শতাব্দী আলম, পিবিএ: মাও সে তুং যখন বেইজিং শহরে শত মিটার প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করছেন তখন চীনের জনসাধারণ তাদের প্রিয় বিপ্লবী নেতাকে রীতিমত পাগল আক্ষায়িত করেছে। সে সময় বেইজিং এর মানুষের বাহন বলতে ছিল দুই চাকার সাইকেল। অধিকাংশই পা’য় হেটে কর্মস্থলে যাতায়াত করতেন। এহেন পরিস্থিতিতে একশ মিটার চওড়া সড়ক নির্মাণ জন সাধারণের চিন্তার বাইরে ছিল । জনসাধারণ বলাবলি করতেন, ‘চেয়ারম্যান মাও পাগল হয়েছেন। এতবড় সড়কের কি দরকার ! সাইকেল চালানো বা হাটার জন্য বড়জোড় ৩০ মিটার হলেই যথেষ্ট।’ কিন্তু ‘মাও’ যা জানতেন অন্যদের কল্পনায়ও তা ছিল না। তাঁর পরিকল্পনা ছিল শত বছরের। আর তিনি ভাবতেন পরবর্তি তিন প্রজন্মের কথা। চেয়ারম্যান মাও জানতেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উন্নত ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা। অক্টোবর বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন ধারার কমিউনিষ্ট আন্দোলন প্রবর্তিত করে। পরবর্তি অর্ধ শত বছর আধুনিক বিশ্ব দেখেছে কিভাবে চৈনিক জাতি চেয়ারম্যান মাও এর মতবাদ অনুসরন করেছে। আর বর্তমান বস্তবতা বিশ্বের প্রতিটি মানুষ জানে। ধারনা করা হয় বর্তমান শতাব্দীর মাঝা মাঝি চীনই হতে যাচ্ছে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে এমন উন্নত স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা-বিবৃতিতে থাকতো স্বপ্নের সোনার বাংলার রুপরেখা । অজ্ঞ ও বিপথগামী একটি গোষ্ঠির নৃশংসতায় তা বাধাগ্রস্থ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কণ্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার অত্যন্ত সফলভাবে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। ইতমধ্যেই স্বল্পউন্নত বাংলাদেশ বিশ্বের বিস্ময়। এভাবে চলতে পারলে অচিরেই সমৃদ্ধ জাতির কাতারে বাঙালিও সমাদৃত হবে।
এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অজ্ঞতার বাধা বড় প্রতিবন্ধকতা। এক হচ্ছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দূর্নীতির অজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত সাধারণ মানুষের অবিবেচনা প্রসূত অজ্ঞতা। দূর্ণীতি আমার এই লেখার উপজিব্য নয়। উন্নয়ন বিষয়ে সাধারণ্যের অজ্ঞতা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। সারাদেশেই অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে জনসাধারণ এক ধরনের মারাত্মক স্ববিরোধিতায় অবর্তীর্ণ হয়। অজ্ঞতার কারনে এমনটা হচ্ছে। কখনো কখনো এক শ্রেণীর প্রভাবশালী রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা কর্পোরেট ব্যক্তিও এমন আচরণ করেন। অবকাঠামো উন্নয়নে অজ্ঞতার বাধা কি ! রাজধানীর উত্তর সিটিতে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের ঘটনা আমরা সবাই জানি। উন্নয়ন করতে গিয়ে সারাদেশেই অহরহ এমন বাধার সম্মুখিন হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে আমি এর বাস্তব সাক্ষি। কয়েকটি বাস্তব ঘটনার আলোকপাত করবো। এতে একজন ব্যক্তিও যদি সচেতন হোন !
আমার আবাসস্থল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের টঙ্গী। বর্তমান মেয়র মোঃ জাহাঙ্গীর আলম টেকসই উন্নয়নের ব্যপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সিটির ৫৭ ওয়ার্ডে সড়ক যোগাযোগ উন্নত করার জন্য কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, মহল্লার চলাচলের রাস্তাও কমপক্ষে ৪০ ফুট হওয়া বাঞ্ছণীয়। ইতমধ্যেই মহাসড়কের ফুটপাথ হকারমুক্ত করেছেন। চলছে অবৈধ দখলমুক্ত করা। সিটির প্রতিটি ওয়ার্ডে কমবেশী শিল্প কারখানা আছে। প্রতিদিনই স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা। আবাসিক এলাকায় নির্মাণ হচ্ছে বহুতল ভবন। অপ্রশস্ত সড়কের কারনে যানজটে লাখ লাখ কর্মঘন্টা বিফলে যায়। যানজট নিরসন বা জনসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে সড়ক প্রশস্ত করার কোন বিকল্প নাই।
কিন্তু মেয়র মহোদয় যেখানেই সড়ক প্রশস্ত করতে যাচ্ছেন সড়ক সংলগ্ন বাড়িওয়ালা বা কারখানা মালিকদের বাধার সম্মুখিন হন। নগরীর টঙ্গী থেকে কাউলতিয়া, পুবাইল থেকে কাশিমপুর সবখানেই এক চিত্র। ডেকেরচালায় এক কারখানা মালিকতো আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছেন। এসবই জনসাধারণের অবিবেচনা প্রসূত অজ্ঞতা। জনগণ কেন বুঝে না সড়ক প্রশস্ত করা তারই প্রয়োজনে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে দ্রুতিগতির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এখনই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়তে হবে। মেয়রতো তাই করছেন। সড়ক প্রশস্তকরণে বাধাকে জনসাধারণের অজ্ঞতা না বলে উপায় কি বলুন। আমাদের নেতৃবৃন্দ অতীতে স্রেফ ভোটের রাজনীতির কারনে প্রশস্ত সড়ক করতে পারেননি। বর্তমান মেয়র ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে সঠিক কাজটিই করছেন। তাকে সহাযোগীতা করাই হবে উত্তম।
সড়ক প্রশস্ত করার সুফল নিয়ে মেয়র প্রায় প্রতিদিনই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে জনসাধারণকে বুঝান। ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে ডেকের চালা সড়কের বাড়িওয়ালা ও কারখানা মালিকদের সাথে মত বিনিময়ে আমি ছিলাম। তিনি যুক্তি দেখান, মহাসড়কের পাশে জমির মূল্য কোটি টাকা কাঠা। মহাসড়ক লাগোয়া একটু তুলনা মূলক প্রশস্ত সড়কে জমির মূল্য কাঠা প্রতি প্রায় ২০/৩০ লাখ। অথচ অপ্রশস্ত সড়ক মহাসড়কের লাগোয়া হলেও সেখানে জমির মূল্য ৫ লাখও হয়না। তাহলে সড়কের প্রশস্ততাই জামির মূল্য নির্ধারন করে। একারনে আরও উন্নত শিল্প কারখানা গড়তে হলে প্রশস্ত সড়ক যোগাযোগ প্রয়োজন। যে ওয়ার্ডে প্রশস্ত সড়ক যোগাযোগ বেশী থাকবে সেখানে দ্রুত নতুন শিল্প কারখানা আসবে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও শিল্প মালিকদের সেসব অঞ্চলে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়া হবে। মতবিনিময়ের কিছুদিন পর ডেকের চালা সড়ক প্রশস্তকরণ করতে গিয়েও বাড়ি মালিকদের বাধার সম্মুখিন হয় সিটির কর্মকর্তারা। সেখানে এক কারখানা মালিক আদালতে মামলাও করেন। সকল বাধা প্রতিহত করেই মেয়র মহোদয় সড়ক প্রশস্ত করা অব্যাহত রেখেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে হয়ত মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি নাখোশ হয়েছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে ঠিকই জনসাধারণ এর সুফল ভোগ করবে। এইতো চলতি সপ্তাহে নগরীর শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত টঙ্গী কলেজের পেছনের সড়ক প্রশস্ত করা চলছে। সেখানে সিটির কমপক্ষে ২০ ফুট সড়ক থাকার কথা । অথচ সরজমিনে ছিল মাত্র ৮ কি ১০ ফুট। টঙ্গী পাইলট স্কুলের পেছনে এক বাড়িওয়ালাতো দিব্যি সড়ক দখল নিয়ে গাড়ির গ্যারাজ বানিয়েছেন। মেয়র মহোদয় নিজে উপস্থিত থেকে প্রশস্ততা নির্ধারন করে দেন। সেভাবে কাজ এগুচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। তিনি কাজের অগ্রগতি দেখতেও সেখানে এসেছেন। মেয়রের এই যে কমিটমেন্ট এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
আসা যাক শিল্প কারখানার মাধ্যমে বেদখল প্রসঙ্গ। এব্যপারেও গাজীপুর সিটি মেয়র জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল। ইতমধ্যে তুরাগ তীর দখলকারী কয়েকটি বৃহৎ শিল্প কারখানার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন স্থগতি রেখেছেন। আরটিভির একটি লাইভ টকশোতে তিনি সে কথা বলেছেনও। গত একযুগ টঙ্গীর সাতাইশ রোডে ছায়াকুঞ্জ নামের হাউজিং কোম্পানী আবাসিক এলাকা ও শিল্প জোনের নামে ফসলি জমি ও জলাভুমি দখল করেছে। ছায়াকুঞ্জের মালিক পক্ষ ছিলেন ধরা ছোঁয়ার উর্দ্ধে। বর্তমান মেয়র সেই তাদেরও ছাড় দেননি। সম্প্রতি ছায়াকুঞ্জের সত্ত্বাধীকারি দখল মামলায় জেল হাজত খেটেছেন।
প্রিয় পাঠক পরিবর্তনের জন্য যেমন যোগ্যতম নের্তৃত্ব প্রয়োজন। একইভাবে জনসাধারণ এবং সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। যানজটমুক্ত সড়ক দাবি করে সড়ক প্রশস্ত করণে বাধা স্ববিরোধিতা। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদুর প্রসারী পরিকল্পনায় রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন এখন আর স্বপ্ন নয়। ২০২১ সালের মধ্যেই রাজধানীতে মেট্রো, এলিভেটের এক্সপ্রেস ওয়ে, বন্দরনগরী চট্রগ্রামে কর্ণফুলি টানেল, পদ্মা সেতু জনসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করবে কোন সন্দেহ নেই।
আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটি মেয়র সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন। রাজধানীর সন্নিকটে গাজীপুর দেশের অর্তন্ত সমৃদ্ধশালী এলাকা। শিল্প কারখানা ছাড়াও বিনোদন নগরী হিসাবে গাজীপুরে পুবাইলের কদর দেশ জোড়া। টাকশাল, ধান গবেষণা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ডুয়েট, আর্ন্তজাতিক মহাকাশ গবেষনা কেন্দ্র, দুইটি বিসিক এলাকা, টঙ্গী শিল্প এলাকা গাজীপুর সিটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। প্রায় চার সহ¯্রাধিক পোশাক কারখানাতো রয়েছেই। নতুন করে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আইসিটি পার্ক। আগামী বছর গুলোতে গাজীপুরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর কি পরিমান চাপ বাড়বে তা সচেতন মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করেন। এই বাস্তবতা উপলব্দি থেকেই শেখ হাসিনা সরকার বনানী থেকে এয়ারপোর্ট হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ করছেন। ডাবল লেন রেল যোগাযোগের কাজ চলছে। বর্তমান মেয়রের উদ্যোগের কারনে রেল লাইনের পূর্ব পাশে প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ শেষ। অপর পাশেও ৬০ ফুট সড়ক হবে। পাশাপাশি এখনই যদি আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হয় তাহলে শুধুমাত্র মহাসড়ক প্রশস্ত করে কোন ফল আসবে না। কারন মহাসড়ক থেকে আঞ্চলিক সড়কে গাড়ি বা মালবাহী ট্রাক প্রবেশে জট হবে। প্রতি ওয়ার্ডের সাথে মহাসড়কের যোগাযোগ স্থাপনকারী সড়ক প্রশস্ত করা অবশ্যই প্রয়োজন। মেয়র মহোদয় ভালভাবেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেন। জনসাধারণও এই রুঢ় বাস্তবতা বুঝেন। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যখন নিজের কয়েক ফুট জমি সড়কের জন্য ছাড়ার প্রসঙ্গ আসে তখনই বেকে বসেন। এই স্ববিরোধতার অবসান দরকার।
জীবনমান উন্নত চাইলে মানসিকতাও উন্নত হওয়া আবশ্যক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কোন শর্ত নয়, অবশ্যম্ভাবী। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড যাত্রার প্রবেশদ্বার বাংলাদেশ। উন্নয়ন অগ্রজত্রায় দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের হাতে রয়েছে বাংলাদেশ। অজ্ঞতার বাধা প্রতিবন্ধকতা হতে পারবে না। যত দ্রুত জনসাধারণ এই উপলব্ধি আমলে নেবে ততদ্রুত জাতির অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
পিবিএ/এফএস