ইসলামের জন্য প্রথম যুগের মুসলিমদের আত্মত্যাগ অসামান্য। ইসলামগ্রহণের অপরাধে তাদের ওপর মক্কার মুশরিকরা সীমাহীন জুলুম-অত্যাচার চালায়। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সর্দাররা নিজ গোত্রের মুসলিমদের লক্ষ্যে পরিণত করে। মুশরিকদের নির্যাতন থেকে অভিজাত থেকে সাধারণ কোনো শ্রেণির মুসলিমরাই রেহাই পায়নি। ইসলাম গ্রহণের পর উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর চাচা তাঁকে খেজুরের চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে ধোঁয়া দিত। মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্য ও আয়েশের মধ্যে প্রতিপালিত হন। ইসলাম গ্রহণের পর মা তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেন এবং পানাহার বন্ধ করে দেন। ক্ষুধা ও কষ্টে তার শরীর খোলস ছাড়ানো সাপের গায়ের মতো হয়ে যায়।
বেলাল (রা.) ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে সে বেলাল (রা.)-এর গলায় দড়ি বেঁধে উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত, তাকে নির্মমভাবে প্রহার করত, উত্তপ্ত বালির ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারি পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখত। এমন কঠিন সময়েও বেলাল (রা.) ‘আহাদ’, ‘আহাদ’ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) বলে চিৎকার করতেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আবু বকর (রা.) তাঁকে কিনে স্বাধীন করে দেন।
ইসলামের জন্য আম্মার ইবনে ইয়াসার (রা.)-এর পরিবারের আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন বনু মাখজুমের ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ও তাঁর পিতা ভয়াবহ নির্যাতনের মুখোমুখি হন। তাদের উত্তপ্ত রোদে মরুভূমির ওপর শুইয়ে রাখা হতো। একদিন এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘হে ইয়াসার পরিবার, ধৈর্যধারণ করো, তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত।’ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইয়াসার (রা.) ইন্তেকাল করেন এবং আবু জাহেল লজ্জাস্থানে তীর নিক্ষেপ করে আম্মার (রা.)-এর আম্মা সুমাইয়া (রা.)-কে শহীদ করে দেন। ইসলামের জন্য তিনিই ছিলেন প্রথম শহীদ।
খাব্বাব ইবনে আরত (রা.) খোজায়া গোত্রের উম্মে আনসার নামে এক নারীর ক্রীতদাস ছিলেন। পৌত্তলিকরা তাঁর ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাত। পৌত্তলিকরা তাঁকে মাটির ওপর টানত, তাঁর মাথার চুল ধরে টানত এবং ঘাড় মটকে দিত, কয়েকবার জ্বলন্ত কয়লার ওপর শুইয়ে বুকে চাপা দিয়ে রাখত। জিন্নিরাহ নাহদিয়া, তাদের কন্যা ও উম্মে উবাইস ছিলেন ক্রীতাদাসী, সুহাইব রুমি (রা.) ছিলেন আবদুল্লাহ বিন জারআনের স্বাধীন করা দাস। তারাও পৌত্তলিকদের কঠোর নির্যাতনের মুখোমুখি হন।
পৌত্তলিকরা বীভৎস উপায়ে মুসলিমদের কষ্ট দিত। যেমন, উট ও গাভির কাঁচা চামড়ার ভেতর জড়িয়ে রোদে ফেলে রাখা, লোহার বর্ম পরিয়ে তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে রাখা, হাত-পা বেঁধে দুষ্টু ছেলেদের লেলিয়ে দেওয়া, চাবুক দিয়ে পেটাত। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১০৭-১০৮; নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ১৩২-১৩৪; মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/২৯৮-৩০১)
মক্কায় ঈমানি পরীক্ষায় আত্মত্যাগী সাহাবিদের ‘সাবিকুনাল আউয়ালুন’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০১) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকালের আগে ‘সাবিকুনাল আউয়ালুন’ (প্রথম সারির মধ্যে অগ্রগামী) সাহাবিদের ব্যাপারে বলেন, “মুহাজিরদের মধ্যে ‘সাবিকুনাল আউয়ালুন’ এবং তাদের পরে তাদের সন্তানদের ব্যাপারে তোমাদের অসিয়ত করছি। যদি তোমরা তা (সম্মান ও সদ্ব্যবহার) না করো তবে তোমাদের দান ও ন্যায়পরায়ণতা গ্রহণ করা হবে না।” (জামিউল মাসানিদ ওয়াস-সুনান, হাদিস : ৬০৯২)