পিবিএ, ঢাকা : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ চলছে শীতের দেখা নেই। হালকা শীতের আমেজেই আপাতত খুশি থাকতে হবে। কারণ শীতের পথে বাদ সেধেছে জলীয়বাষ্প। এ জন্য বিভিন্ন সময় ঘনীভূত হওয়া নিম্নচাপ এবং অসময়ের ঝড়-বৃষ্টিকে দায়ী করেছেন তারা। তবে এবারে দেরিতে শীত আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেরিতে শীত আসলেও তার তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, তাপমাত্রা কমার ধারাবাহিকতায় জানুয়ারি মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিতে পারে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। এই সময়ে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। পৌষ মাসের শেষার্ধ ও মাঘ মাসের প্রথমার্ধ মিলে হবে জানুয়ারি মাস।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর জানাচ্ছে, রাজধানীতে শীতের আমেজ পুরোপুরি না এলেও দেশের উত্তরাঞ্চলে মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ ও সর্বোনিম্ন তাপমাত্রা কাছাকাছি আসা এবং সন্ধ্যায় বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে গত কয়েক বছরের তুলনায় উত্তরাঞ্চলে শীত একটু আগেই চলে আসছে। সারাদেশে কনকনে শীত আসতে আরো দেরি আছে। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, নভেম্বরের প্রথম দিকে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বেশ কিছু এলাকায় আগে শীতের অনুভব হতো।
তবে এ বছর মৌসুমি বায়ু কিছুটা দেরি করে এসেছিল, গেছেও দেরি করে। তাই শীতও আসছে কিছুটা দেরিতে। সারাদেশে শীতের প্রকোপ শুরু হবে মধ্য ডিসেম্বরে। তবে রাজধানীতে তা জেঁকে বসতে সময় লাগবে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা পর্যবেক্ষণে দেখেছি যে, অক্টোবরের তাপমাত্রা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। তাই বলা যায়, গত বছরের তুলনায় অক্টোবরটা বেশি গরম ছিল। এবার একটু আগেই শীত নামার সম্ভাবনাটা কম। শীত স্বাভাবিক নিয়মেই আসবে বলে আমরা মনে করছি।
এখন রাতের ও দিনের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, তিন মাসের দীর্ঘমেয়াদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে একটি মৃদু বা মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। জানুয়ারি মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে একটি মাঝারি বা তীব্র ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অন্যান্য স্থানে এক থেকে দুটি মৃদু বা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
৪ থেকে ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয় বলেও জানান সামছুদ্দিন আহমেদ।
এবার যে শীতের প্রকোপ বাড়বে একটি তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। ২০১৭ সালের অক্টোবরের সঙ্গে ২০১৮ সালের অক্টোবরের তুলনা করলেই আবহাওয়ার পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গত বছর অক্টোবরের প্রথম ১৫ দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছর একই সময়ে রেকর্ড করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেশিরভাগ দিনে তাপমাত্রা ২০ থেকে ২১ ডিগ্রিতে ছিল।
২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষ ১৫ দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২৮ অক্টোবর)। এ ছাড়াও দুই-তিন দিন তাপমাত্রা ১৭ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ছিল। চলতি বছর তা রেকর্ড করা হয়েছে ১৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২৫ অক্টোবর)। এ ছাড়াও অন্তত সাত দিন তাপমাত্রা ছিল ১৫ থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
একইভাবে ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রথম চার দিনের তাপমাত্রা ছিল ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। অন্যদিকে চলতি বছরের রেকর্ড করা হয়েছে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর কম হলে শীত টের পাওয়া যায়।
আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, নভেম্বরের এ সময় একটু একটু শীত অনুভূত হয়। দিনের তাপমাত্রা বেশি থাকে, কিন্তু ভোরবেলা বা সন্ধ্যাবেলায় ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। গ্রামে এই অনুভূতি বেশি। এটাকে ঠিক শীত বলা যাবে না, এটা হচ্ছে তাপমাত্রা কমে যাওয়া। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা যে কমছে সেটারই প্রভাব। অন্যান্য সময়েও মোটামুটি এমনটাই থাকে।
এবার বর্ষাকালে জুলাইয়ের পর বৃষ্টি কম হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বৃষ্টির সঙ্গে শীতের কোনো সম্পর্ক নেই। শীত বেশি হবে না কম হবে- সেটাও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আরিফ হোসেন বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (বর্ষা) দেশ থেকে চলে গেলে উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে বাতাস বাহিত হতে শুরু করে। এতে অক্টোবর থেকে তাপমাত্রা কমতে থাকে। শীতের বাতাস হিমালয় পর্বতমালা ও তিব্বত থেকে আসে। একটা বাতাস উত্তর-পূর্ব, আরেকটা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসে। এই বাতাস আমরা অলরেডি পাচ্ছি। বাতাসটা গতি নিয়ে প্রবাহিত হয় মূলত ডিসেম্বর থেকে।’
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান বিষুব রেখার উত্তরে। কিন্তু শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুব রেখার দক্ষিণে চলে যায়। এখন সূর্যের দক্ষিণায়ন চলছে। ২৩ সেপ্টেম্বরের পর থেকে সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয়। সূর্য বাংলাদেশ ও হিমালয় অঞ্চলের ওপর থেকে দক্ষিণে সরে গিয়ে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বরাবর থাকবে। এতে আমাদের দেশসহ হিমালয়ের দিকে সূর্যের তাপটা কম পড়বে।’
‘হিমালয় পর্বতমালার কারণে সেখানকার পুরো ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের এখানে আসে না। এটা আসলে আমাদের এখানে বরফ পড়ত। বাধা পেয়ে হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ দিক দিয়ে অল্প একটু প্রবাহিত হয়’- বলেন আবহাওয়াবিদ আরিফ। শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুব রেখার দক্ষিণে চলে যাওয়ায় তখন বাংলাদেশে দিন ছোট হয়। রাত হয় দীর্ঘ। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফশীতল বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কখনো কখনো তা তীব্র শীতের শৈত্যপ্রবাহে পরিণত হয়। সাধারণত হাড়কাঁপানো শীতের দেখা মেলে মাঘ মাসে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও কাছাকাছি শ্রীলঙ্কায় একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছে। এটি আরোও ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে।
পিবিএ/জেডআই