননি। কোন দিন বলেন নি এটা এভাবে কেন করছ ওটা ঐভাবে কেন করনি। (আল আদাবুল মুফরাদ)
নবী করিম (সাঃ) তাদের মানসিক অবস্থার দিকেও খেয়াল রাখতেন সব সময় তার লক্ষ্য তাকত যাতে তার বিমর্ষ না হয়ে পড়ে, মন যাতে তাদের ভেঙ্গে না যায়। নিজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতেন, স্বান্তনা দিতেন, আশ্বাসের বাণী শুনাতেন অভিযোগের প্রতিকার করতেন, তাদের মনোরঞ্জন করতেন। প্রখ্যাত সাহাবী আবু যর গিফারী (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) এর খেদমতগার ছিলেন। একদিন কাজের ছাপ কিছু বেশী হওয়ায় খাকিটা রাত করেই তিনি মসজিদে নববীর এক কোনায় শুতে গেলেন। ঐ দিন তিনি একটু বেশী পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই নবী করীম (সাঃ) তাকে আঙ্গুলির ইশারায় জাগালেন আর একান্ত সহানুভূতিশীল কণ্ঠে জিজ্ঞেস কররেন-আবু যর? ঐ দিন তুমি কি করবে যে দিন তোমাকে এই মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হবে।
দরবারে নববীতে হযরত আবযরের অনেকটা অকৃত্রিম সহানুভূতি ছিল। তিনি সরলভাবে বলে উঠলেন- তলোয়ার খুলে দাড়াও। আর যে আমাকে এ শান্তির নীড় থেকে বের করে দিতে চাইবে তার গর্দান উড়িয়ে দেব।
নবী করিম তখন হাত উঠালেন দোয়া করলেন, আল্লাহ আবুযরকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আর কিছু নসীহতমূলক কথা বলে তিনি উঠে আসলেন। হুজুরে পাক (সাঃ) এই দোয়ায় হযরত অবুযরের শ্রান্ত মন যে কতটা শান্ত হয়ে উঠেছিল তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
হযরত নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, মজুরকে তাহার কাজ হতে অংশ দান কর। কারন আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না।
হযরত নবী করিম (সাঃ বলেন, তোমার ভৃত্য যদি তোমার অন্ন প্রস্তুত করে এবং তা নিয়ে তোমার নিকট আসে যা রান্না করার সময় আগুনের তাপ এবং ধুম্র তাপে অনেক কষ্ট দিয়েছে তখন তাকে তোমার সঙ্গে বসিয়ে খাইয়ে দেবে। খানা যদি শুস্ক হয়ে থাকে তবে তা হতে তার হাতে এক মুষ্ঠি বা দুই মুষ্ঠি অবশ্যই তুলিয়া দিবে।
আজকের এই সমাজে যদি কোন মালিক শ্রমিকদের খোঁজ খবর নিজ থেকে নেয় সুখে দুঃখে সান্তনার বাণী নিয়ে আসে তবে অতি সহজেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যেতে পারত। নবী করিম (সাঃ) এর নির্দেশাবলী সাহাবা কেরাম তথা মুমিনদের জীবনে অত্যন্ত আশ্চর্য রকমের প্রভাব সৃষ্টি করেছিল এবং শ্রমিক মালিকের মধ্যে অতুলনীয় হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।
হযরত আবুযর (রাঃ যখন বেরুতেন লোকেরা দেখত, তিনি যে রকমের কাপড় পরে আছেন তেমনি ধরনের কাপড় খাদেমের অঙ্গেও শোভা পাচ্ছে। অনেকে বলত হযরত যে কাপড়টি তাকে দিয়েছেন এটি যদি আপনিই পরে নিতেন তবে আপনার পোশাকটা পরিপূর্ণ হয়ে যেত।
তিনি বলতেন, ঠিক ই বলেছ, কিন্তু আমি নবী করিম (সাঃ) এর কাছে শুনেছি তিনি বলেছে- যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদের ভাই। যা নিজে পরবে তাই তাদের পরাবে যা যা খাবে তাই তাদেরকে খাওয়াবে (আহমদ আর আদাবুল মুফরাদ)।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) তাঁর খাদেমের জন্য গোশত তৈরী করে রেখে বসে থাকতেন। সে বাজার থেকে আসলে তাকে সঙ্গে নিয়ে খেতেন। লোকেরা তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন আমি আমার দিল সাফ বানাবার জন্য এমন করি। (আল আদাবুল মুকরাদ)।
“হযরত উমর (রাঃ) একবার বলেছিলেন আল্লাহ ঐ জাতিকে লান করেন, যারা নিজেদের খাদেমদের নিয়ে এক সঙ্গে খেতে গৃণা বোধ করে।
এ কথা শুনে হযরত সাফওয়ান (রাঃ) বলে উঠলেন “ খোদার কসম আমরা এ ঘৃণাবোধ করি না। অধিকন্তু নিজেদের উপর আমরা তাদেরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। (আল আদাবুল মুফরাদ)
মোট কথা ইসলাম মালিককে সহনশীল হৃদয়বান এবং সহানুভূতিশীল হতে শিক্ষা দেয়। মালিক নিজের মনের মধ্যে মজুরকে কোন প্রকার শোষণের অভিপ্রায়ও রাখতে পারে না। স্বাস্থ্যহানিকর ও তার সাধ্যাতীত কোন কাজ তাকে নির্দয়ভাবে নিযুক্ত করতে পারে না। বরং সে মজুরের কষ্টকে নিজের কস্ট বলে মনে করবে। সমব্যথী হয়ে তার কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট থাকবে, আনন্দে সাথী হয়ে তাকে আত্মীয়তার স্নিগ্ধ পরিবেশে রাখবে যাতে সে কোন রকমের হৃদ্যতার অভাব অনুভব না কর্ েসর্বোপরি একজন মজুরকে নিজের সহোদরের মর্যাদায় রাখবে-যার চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর হতে পারে না।
এ ধরনের মনোভাব নিয়ে যদি কোন মালিক শ্রমিক কর্মীদের সমস্যা সমাধানে আত্ম নিয়োগ করে তবে আশ্চর্য রকমভাবে সব কিছুর সমাধান হয়ে যেতে পারে এবং আজকের মত বঞ্চনার আগুন শ্রমিকদের মনে আর ধিকি ধিকি করে জ্বলবে না।
শ্রমিক সম্পর্কে একজন মালিককে সে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার ঠিক তেমনি মালিক সম্পর্কে শ্রমিকের। একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার যা নিম্নে প্রদত্ত হলো :
* ইসলাম একটি পরিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা পৃথিবীর সব রকমের সমস্যার সমাধানে সক্ষম। ইসলাম কেবল শ্রমিক কর্মীকে মালিকের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদ তুলে তাদেরকে দায়িত্বহীন করতে আসেনি।
* ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য হল এক ইনসাফ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পৃথিবী গঠন করা। যেখানে সকলেই আপন আপন ন্যায়ানুগ অধিকার সংরক্ষিত রেখে নিরাপদে তা উপভোগ করতে পারে। এক সুসংহত অর্থ ব্যবস্থার সন্ধান দেয়া এবং কার্যকরীভাবে একে প্রতিষ্ঠিত করা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ফলে ইসলাম যেভাবে মালিকদেরকে অনেক প্রকার দায়িত্ব ও বিধিনিষেধের অধীন রেখেছে তেমনি মজুরী কর্মীদের উপরও অনেক ন্যায়নীতি আরোপ করেছে। তাদেরকে লাগামহীন হওয়ার সুযোগ দেয়নি কারণ সম্পর্ক কোনদিনই এক তরফাভাবে কায়েম হতে পারে না। তাই শ্রমিক ও কর্মীদের মধ্যে এমন কতগুলো গুণের সমাবেশ থাকতে হয় যে গুলোর সাহায্যে শ্রমিক কর্মী ও মালিক সম্পর্ক উৎকর্ষতর হয়ে ওঠে।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক মালিকের কাজের দায়িত্ব নিজের পছন্দ অনুযায়ী নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যায় যা শুধু পেট চালাবার নিমিত্তেই সে করবে না, করবে আখেরাতের সফলতার জন্যে।
শ্রমিক কর্মীকে কর্মক্ষম ও শক্তিশালী হতে হবে। সর্বোপরি তাকে বিশ্বাসী, আমানতদার এবং নির্ভরযোগ্য হতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহপাক ইউসুফ (আঃ) এর একটি ঘটনার দিকে ইশারা করে কথাটার তাৎপর্য বুঝিয়েছেন। তৎকালীন মিসর সম্রাট স্বপ্নবৃত্তান্ত অনুযায়ী সাম্রাজ্যে এক দারুন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি অনুভব করেছিলেন। তখন ইউসুফ (আঃ) কারাগার হতে মুক্ত করে আনেন। ঐ সময় তিনি সম্রাটের পরামর্শদাতা নিযুক্ত হলে তাকে বলেছিলেন- আমাকে কোষাগারের দায়িত্ব দেয়া হউক। কারণ আমি উত্তম রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং বিজ্ঞ। অর্থাৎ আমি আমার দায়িত্ব যোগ্যতার সাথে পালন করার ক্ষমতা রাখি। তাই আমাকে তা দেয়া যেতে পারে।
আল্লাহ পাক বলেন, সর্বোত্তম শ্রমিক সেই ই, যে শক্তিশালী ও আমানতদার দায়িত্বশীল হয়। এতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, শ্রমিকরা কাজের জিম্মাদারী নেবে, যে কাজ সম্পর্কে তার জ্ঞান, শিক্ষা থাকা উচিৎ। তাকে শারীরিক দিক দিয়েও ঐ কাজের উপযুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ শরীর ও জ্ঞানগত উভয় দিক থেকেই তাকে কার্যক্ষম হতে হবে। শুধু শারীরিক বা কেবল জ্ঞানগত শক্তি দিয়ে কোন কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। কার্যপযোগী জ্ঞান ব্যতিরেকে কেউ-ই কোন কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। কর্মপোযোগী জ্ঞান ব্যতিরেকে কেউ-ই কোন কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। ঠিক তেমনি শারীরিক সুস্থতা ও উপযুক্ততা না থাকলে তার দ্বারাও কিছু হতে পারে না।
আল্লাহ পাক বলেন, এদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তি প্রদান করা হবে। যারা তাৎফীক অর্থাৎ মাপে কম বেশী করে। নিজের হক নেবার সময় পুরোপুরিভাবে আদায় করে দেয়, কিন্তু অন্যকে মেপে দিতে গেলেই কম দেয়। ফুকাহা এ উম্মতে ভাষ্যানুযায়ী এ আয়াতের মধ্যে ‘তাৎফীক’ অর্থাৎ মাপে কম বেশি করার ভাবার্থে ঐ সব মজদুরও শামিল যারা নির্ধারিত পারিশ্রমিক পুরোপুরি উসুল করে নিয়েও কাজে গাফিলতি প্রদর্শন করে। আর যে সময়টা মালিককে দিয়েছে তা তার মর্জির খেলাপফ অন্য সব ক্রিয়া-কর্মে কাটিয়ে যেদ। যে কাজ যে ভাবে করা উচিত, সে কাজ ঠিক তেমনি ভাবে আদায় করা তার জন্য অপরিহার্য।
তালুতের মত, একজন আর্থিক সঙ্গতিহীন ব্যক্তিকে যখন বনি ইসরাইলীদের হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া হল তখন সকলেই অভিযোগ করতে আরম্ভ করল-এ অনুপযুক্ত। কারণ তার কোন আর্থিক সঙ্গতি নেই। তখন আল্লাহ পাক তার নিযুক্তির বর্ণনা করতে যেয়ে বলেছিনে- জ্ঞান ও শারীরিক শক্তি উভয় দিক থেকেই সে অগ্রণী।
নবী করিম (সাঃ) বলেন, যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমানও নেই (মেশকাত)।
মালিকের যে কাজ তার উপর ন্যস্ত হয়েছে সে-ই তার সংরক্ষণ করতে হেফাজত করবে। সুতরাং তার উপর অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে ঐ কাজ নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে প্রতিপালন করা।
নবী করিম (সাঃ) বলেন, যখন কোন লোক কাজ করে তখন আল্লাহ চান যে, সে তার কাজে এতকান পয়দা করুক। অর্থাৎ যা যেভাবে করা দরকার ঠিক সেইভাবে তাকে তা আঞ্জাম দিতে হবে। (কানজুল উম্মাল হায়ছামী)
ইসলাম একজন শ্রমিককে এই নির্দেশই দেয় যে মালিকের যে কাজের দায়িত্ব সে নিজের পছন্দানুযায়ী গ্রহণ করে নিয়েছে তা তখন তার নিজের কাজ হিসাবে গণ্য হয়ে পড়েছে। তার জন্য আবশ্যক হয়ে গেছে পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও মনোযোগ সহকারে তাকে আঞ্জাম দেয়া না হলে সে তার পরকালীন সফলতা লাভ করতে পারবে না। যা তার শেষ গন্তব্যস্থল- আখেরী কেয়ামাগাহ।
নবী করীম (সাঃ) বলেন, তিন প্রকারের লোকদের দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে একজন সেও যে নিজের মালিকের হকও আদায় করে এবং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর হকও আদায় করে- (মেশকাত)। অর্থাৎ সৎ কর্মশীল একজন শ্রমিক যে আল্লাহ ও মালিকদের হক আদায় করতে থাকে সে ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী। এমনকি তার মলিক থেকেও বেশি। নবী করীম (সাঃ) আরো বলেন- যে অধীনস্থ খাদেম আল্লাহ ও তার মালিকের অনুগত থাকে ফরমাবরদারী করে, তাকে সত্তর বছর পূর্বেই বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে। মালিক তখন জিজ্ঞেস করবে-আল্লাহ। এতো আমারই একজন অনুগত খাদেম ছিল, তবুও তার এত মর্যাদা কেন?
আল্লাহ পাক বলেন, আমি তার কাজের প্রতিফল দিয়েছি। আর সেমোতাবেক তোমার কাজের প্রতিদান দিয়েছি। ইসলাম মালিক-শ্রমিক ও কর্মচারীর যে সব অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, যদি উভয়ে তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত হন তাহলে মালিক মজুরের পারস্পরিক দ্বন্দ ও শ্রেণী সংগ্রাম অতি সহজেই বন্ধ হয়ে যাবে। তিক্ততার পরিবর্তে তথায় মধুর সহযোগিতা ও সহানুভূতিমূলক গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হবে।
আর এটার জন্য যে জিনিসটা দরকার তা হলো ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা। অতএব অনতিবিলম্বে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা এবং ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী মালিক ও মজুর কর্মচারীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করা একান্তই কর্তব্য। আর সে জন্য মালিক শ্রমিক ও কর্মচারীদের তথ্য সমগ্র বিশ্ববাসীরই প্রাণপন চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।
লেখক: মোহাম্মদ আবুল হোসাইন চৌধুরী