এফ আর টাওয়ারে আগুন, আইইবি’র তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ

fr-tower
এফ আর টাওয়ার

পিবিএ,ঢাকা: আগুনে পুড়ে যাওয়া রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে অবস্থিত এফ আর টাওয়ারটি পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে শনিবার (৬ এপ্রিল) বিশদ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি)গঠিত তদন্ত কমিটি। আইইবি সভাপতি এই প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন।

আগুনের উৎপত্তি:

এ প্রতিবেদনে এফ আর টাওয়ারের ৮ম তলায় আগুন লাগার উৎস হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছে উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত রান্নাঘর ও এর পাশেই টাওয়ারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি কক্ষকে। এই কক্ষ দুটির যে কোনও একটিতে প্রথম আগুন ধরে বলে ধারণা করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। কারণ, এগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। আর আগুনের সূত্র হিসেবে বলা হয়েছে, গ্যাসের লিকেজ, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অথবা এয়ার কন্ডিশনারকে। এই তিনটি সূত্রের যে কোনওটি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে। টাওয়ারের মধ্যবর্তী কক্ষটি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কক্ষটিতে এয়ার কন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক তার, চেয়ার টেবিল ও কাপড় তৈরির সুতা ছিল। পাশের রান্নাঘরে ছিল গ্যাস বার্নার।

ভবনটির প্রায় প্রতিটি তলায় ন্যাচারাল ভেন্টিলেশনের যথেষ্ট অভাব ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এছাড়াও ভবনটি তৈরির সময় অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়গুলো মেনে চলা হয়নি উল্লেখ করে আগুনের উৎস এবং সেখান থেকে তা নেভানোর জন্য পানির উৎসের দূরত্ব, ধোঁয়া সৃষ্টির কারণ ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ পর্যালোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

আগুন/ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণ:

এফ আর টাওয়ারে কোনও অগ্নি নিরোধ দেয়াল ছিল না। ফলে উৎস যেখানেই হোক তা সব তলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে আগুন পুরো তলায় ছড়িয়ে পড়তে বেশ কিছুটা সময় লাগার কথা। তবে অতি স্বল্পতর সময়ে পুরো ৮ম তলায় ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যা সবাইকে জরুরি বহির্গমন করতে বাধ্য করে। তবে যাওয়ার সময় সম্ভবত ৮ম তলার অফিসের দরজা বন্ধ না করে সবাই বের হয়ে যায়। ফলে সামনের সিঁড়িঘর হয়ে যায় ধোঁয়া বহির্গমনের একমাত্র পথ যা ওপর তলায় অবস্থিত সবার বের হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি ৯ম ও ১০ম তলার মানুষজনও সিঁড়িঘর দিয়ে নামতে পারেনি। এক ঘণ্টার চেষ্টায় ১০ তলার টয়লেটের গ্লাস ভেঙে পাশের বিল্ডিংয়ের গ্রিল কেটে ৩০ জনের মতো বের হতে পারে। ২৬ জনের অনেকের মৃত্যু হয়েছে বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে এবং অক্সিজেনের অভাবে। আগুন অষ্টম তলা থেকে নবম ও দশম তলায় ছড়িয়ে পড়তে বেশ সময় লেগেছে। ফ্লোরগুলোতে আগুন ছড়ানোর পথ ছিল দু’টি। প্রথম পথটি ছিল উত্তর ও দক্ষিণের প্রশস্ত গ্লাস প্যানেল। গ্লাস তাপ অপরিবাহী এবং ভঙ্গুর। ফলে এ অংশ যখন তাপের সংস্পর্শে আসে এবং অন্য অংমের সঙ্গে তাপের পার্থক্য ঘটে তখনই ফাটল সৃষ্টি হয় ও ভেঙে যায়। অগ্নিকাণ্ডে বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রা ৬০০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে এবং গ্লাস সংশ্লিষ্ট অ্যালুমিনিয়াম প্যানেল গলে গেছে।

আগুন ছড়িয়ে পড়ার দ্বিতীয় পথটি ছিল ৮ম তলার দক্ষিণ পশ্চিম পাশের ফলস সিলিং এর ওপরে থাকা টয়লেট এর পিভিসি পাইপ। নিচে অতিরিক্ত আগুন ও তাপে পিভিসি পাইপ গলে ওপর তলার টয়লেট ও রান্নাঘরকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং আগুন নবম তলায় দক্ষিণ পাশে ছড়িয়ে পড়ে। ৯ম তলার উত্তর পাশে এবং ১০ম তলায় আগুন ক্ষতিগ্রস্ত গ্লাসের সাইড থেকে প্রবেশ করে এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ৮ম, ৯ম এবং ১০ম তলার গ্লাস প্যানেল গরম থাকায় তা যখন অগ্নি নির্বাপনে ব্যবহৃত ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শে আসে তখন সহজেই ভেঙে যায়।

নকশা প্রণয়ন ও ভবন ব্যবহারে ত্রুটি বিচ্যুতি:

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনটির নকশা প্রণয়নে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। ভবনে যে জরুরি বহির্গমন সিঁড়িটি আছে সেটার অবস্থান সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিপূর্ণ একটি স্থানে। জরুরি বহির্গমন সিঁড়িটি সাধারণ সিঁড়ির সমান্তরালে পাশাপাশি অবস্থানে। ফলে আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় যখন সিঁড়িঘর ও করিডোরটি ভরে যায় তখন জরুরি বহির্গমন পথটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এতে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই ধরনের একটি সিঁড়ি থাকা বা না থাকা একই কথা।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণে দুটি তলার মধ্যবর্তী অগ্নি সুরক্ষার জন্য যে উচ্চতার অগ্নি নিরোধক দেয়াল ছিল তা অপ্রতুল। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল গ্লাস দেওয়াল। যা সহজে ভঙ্গুর ও অগ্নি নিরোধক নয়। তাছাড়া ভবনের দুই পাশে থাকা অন্য ভবনগুলোর দূরত্ব ছিল দুই ফুটেরও কম। ভবনটি ব্যবহারে ইচ্ছামতো ভেতরের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে।

জরুরি বহির্গমন:

ভবনটির জরুরি বহির্গমন পথের কার্যকরী কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ভবনে অবস্থিত একমাত্র অবশিষ্ট জরুরি বহির্গমন সিঁড়িটি দুই ফুট ছিল যা জরুরি নির্গমনে ব্যবহার অযোগ্য। এছাড়া সিঁড়িটি ছিল চরমভাবে অবহেলিত। সিঁড়িটির সামনে করিডোরের জায়গা ছিল নামাজের স্থান, কোথাও ‘বড় সাহেবের খাবারের জায়গা’, কোথাও ছিল তালাবদ্ধ। তাছাড়া পথটি যাতে ধোঁয়ামুক্ত থাকে সেটা নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা ছিল না। সিঁড়িঘরটি ছিল অন্ধকার। এছাড়া ভবনটির জরুরি নির্গমন সিঁড়ি যে ছিল তা অনেকেরই জানাই ছিল না।

অগ্নিনিরোধ ব্যবস্থা:

ভবনে কার্যত কোনও অগ্নি নিরোধ ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না পানি ও পানি উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় ফায়ার পাম্প।

দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা:

এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আমাদের জন্য একটি অশনি সংকেত। এরকম শত শত ভবন হয়তো আছে ঢাকা অথবা দেশের অন্য কোনও শহরে। এই দুর্ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। শুধুমাত্র ভবনের অগ্নিরোধক ব্যবস্থা সংযোজন করলেই এর সমাধান হবে না। প্রতিটি ভবনের অগ্নিঝুঁকি মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এতে আরও মন্তব্য করা হয়েছে, এফআর টাওয়ারে শুধু অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ছিল তা নয়, নকশা প্রণয়নে ও ভবন ব্যবহারেও ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল। এজন্য সুউচ্চ ভবনের অগ্নিঝুঁকি সঠিকভাবে নির্ণয় ও তার প্রতিকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সুপারিশ:

এ অবস্থায় বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে আইইবি। এগুলো হচ্ছে:

১. ভবনের নকশা প্রণয়নে অগ্নিঝুঁকি কমানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

২. বিএনবিসি প্রণয়ন কমিটির সুপারিশকৃত সর্বশেষ খসড়াটিকে অনুমোদন করে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। তবে পুরানো কোড অনুযায়ী নির্মিত ভবনগুলো যাতে নতুন কোডে অবৈধ হয়ে না যায়, সে বিষয়ে নতুন কোডে যথাযথ নির্দেশনা থাকতে হবে।

৩. অনুমোদনের জন্য রাজউকের কাছে নকশা জমা দেওয়ার আগে ভবনের নকশা যোগ্যতা সম্পন্ন প্রকৌশলী, স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদকে দিয়ে রিভিউ করাতে হবে।

৪. সুউচ্চ ভবনের উলম্ব/আনুভূমিক বরাবর ফায়ার সেপারেশন ও কম্পার্টমেন্টেশন নিশ্চিত করতে হবে।

৫. সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বাইরে গ্লাস প্যানেল ব্যবহার করলে ভেতরে অগ্নি সুরক্ষার জন্য দেয়াল দিতে হবে।

৬. ভবনের ভেতরের ডিজাইন ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা যাবে না।

৭. বিএনবিসি অনুসারে ভবনে পর্যাপ্ত কার্যকরী অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। সিঁড়িগুলোতে অগ্নি সুরক্ষা দেয়াল দিয়ে আলাদা করতে হবে।

৮. জরুরি বহির্গমন সিঁড়িতে অগ্নি সুরক্ষা দরজা থাকতে হবে ও সিঁড়িঘরকে ধোঁয়ামুক্ত নিশ্চিত করতে হবে। অগ্নি সুরক্ষা দরজাটি কক্ষের ভেতর থেকে প্যানিক বার দিয়ে মানুষ নির্গমনের দিকে অবাধে খোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সিঁড়িতে পর্যাপ্ত আলো থাকতে হবে।

৯. অগ্নি নির্বাপক কাজে ব্যবহৃত পানির কল বা ফায়ার হাইড্রেন্ট দালান বা স্থাপনা থেকে ৫০ ফুট দূরত্বের মধ্যে স্থাপন করতে হবে।

১০ নতুন সুপারিশকৃত ড্যাপ জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন। আগের ড্যাপের আওতায় যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে নতুন ড্যাপের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি ব্যত্যয় ঘটে তাহলে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কারিগরি কমিটি দ্বারা যাচাই বাছাই করে সুপারিশের ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।

১১. প্রতিটি সুউচ্চ ভবনের জন্য একটি সেফটি কমিটি থাকতে হবে।

১২. বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে কোর্স/ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

১৩. রাজউকসহ অন্যান্য সেবাগ্রহণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমষ্টিগত সমন্বয় থাকতে হবে। অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করার সুযোগ এবং সিদ্ধান্ত পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে।

১৪. আগুনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করতে হবে।

পিবিএ/এফএস

আরও পড়ুন...