একজন ম্যাজিস্ট্রেটের শহরের ন্যায়পাল হয়ে ওঠার গল্প

পিবিএ,ঢাকা : শহরের মুদি দোকানি থেকে গ্রামের কৃষক সবাই তাকে একনামে চেনেন। জানেন অন্যায় করলেই যেকোন সময় হাজির হয়ে যেতে পারেন তিনি; অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে আনতে পারেন আইনের আওতায়। সব অপরাধের বিচার মোবাইল কোর্টে হয় না; সব সমস্যার সমাধান সেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নেই। তদুপরি শহর থেকে গ্রাম, ধনী থেকে গরীব সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সামাজিক ন্যায় বিচার, আস্থা আর সততার প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি সোহেল রানা। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার হিসেবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ফেনীতে ২২ মার্চ, ২০১৬ সালে যোগদান করেন। সে সময় মার্চ ও এপ্রিলে তার ছাড় না দেওয়া অভিযানে স্থানীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছিলেন ” কাউকেই ছাড় দিচ্ছেন না সহকারী কমিশনার সোহেল রানা”। এরপর এপ্রিল ও মে মাসের প্রায় ৩০ টির ও বেশি অভিযান পরিচালনা করে দৈনিক কালের কণ্ঠে * অসাধু ব্যবসায়ীদের আতংকের নাম ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা* এই রিপোর্টের শিরোনাম হন।

সে সময় বেশ কয়েকটি ভেজাল বিরোধী অভিযান, মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে শিরোনাম হন তিনি। ফাউন্ডেশন ট্রেনিং থেকে কর্মস্থলে ফেরত আসেন ২০১৭ জানুয়ারীর ১৪ তারিখে। এসেই পার্কে স্কুল ড্রেস পড়ে আসা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এক ব্যতিক্রমী অভিযান চালিয়ে আবারো স্থানীয়ভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। পরিচালনা করেন কয়েকটি দুর্ধর্ষ মাদকবিরোধী অভিযান। আঘাত হানেন কয়েকটি শক্তিশালী আস্তানায় যেসকল আস্তানায় অতীতে প্রায় কখনোই অভিযান পরিচালিত হয়নি। ২০১৭ সালের ৮ মার্চ সীমান্তে মাদক আস্তানায় অভিযান করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত আসেন। সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় এই মাদকবিরোধী অভিযান। কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সীমান্তের এই হামলা সোহেল রানাকে হত্যার মাধ্যমে তাকে থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। মূলত এই অভিযানের পর ফেনীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে ঈর্ষনীইয় জনপ্রিয়িতা পান তিনি। ঐ হামলার পর থেমে যাননি তিনি। বরং ক্রমেই আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন; সোনার মত খাটি হয়েছেন।

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান আরো জোরদার হয়। অভিযান হয় ইভ টিজিং, ভেজাল ওষুধ, যানজট, ভেজাল কারখানা, ভেজাল তৈল, সীমান্ত হাটের চোরাচালান, জনশক্তি অফিসে গ্রাহক হয়রানি, ভুয়া ডাক্তার, পাসপোর্ট অফিসের হয়রানি, ওজনে কম, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, ঈদের পোশাকের মূল্যের উপর, ফুটপাথ দখলমুক্ত রাখার উপর, স্টিকারবাহী সিএনজি, এমএলএম কোম্পানি, পর্ণোগ্রাফি, প্রকাশ্য ধূমপান -কোন বিষয়ে অভিযান করেননি সোহেল রানা । মাদক আর খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তো রয়েছেই। শহরে অন্যায় হচ্ছে , মানুষ দুর্ভোগে পড়ছে অথচ সোহেল রানার অভিযান হয়নি এরকম জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ফলে অসাধু ও অন্যায়কারীদের কাছে এক মূর্তিমান আতংকের নাম ছিল” ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। যে নামটি ফেনী শহরের ফুটপাথ থেকে মাঠের কৃষক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। হানা দিয়েছেন শহরের সবচেয়ে বড় মাদক সিন্ডিকেটের আস্তানায়। হুমকি পেয়েছেন; হুমকি জয় করেছেন। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে এক বিন্দু টলেননি। সাধারণ মানুষের কাছে এক ন্যায়ের প্রতিপালনকারী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। সোহেল রানার মানুষের কাছে ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা শুধু মোবাইল কোর্টের বিচার ঘিরেই নয় বরং এক একটি অভিযানের মধ্য দিয়ে এক একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। পহেলা বৈশাখে রং ছিটানোর জ্বালায় রাস্তায় বের হতে পারত না মেয়েরা। ২০১৭ সালের পহেলা বৈশাখে একাই আটক করেন এরকম কয়েকজন বখাটেকে। নিজেই ছিনতাইকারীকে ধরে পুলিশে দিয়েছেন। শহরে বেড়ে ও ওঠা কিশোর অপরাধ দমনে কাজ করেছেন। এরকম অসংখ্য উদাহরণ খুজে পাওয়া যাবে যেখানে তিনি মোবাইল কোর্টকে শুধুই পেশার জায়গা থেকে না দেখে আর মাধ্যমে সামাজিক বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। সমাজে ন্যায়বিচারের ভার নিজের ছোট কাঁধে নিয়েছেন। ফলে মানুষের ধারণা হয়েছে যেখানেই অন্যায়, সেখানেই ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। এ যেন এই শহরের এক ন্যায়পাল। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন শক্ত প্রতিপক্ষের নাম সোহেল রানা। অন্যান্য সরকারি কর্মচারির মত গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে মানুষের সমস্যা সমাধানে অন্ত:প্রাণ হওয়ায় মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। একটি জেলার প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া একজন সরকারী কর্মচারীর এত বিপুল জনপ্রিয়তা একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। ২০১৮ সালের আগস্ট উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ফেনী থেকে বদলি হন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে সোহেল রানার একক নেতৃত্বে পরিচালিত ১৭৬ টি টাস্কফোর্স অভিযানে তিনি ১৪২ জনকে আটক করে ১২৮ জনকে কারাদন্ড প্রদান করেছেন। তার মাঝে নয়জন ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। অর্থাৎ প্রতি ১০০ অভিযানে সোহেল রানার আটকের হার ৮০.৬৮। যেখানে পুরো ফেনীর পুলিশ বাহিনী মিলে ১ বছরে তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী আটক ৯ জন ও প্রতি ১০০ অভিযানে আটকের হার ৩ এরও কম। পরিসংখ্যান বলছে এই ধরণের সাফল্যের হার জেলা প্রশাসনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ও পুরো প্রশাসনের ইতিহাসেই একটি অনন্য ঘটনা। তার দ্বারা পরিচালিত এই অভিযানের সাথে প্রচলিত মোবাইল কোর্ট অভিযানের রয়েছে ভিন্নতা। ব্যতিক্রমধর্মী ও গবেষণাধর্মী অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করেন তিনি। ধরেছেন ফেনীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হেরোইনের চালান, করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তার। অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে করেছেন এলাকা ছাড়া। সোহেল রানাকে নিয়ে রয়েছে হাজারো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গল্প। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাতামতির বাইরে শহরের আনাচে কানাচে তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য গল্প। গণমানুষের হৃদয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের। ফেনী শহর তথা ফেনী জেলার মানুষের হৃদয়ে ইতিহাসে একজন ন্যায়পাল হয়ে বেঁচে থাকবেন সোহেল রানা।

পিবিএ/এমএস

আরও পড়ুন...