মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
আমাদের মুসলিম সমাজের অনেকেই ইবাতদ বন্দেগী বলতে কেবল মাত্র আনুষ্ঠানিক উপাসনা সমূহকেই বুঝে থাকেন। অর্থাৎ তারা মনে করেন, ইবাদত বলতে শুধুমাত্র নামাজ, রোজা, হজ্¦, যাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদিকেই বুঝায়। এর বাইরে আর কোন ইবাদত নেই। কিন্তু এই ধারণাটি মোটেই ঠিক নয়। ইবাদত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণেই এ ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
ইবাদত শব্দটি একটি ইসলামী পরিভাষা। এটি একটি আরবি শব্দ। বাংলায় এর আভিধানিক অর্থ হল দাসত্ব করা, গোলামী করা। আর দাসত্ব বা গোলামী বলতে নিরংকুশ আনুগত্য করাকেই বুঝায়। অর্থাৎ কোন ধরনের প্রশ্ন বা আপত্তি ছাড়াই যদি কারো অন্ধ আনুগত্য করা হয়, তাহলে এ ধরনের নিঃশর্ত আনুগত্যকে বলা হয় দাসত্ব করা বা গোলামী করা। এর আরেকটি বাংলা প্রতিশব্দ হল আত্মসমর্পন।
ইবাদত সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি হল, ইবাদত করতে হবে শুধু মাত্র আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব বা গোলামী করা মানুষের জন্য শোভনীয় নয়। আর আল্লাহর ইবাদত বা গোলামী-দাসত্ব শুধু মাত্র কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের সকল কাজে, সর্বব্যাপী। কেননা, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন তাঁর গোলামী করবার জন্য। পবিত্র কোরআনে মানুষের জীবনোদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে শুধুমাত্র মাত্র সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব করার জন্য : ‘আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে কেবল আমার ইবাদত-দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’-সূরা আয যারিয়াত : ৫৬
আসলে মুমিন জীবনে আল্লাহর আনুগত্যের বাইরে পৃথক কোন জীবন নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তকে আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্যের অধীনে আনা এবং আল্লাহর আনুগত্যের মোকাবেলায় অন্য সব আনুগত্যকে প্রত্যাখ্যান করাই হলো তাওহীদের মূলকথা। মানুষের অখন্ড জীবনে আল্লাহর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে ঈমানের দাবী।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, পুরো জিন্দেগীব্যাপীই যদি ইবাদত করতে হয় তাহলে আর পৃথকভাবে আনুষ্ঠানিক ইবাদত সমূহ তথা নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদির আর প্রয়োজন ছিল কি।
আসলে ইসলামী উপাসনা বা আনুষ্টানিক ইবাদত গুলোর তাৎপর্য এখানেই যে, এগুলো বাস্তবক্ষেত্রে বা কর্মজীবনে আল্লাহর আইন বা হুকুম মেনে চলতে ইসলামী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী লোকদেরকে প্রস্তুত করে। কারণ বাস্তব কর্মক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম পালন করতে গেলে অন্তর ও বাহির উভয় দিক থেকে নানা ধরনের বাধা মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায়। মানুষের নফস বা প্রবৃত্তি যেমন তাকে বিভ্রান্ত করে; তেমনি বাইরের পারিপার্শিকতা ও পার্থিব জগতের আকর্ষণ, লোভ, লালসা, মায়া ইত্যাকার নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এতসব বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে স্রষ্টার একনিষ্ঠ হুকুমবরদারী বান্দা বা খাঁটি মুসলমান হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এ কারণেই বাস্তব জীবনে আল্লাহর যথার্থ বান্দা হওয়ার জন্য ইসলামের আনুষ্ঠানিক ইবাদত বা মৌলিক ইবাদতগুলো মূলত এক ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত করে রাখে।
আনুষ্ঠানিক ইবাদত সমূহ মূলত আল্লাহর স্মরণ। মানুষের মনে যতক্ষণ আল্লাহর স্মরণ থাকবে ততক্ষণ তার পক্ষে কোন বিবেকহীন কাজ করা সম্ভব নয়। একারণেই নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি ইবাদতগুলো এমনভাবে চক্রাকারে বিন্যস্ত হয়ে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে যে, কোন ব্যক্তি যদি এ ইবাদতগুলোর যথার্থ তাৎপর্য বুঝে এগুলোকে পালন করে তাহলে তার জীবন শুদ্ধ ও পবিত্র না হয়ে পারে না।
উদাহরণ স্বরূপ নামাজের কথাই ধরা যাক। দিনে পাঁচবার নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক। ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব এবং এশা – এই পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ ছাড়াও আনুষঙ্গিক আরো অন্যান্য বিভিন্ন ওয়াক্তের নফল নামাজও রয়েছে। প্রতিদিন এই পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ ও নফল নামাজের মাধ্যমে একজন মুসলমানকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আনুগত্যের মস্তক অবনত করতে হয়, সিজদা করতে হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সারা দিনের বৈষয়িকতার নানা পর্যায়ে লোভ-লালসায়, সংসারের নানা প্রাচুর্যের মোহে মানুষ যাতে আল্লাহকে ভুলে পংকিলতায় জড়িয়ে না যায়, পাপ ও অশ্লীলতার খপ্পরে না পড়ে। এ কারণে পবিত্র কোরআনে নামাজকে আল্লাহর স্মরণ বা জিকর বলা হয়েছে। কারণ মানুষের অন্তরে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর ভয়, তাঁর স্মরণ জাগরুক থাকবে, ততক্ষণ তার পক্ষে পাপাচারে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। মানুষের অন্তরে সারাক্ষণ আল্লাহর স্মরণ, তাঁর ভয়, তাঁর মহব্বত জাগরুক রাখার জন্যই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থাকে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
একজন মুসলমানের দিনের শুরু হয় নামাজ অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে মাথা নত করার মাধ্যমে আবার তার দিনের শেষও হয় – অর্থাৎ রাত্রিবেলা শয্যাগ্রহণও হয় পরম প্রভুকে সিজদা করার মাধ্যমে। এভাবে মুমিনের অন্তরে যখন আল্লাহর ভয় জাগরুক থাকে, তখন তার পক্ষে অনৈতিক বা বিবেক-বিরুদ্ধ কাজ করা সম্ভব হয় না। পাপাচার মুক্ত, অশ্লীলতা মুক্ত জীবন গড়া তখন তার পক্ষে সম্ভব হয়। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই নামাজ (মানুষকে) অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে বিরত রাখে।’ -আনকাবুত : ৪৫
অনুরূপভাবে রোজার কথাও বলা যায়। মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম-সাধনার কর্মসূচী মূলত আত্মশুদ্ধিরই এক দীর্ঘ-মেয়াদী বিরামহীন কর্মসূচী। মাহে রমজানের রোজা মূলত এক ধারাবাহিক সাধনার নাম। এই সাধনা হলো নফসের উপর; মানুষের বস্তুসত্তার উপর তার নৈতিক সত্তার বা তার বিবেকের নিয়ন্ত্রণকে বিজয়ী ও জোরদার করার সাধনা, পাশবিকতার উপর নৈতিকতার শৃংখল প্রতিষ্ঠার সাধনা।
সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশে, তাঁর সন্তোষ লাভের আশায় খাদ্য-পানীয়, যৌন-বাসনা, মিথ্যা, গীবত, অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে বিরত থাকার এই এক মাসের বিরামহীন সাধনার মাধ্যমে বৈষয়িক ও সামাজিক জীব মানুষ তার কলংকিত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ পায়। এবং এভাবেই সে আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা বা খোদাভীরু হতে পারে এবং এই খোদাভীরু লোক তৈরিই রোজার উদ্দেশ্য। পবিত্র কোরআনে রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘হে ঈমান্দারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিলো, যাতে তোমারা মুত্তাকী (খোদাভীরু) হতে পারো।’ -বাকারা : ১৮৩
অনুরূপভাবে যাকাত, ইসলামের হালাল-হারামের বিধান এবং হজ্জের কথাও বলা যায়। ইসলাম মানুষকে পরিণত করতে চায় ‘ইনসানে কামেলে’। মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশই হলো ইসলামের লক্ষ। আল্লাহর রাসূল বলেছেন ‘নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি আবির্ভুত হয়েছি।’ কাজেই ইসলামের কাক্সিক্ষত সমাজ হচ্ছে মানবিক আদর্শের সর্বোৎকর্ষম-িত সমাজ। হক-ইনসাফ ও পারস্পারিক সাম্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ইসলামী সমাজের মূল উদ্দেশ্য।
ইসলাম একদিকে যেমন সম্পদের প্রতি মানুষের সীমাহীন লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আবার অপর দিকে চায় ধনী-গরীবের মধ্যকার ব্যাপক বৈষম্যকে দূর করতে। এ কারণে নির্বিচারে বা অবৈধভাবে সম্পদ আয়ের উপর যেমন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তেমনি সম্পদ ব্যায়ের ক্ষেত্রেও বল্গাহীন স্বাধীনতাও ইসলাম অনুমোদন করে না। অর্থাৎ ইসলাম বৈধ পথে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক স্পৃহাকে রুদ্ধ করতে চায় না, তবে মানুষ যাতে সম্পদের গোলামে পরিণত হয়ে বিবেকবোধ ও মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে না বসে, সেজন্যই মানুষের বল্গাহীন অর্থ আয় ও ব্যয়ের উপর ‘হালাল-হারামের’ লাগাম পরিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রিত ও সংযত করতে চায়। আল কোরআনে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহ তোমাদেরকে যে হালাল ও উৎকৃষ্ট জীবিকা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর।’ -আল মায়েদা : ৮৮। কিন্তু সীমা লংঘন করতেও নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং অন্যের সম্পত্তি আত্মসাত করার উদ্দেশ্যে জেনে-শুনে বিচারকদের সামনে মিথ্যা বলো না।’; ‘আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ এছাড়াও বলা হয়েছে ‘হালাল রুজি ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত।’ অর্থাৎ ইসলাম মানুষকে ইতর প্রাণীর মত শুধু ভোগবাদী হিসেবে দেখতে চায় না। ভোগবাদের পরিবর্তে বরং ইসলাম মানুষকে ত্যাগের আদর্শেই উদ্বুদ্ধ করতে চায়, সম্পদ প্রেমের চেয়ে আল্লাহ প্রেমকেই মানবীয় আদর্শ হিসেবে স্থাপন করতে চায়। বলা হয়েছে : ‘কারো অনুগ্রহের প্রতিদান নয়, বরং তারা (মুমিন ব্যক্তিরা) ধন-সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য। তার মহান প্রভুর সন্তুষ্টিই থাকে তার একমাত্র প্রত্যাশা। আর তিনি অবশ্যি (তার প্রতি) সন্তুষ্ট হবেন।’-লাইল : ১৮-২১
এই স্পিরিটকে মূর্ত করার জন্যই যাকাতের বিধান দেয়া হয়েছে। যাকাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধনী-গরীবের বৈষম্য নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র-বিমোচন। ইসলামের ভ্রাতৃত্বের আদর্শে সমাজ বিনির্মাণের পথে এই অর্থনৈতিক বৈষম্য এক বিরাট বাধা। এ বৈষম্য যত বৃদ্ধি পাবে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ তত নষ্ট হবে। এই ভ্রাতৃত্ববোধকে সুরক্ষা দিতে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা, যা বৈষম্য দূর করতে এবং দারিদ্র বিমোচনে অত্যন্ত কার্যকর। যাকাত-ভিত্তিক অর্থনীতিই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও দারিদ্রমুক্ত সমাজব্যবস্থার গ্যারান্টি ও রক্ষাকবচ। যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। নামাযের পরই এর গুরুত্ব। কোরআনে নামাজের সাথেই যাকাতের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ একজন ধার্মিক, নামাজি মানুষের কৃপণ, কারুন হওয়ার সুযোগ নেই। একজন সত্যিকার ঈমানদার-মুসলমান ব্যক্তি অবশ্যই দানশীল এবং গরীব মানুষের প্রতি রহমদীল হবেন, মুসলমান অবশ্যই মানুষকে ভালোবাসবেন। বলা হয়েছে: ‘যারা কার্পণ্য করে এবং মানুষকে কার্পণ্যের নির্দেশ দেয়; আর যে (গরীবদের থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে জেনে রাখুক, আল্লাহ অভাবমুক্ত ও প্রশংসিত।’ -হাদীদ : ২৪ ; ‘শয়তান তোমাদরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় আর কার্পণ্যের নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ -বাকারা : ২৬৮
অনুরূপভাবে হজ্জ্বেরও উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসীদের মধ্যকার সৌ-ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যকে সংহত করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামের আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলো মূলত আত্মশুদ্ধি এবং ইসলামের মূল স্পিরিটকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত কতগুলো মৌলিক প্রোগ্রাম। বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে মানুষকে যথার্থ আত্মসমর্পনকারী তথা সত্যিকার মুসলমানে পরিণত করাই এ আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলোর উদ্দেশ্য।
এর ফলে একদিকে জায়নামাজে বা আনুষ্ঠানিকভাবে আবার অন্যদিকে বাস্তব কর্মক্ষেত্রের কঠিন ময়দানে আল্লাহর দরবারে আনুগত্য-সিজদার মাধ্যমের নিরন্তর কর্ম-প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মুসলমানের ব্যক্তি ও সমাজ-সংস্কৃতি শুদ্ধরূপ লাভ করে পৃথিবী শান্তি ও সুন্দরের আবহ নির্মাণ করে।
প্রশ্ন হতে পারে, আনুষ্ঠানিক ইবাদত তো যথেষ্ট পালিত হচ্ছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত ফলাফল কি আমরা পাচ্ছি? মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে, রমজান মাসে মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভীড়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক হজ্জ্ব পালন করছে, কিন্তু নৈতিক মানের তো তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না।
এর উত্তর হচ্ছে, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাকে আমরা যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি, এর স্পিরিটকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না। স্পিরিট হলো ধর্মের প্রাণ। ধর্ম থেকে যখন তার স্পিরিট হারিয়ে যায়, তখন তা পরিণত হয় নি¯প্রাণ আনুষ্ঠানিকতায়। এ কারণেই আমরা দেখি একটি লোক জায়নামাজে দাঁড়িয়ে মহান প্রভু আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মসর্ম্পনের ভঙ্গিতে দাঁড়াচ্ছে, রুকু করছে, সিজদা করছে এবং মুখে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করছে এবং আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করে তাঁর নিরংকুশ আনুগত্য করার এবং অন্য কারো আনুগত্য না করার ঘোষণা দিচ্ছে; আল্লাহকে একমাত্র প্রভূ ও অভিভাবক ও বন্ধু বলে জীবনের প্রতি মুহূর্ত ও প্রতি কাজে তাঁর উপর ভরষা করার স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর রহমত ভিক্ষা করে মোনাজাত করছে অথচ সে ব্যক্তিই মসজিদ থেকে বের হয়ে আল্লাহর আইনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
এর কারণ কী? কারণ হল, নামাজে দাঁড়িয়ে সে কী পড়ছে, কী প্রার্থনা করছে তার কিছুই সে জানে না। শুধুই তোতা পাখির মত না জেনে মন্ত্র পড়ার মত করে আল্লাহর কালাম তথা সূরা-কেরাত তেলাওয়াত করছে, দোয়া-দরুদ পড়ছে। অর্থাৎ আমরা শুধুই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। ইবাদতের তাৎপর্য না জানার কারণে ধর্মের প্রাণস্পন্দন থেকেই আমরা দূরে সরে গেছি। আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলোর তাৎপর্য না জানার কারণেই আজ আমরা সেগুলোকে নি¯প্রাণ আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছি।
এ কারণেই দেখা যায় রমজান মাসে শুধু শুধু জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। অথচ পবিত্র রমজান মাস হলো সিয়াম-সাধনার মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। আত্মসমালোচনার মাস। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেশাবের সাথে সিয়াম পালন করবে তার পূর্বের ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ আমরা রোজা রাখি ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে এই আত্ম-সমালোচনাটা নাই। এ কারণেই আমরা রোজাও রাখি আবার মিথ্যা কথাও বলি। অনেককে তো এও দেখা যায় যে, সারাদিন রোজা রাখে, কিন্তু নামাজ পড়ে না। এর কারণ কী? কারণ ঐ আনুষ্ঠানিকতা। ধর্মের স্পিরিট বা চেতনার চেয়ে লেটারটাকেই তারা বড় করে দেখছে। এ কারণেই রোজার নামে তারা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে মাত্র, সিয়াম সাধনা নয়, আত্মশুদ্ধি বা আত্ম-সমালোচনা নয়। এসব যদি থাকতো তাহলে রমজানে জিনিস-পত্রের দাম বাড়ানোর প্রশ্ন আসতো না। অথচ মহানবী স. বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথা কাজ পরিত্যাগ করতে পারলো না, তার শুধুমাত্র পানাহার পরিত্যাগে আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই।’
এ কারণেই রমজানের যে কাক্সিক্ষত প্রভাব আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে, আমাদের নৈতিক চরিত্রে পড়ার কথা তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি না। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা রমজান শেষেই পাই। কারণ মসজিদগুলোতে সেই উপচে পড়া ভীড়, সেই মৌসুমী মুসল্লিদের আর দেখা যায় না। রমজান মাসে যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, রমজান শেষে তাদের অনেককেই আর নামাজ পড়তে দেখা যায় না। এরও কারণ ঐ আনুষ্ঠানিকতা।
ঠিক একই কারণে আমাদের ঈদ উৎসবগুলোতেও ধর্মের প্রভাব খুব একটা দেখা যায় না। যদিও আমাদের দুটি উৎসবই প্রধানত ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু এ দুটি উৎসবই বর্তমানে প্রধানত লৌকিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। যার কারণে এই উৎসব গুলোর যে সার্বজনীন আনন্দ, এগুলোর যে মাহাত্ম-সৌন্দর্য, তা অনেকটা ম্লান হতে বসেছে। একদিকে উপচে পড়া প্রাচুর্য আর অন্যদিকে অনাহারি মানুষের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। কারণ জাহেলী যুগের মতই এসব উৎসব এখন নি¯প্রাণ আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। লক্ষ টাকা দামের শাড়ি আর ঈদের এক মাস আগ থেকেই নগরীর বড় বড় মার্কেটগুলোতে উপচে পড়া ভীড় মূলত ভোগবাদের লক্ষণ। মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পারিক মমত্ব ও সহানুভূতির এ উৎসব এখন পরিণত হয়েছে অনেকটা ভোগ ও পাশবিক উল্লাসে, যা মূলত কেন্দ্রিভুত থাকছে সমাজের ধনিক শ্রেণীর মধ্যে। যে স্পিরিট নিয়ে যাকাত দেয়ার কথা ছিল তার কিছুই আমরা লক্ষ করছিনা, বরং আমরা দেখছি ধনীর বাড়ীতে তথাকথিত যাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে প্রতি বৎসরই পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষ। অথচ দারিদ্র বিমোচনে যাকাত পালন করতে পারে বিরাট ভূমিকা।
পিবিএ/এএইচ