পিবিএ,ঢাকা: রূপালি পর্দা কাঁপানো নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে বাস্তবের নায়ক বানিয়েছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। এরই মধ্যে ২৫ বছর পূর্ণ করেছে নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচা। এই দীর্ঘ যাত্রার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, সংগঠনটির চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
প্রশ্ন: নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ২৫ বছর পূর্ণ হলো। আপনি এর আগেও এ আন্দোলনের শুরুর দিকগুলো নিয়ে বেশ কয়েকবার বলেছেন। এ প্রজন্মের পাঠক- দর্শকদের জন্য আবার কিছু বলুন।
ইলিয়াস কাঞ্চন: ১৯৯৩ সালে আমি বান্দরবান শুটিং করছিলাম। আমার স্ত্রী ( জাহানারা কাঞ্চন), আমার সন্তান, ও এটিএম শামসুজ্জামানসহ ঢাকার সোনারগাঁ হোটেলের এখান থেকে মাইক্রোতে করে বান্দরবান যাচ্ছিল আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। পথিমধ্যে একটি ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। চালক তাৎক্ষণিকভাবে মাইক্রোটি ঘুরিয়ে ফেলে। ফলে চালক বেঁচে যায়। কিন্তু আমার স্ত্রী মারাত্মকভাবে আহত হয় ও কিছুক্ষণ পরে মারা যায়।
ঐ প্রেক্ষাপটে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি আর সিনেমায় অভিনয় করবো না। আমার সন্তানদের বাবা মায়ের স্নেহ ভালবাসা দিয়ে মানুষ করব। ঐ সময় বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ আমার বাসায় এসেছিলেন আমাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য। তার মধ্যে একজন সাংবাদিক আমাকে বললেন, ইলিয়াস সাহেব, আপনি নাকি বলছেন, আপনি আর সিনেমায় অভিনয় করবেন না। কিন্তু আপনি কী জানেন, আজকেও অনেক লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত – আহত হয়েছেন। আমরা কিন্তু তাদের বাসায় যাইনি। আপনার বাসায় এসেছি। কেন এসেছি? কারণ, আপনি ইলিয়াস কাঞ্চন, জনপ্রিয় অভিনেতা। আপনি জনপ্রিয় হয়েছেন কারণ, এদেশের কোটি মানুষ আপনাকে ভালবাসে। আপনার স্ত্রীকে আপনি ভালবাসতেন। তাকে আপনি বাঁচাতে পারেন নি। কিন্তু এদেশের কোটি কোটি মানুষ যারা আপনাকে ভালবাসে, যারা প্রতিনিয়ত পঙ্গুত্ব বরণ করছে, প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে, তাদের বাঁচানোর জন্য তো আপনি কোন উদ্যোগ নিতে পারেন। আপনি তো এ বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারেন।
তখন আমি পনের দিন সময় নিলাম। ভাবলাম, এমন একটা আন্দোলন দাঁড় করালে কেমন হয়। সে আন্দোলন মানুষ নিবে কি না, জনসমর্থন মিলবে কিনা, চলচ্চিত্রে আমার যে অবস্থান তা টিকবে কিনা। পনের দিন পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আন্দোলন করব। আমি আমার সকল শুভাকাঙ্খীদের জানালাম, দনিরাপদ সড়ক চাইদ নামে আমি একটা আন্দোলন করব।
প্রশ্ন: নিরাপদ সড়ক চাই এ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো কী কী?
ইলিয়াস কাঞ্চন: মানুষের যে ধারণা ছিল, সড়ক দুর্ঘটনা ভাগ্যের ব্যাপার, আমরা সেই ধারণা থেকে মানুষকে বের করে আনতে পেরেছি। মানুষকে বুঝাতে পেরেছি, সড়ক দুর্ঘটনা মানুষের দ্বারা মানুষের অজ্ঞতার জন্য তৈরি। মানুষের অদক্ষতার জন্য, সড়ক ব্যবহারে নিয়মকানুন না মানার জন্য তৈরি। আইন না মানার জন্য তৈরি। সড়কের ডিজাইন ভুল হওয়ার জন্য তৈরি। আনফিট গাড়ী, আনফিট চালক এর জন্য দায়ি। এমনকী যারা গাড়ির মালিক, যারা পরিচালনা করেন, তাদের পরিচালনার ব্যর্থতাও এর জন্য দায়ি। এবিষয়গুলো মানুষ এখন বুঝে। ফলে দেশের বেশীরভাগ মানুষ আমাদেরকে সমর্থন করছে। সরকারও তা বুঝতে পারছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য তারা নানা কার্যক্রম গ্রহণ করছে। আমাদের আন্দোলনে আমরা হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশ দাবি করেছিলাম। সেটি বাস্তবায়িত হয়েছে। আমরা ন্যাশনাল রোডস কাউন্সিল দাবি করেছিলাম। সেই দাবি পূরণ হয়েছে। আমাদের আন্দোলনে নতুন আইন প্রনয়ণ হয়েছে। আমাদের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য আমাদের সন্তানরা রাস্তায় নেমে আমাদের আন্দোলনকে বেগবান করেছে।
প্রশ্ন: নিরাপদ সড়ক আমরা সবাই চাচ্ছি। কিন্তু এর প্রধান অন্তরায়গুলো কী বলে মনে করছেন আপনার অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমাদের মধ্যে এখনো অজ্ঞতা রয়ে গেছে। পুরনো ধ্যান ধারণা রয়ে গেছে। সড়কে যারা ব্যবসা করে, গাড়ি চালায় তাদের মধ্যে পুরনো ধ্যান ধারণা রয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত তারা উদার হতে পারছে না। তারা ভাবছে, আইন মানেই শাস্তির বিষয়। দেশে অনেক আইন আছে। খুনের মামলার আইনতো সবার জন্যই সমান। তাই বলে আমরা সবাই কী ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ছি? আমার যদি লাইসেন্স বিহীন আর্মস থাকে তাহলে কী সরকার আমাকে এ্যারেস্ট করবে না? ঠিক তেমনি একটি গাড়ীর চালকের যদি লাইসেন্স না থাকে তাহলে তাকে পুলিশ এ্যারেস্ট করবে না কেন? একজন গাড়ী মালিক আনফিট গাড়ি রাস্তায় নামাবে এটা কীভাবে সম্ভব? তার কারণে যদি কারো জীবন চলে যায়, তার বারণে যদি কাউকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় তাহলে কী তাকে শাস্তি পেতে হবে না? সে অন্যায় করবে আর অন্যায়ের শাস্তি পাবেনা? তাছাড়া আমরা শুধু একপক্ষকে দোষারোপ করছি তা না। বরং বলছি, যে দায়ি, যার জন্য দুর্ঘটনা ঘটবে শাস্তি তাকেই পেতে হবে। সে পথচারী হতে পারে, যাত্রী হতে পারে, মোটর সাইকেল চালক হতে পারে, যারা সড়কের ডিজাইন করছেন তারাও দায়ি হতে পারে। বিআরটি- এর যারা লাইসেন্স প্রদান করছেন তারাও দায়ি হতে পারে। যারা আইন প্রয়োগ করছেন তাদের কারণে হতে পারে।
প্রশ্ন: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আওয়াজ উঠেছে “নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন- কে সিটি মেয়র হিসেবে দেখতে চাই”। আবার কেউ কেউ বলছেন, আপনি আগামীতে নির্বাচন করবেন। এ ব্যাপারে আপনার পরিকল্পনা কী?
ইলিয়াস কাঞ্চন: না, আমি কখনো রাজনীতি ও নির্বাচন করব না। রাজনীতি বা নির্বাচন করার জন্য আমি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন করিনি। আমি বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না ছবির নায়ক। আমি জানি আমার জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে ছিল। নির্বাচন করার খেয়াল থাকলে ২৫ বছর আগেই করতাম। আমি চেষ্টা করছি পরিবহন মালিক, চালক, পরিবহন শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী- সকলকে সচেতন করে একটা নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করতে।
পিবিএ/জেআই