“কড়াইল বস্তিতে চাঁদাবাজি ও আ’লীগের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে খুন”

পিবিএ,ঢাকা: রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তিতে ৪০ হাজার অবৈধ ঘর রয়েছে। এসব ঘর থেকে ভাড়া, বিদ্যুত, গ্যাস, পানির আলাদা আলাদা টাকা তোলা হয়। পাশাপাশি এসি, ফ্রিজ চালাতেও দেওয়া লাগতো। আর এই টাকা সরকারি কোষাগারে না গিয়ে চলে যায় নিয়ন্ত্রণ করা মধ্যস্বত্ব ভোগী একটি গ্রুপের কাছে।

বস্তিতে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খান ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল মফিজুর রহমান গ্রুপের মধ্যে এই বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্ধ থেকেই যুবলীগ কর্মী আল আমিন খুন হন।

খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ এসব তথ্য জানতে পেরেছে।

বৃহস্পতিবার যুবলীগ কর্মী হত্যায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার ও ঘটনার তদন্ত নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবি প্রধার মোহাম্মাদ হারুন অর রশীদ।

তিনি বলেন, কড়াইল বস্তিতে কমিটি গঠন এবং বিভিন্ন বিষয়ে চাঁদাবাজিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। আলামিন হত্যায় পাঁচজনকে ২২ ও ২৩ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারা পাঁচদিনের রিমান্ডে রয়েছে।

আলামিন হত্যায় জড়িত গ্রেফতার পাঁচজন হলেন, মোহাম্মদ আলী, মো. খাজা, মো. আমজাদ হোসেন, মো. হুমায়ুন কবির রাসেল এবং মাসুদ আলম। মারামারির কাজে ব্যবহৃত বড় ছোঁরা, চাপাতি ও ডিস্ক কুড়াল, লোহার রডসহ দেশী অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রধান জানান, কড়াইল বস্তির বিভিন্ন ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের মাধ্যমে বস্তির ঘরভাড়াসহ অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাস ও পানির বিলের টাকা আদায় নিয়ন্ত্রনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ আগস্ট রাতে বস্তির এরশাদ মাঠ এবং নূরানী মসজিদ এলাকায় নুরু- কবির-আলী গংয়ের সাথে রিপন-জুয়েল-শুভ গংয়ের মারামারির ঘটনায় আলামিন মারা যায়। এছাড়া এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের প্রায় ১০ জন ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং আরও অনেকে আহত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। কড়াইল বস্তি এলাকার রিক্সা শ্রমিক, পরিছন্নতাকর্মী, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ নিম্নজীবী মানুষ বসবাস করে।

মূলত টিএন্ডটি, গণপূর্ত ও ওয়াসা ইত্যাদি সরকারি সেবা সংস্থার জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার ঘর। এ সব ঘর অবৈধভাবে নির্মাণ, বরাদ্দ এবং হস্তান্তরে মোটা অংকের চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। ঘরগুলোতে অবৈধভাবে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি চলে আসছে দীর্ঘদিন। এছাড়া ডিস সংযোগ , ইন্টারনেট সংযোগ, ময়লা বাণিজ্য প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও টাকা তোলা হয়। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ছত্রছায়ায় এ চাঁদার টাকা তোলে এবং ভাগ-বাটোয়ারা হয়।

ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, দুটি গ্রুপ এই চাঁদাবাজি করে থাকে। এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রায় প্রতিবছর খুনাখুনি হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

যেভাবে দ্বন্দ্বের শুরু; কড়াইল বস্তি মূলত ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯ এবং ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত। যার শতকরা ৯০ ভাগ পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার মধ্যে। মফিজুর রহমান এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কড়াইল বস্তির ১৯ নাম্বার ওয়ার্ডের সাতটি ইউনিটে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুইটি গ্রুপের বিবাদ চলে আসছে। গত ২২ জুলাই সাতটি ইউনিটের কমিটি হয়। সেগুলো হল কড়াইল উত্তর-১, কড়াইল উত্তর-২, কড়াইল বউবাজার -পূর্ব, কড়াইল বউবাজার- পশ্চিম, কড়াইল- মশার বাজার, কড়াইল- গোডাউন বস্তি এবং কড়াইল -স্যাটেলাইট ইউনিট। আওয়ামী লীগ এই সাতটি কমিটির বেশিরভাগ পদে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খানের গ্রুপের প্রাধান্য পাওয়ায় স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজের গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের অনুসারীদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র একটি ইউনিটের সভাপতি এবং আরেকটি ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছে। বাকিরা সব অন্য গ্রুপের।

ডিবি জানায়, নুর আলম নুরু কড়াইল উত্তর-২/দক্ষিণ ইউনিটের সহ-সভাপতি হওয়ায় এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে এবং মফিজ গ্রুপের জসীমউদ্দীন রিপনকে সেক্রেটারি পদ না দিয়ে রফিকুল ইসলাম ওরফে রাজুকে সেক্রেটারি করায় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

দীর্ঘদিন যাবত স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের নেতারা চাঁদাবাজির টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রেক্ষাপটে নবগঠিত কমিটির নেতারা নতুন করে মাঠ দখলের অংশ হিসেবে নিয়মিত মহড়া করতে থাকে। গত ১৭ আগস্ট এশার নামাজের আগে কাদের খান গ্রুপের নুরু- আলী- কবির গ্রুপের মহড়ার এক পর্যায়ে তারা রিপন-জুয়েল গ্রুপের আওলাদকে সামনে পেয়ে মারধর করে। অল্প সময়ের মধ্যে উভয় গ্রুপের লোকজন দল ভারী করে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এশার নামাজ চলাকালে নুরু গ্রুপের আমজাদ এবং ভাইস্তা মাসুদ নূরানী মসজিদে নামাজ পড়াকালীন রিপন – জুয়েল গ্রুপের লোকেরা মসজিদে গিয়ে তাদেরকে প্রথমে জিআই পাইপ এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে হাত ভাঙ্গাসহ মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কুপায়।

নুরুর নেতৃত্বে ভাইগ্না আলী, মোহাম্মদ আলী , কবির, আজিজুল, খাজা , আমজাদ গং আরো হিংস্র হয়েও উঠে একাধিক ঘর এবং দোকানও ভাঙচুর করে। নুরু এবং কবির ছোরা এবং চাপাতি নিয়ে আলামিন এবং নাসিরকে হত্যার উদ্দেশ্যে ই কুপিয়ে জখম করে। নাসির এবং আলামিন দৌড়ে মসজিদে প্রবেশ করলে সেখানেও তাদেরকে আক্রমণ করে।

গুরুতর আহত আলামিন প্রথমে ভাংগাড়ীর দোকান এবং পরে এরশাদ মাঠের একটি ফার্মেসির দোকানে ঢুকলে সেখানেও তাকে কুপিয়ে যখম করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠলে সেন্টু রিকশাওয়ালা কে মারধর করে। এ সময় খাজা এবং আমজাদ এসে আলামিনকে আবারও মারধর করে এবং হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়। পরবর্তীতে রিক্সাওয়ালা সামনে একটি রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল পেয়ে তড়িঘড়ি করে আলামিনকে তুলে দিয়ে প্রথমে মেট্রোপলিটন হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে আলামিন মারা যায়। উভয় পক্ষের নাসির, নুরু সহ প্রায় ১০ জন গুরুতর আহত হয়।

চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ; লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজির এ নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফিরে ফিরে একের পর এক সহিংসতা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে কড়াইল বস্তিতে। ২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি ,বিদ্যুৎ ,গ্যাস প্রভৃতির সেবা/সংযোগ- এর অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকান্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই ইস্যুতে নিহত হয় রাশেদ কাজী নামে একজন পলিটিক্যাল এক্টিভিস্ট কাম চাঁদাবাজ। সর্বশেষ ২০২২ সালে আলামিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরো একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং সহিংস ঘটনা ঘটেছে।

আরও পড়ুন...