অ আ আবীর আকাশ : বর্ষা যেমন প্রকৃতিতে সূচি শুদ্ধতা দিয়ে আসে তেমনি বর্ষার অলংকার হিসেবে কদমফুল তার আপন মহিমায় নিজেকে সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে মেলে ধরে। কদম্ব বা কদম ফুল যে নামেই ডাকা হোক অন্যান্য ফুলের এত নামডাক নেই বর্ষা ঋতুতে। বর্ষা ঋতুর প্রথম প্রহরেই কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে, প্রকৃতি প্রেমীদের মাঝে কদম ফুল নিয়ে বেশ মাতামাতি হয়। লেখালেখি হয় কবিতা ছড়া গল্প। বর্ষায় কদম ফুল এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আছে। কদম ফুলের রূপ-সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে আবেগ-অনুভূতি ভালোলাগা ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে তৈরি করেন কদম ফুলের সম্মোহনী উপখ্যান। কদম ফুল নিয়ে আমার যেমন শৈশব-কৈশোরে বহু স্মৃতি রয়েছে তেমনি কদম ফুল নিয়ে নানা তথ্য উপাত্ত জেনেছি এই সময়ে এসে।
ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজে কদমফুল নিয়ে যেমন মাতামাতি করেছি তেমনি কদম ফুলে গাছের ছাল পাতার ঔষধি ব্যবহার জেনেও অবাক হয়েছি। বর্ষায় কদম ফুলের পাপড়ি আলাদা করে একে অপরের গায়ে ছিটিয়ে কি যে আনন্দ উদ্দীপনায় মেতে থাকতাম সে কথা কি ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো সম্ভব? কমদফুলের রুপে মজে আমার লেখা-
“সেবার আসমানে মেঘ দেইখা/মাস্টররা ইশকুল ছুটি দিয়া দিছে।/বইগুলান ব্যাগে পুইরা কাধে ফালাইয়া
দিলাম ছুট!/খাল পাড়ে আইসা কদমফুলে চোখ পড়তেই/ব্যাগ রাইখাই প্রতিযোগ শুরু হইছে-/কে কার আগে কদমফুল লইবো।/পাশের গাছ দিয়া বাইয়া উঠে ডাল-ডুল ভাইঙ্গা/দশ-বারোটা কদমফুলের গোল্লা
কান্ডসহ ছিঁড়া লইছি।/বাড়ীত যাইয়া ভাত-টাত না খাইয়াই কদমফুলের পাপড়ি খুইলা মালাতে/জমাইলাইছি- ভেতরের মনোহর বলে/শলা ডুকাই আম পাতায় জোড়া লাগাই/রেল গাড়ী বানাইয়া খোলে বাইন্ধা এলাকায় ঘোরাঘুরি।/এমন স্মৃতি মনে রাইখাই বাঁইচা আছি/কদমফুল তুমি ভালোবাসা/মনের গহীনে অন্ধকারে কদমফুল/ডীনলাইট হইয়া জ্বইলা আছে।”
শিরোনাম “কদমফুলের গাড়ী”।
বর্ষাকে স্বাগত জানিয়ে কদম ফুলকে নিবেদন করে কবি’র এই আহ্বান। বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে আসে কদম ফুল। কদম যেন বর্ষার দূত! আষাঢ়ের সঙ্গে কদমের সম্পর্ক নিবিড়। সাধারণত আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতেই কদম ফোটে। প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে কদম ফুল। গোলাকার সাদা-হলুদ রঙের ফুলটি দেখতে ছোট বলের মত। গাছ ভরে এই ফুলের সমাহার ঘটে। সেই মুহূর্তটি এক অপূর্ব সৌন্দর্যের।
কদম ফুল নীপ নামেও পরিচিত।
এ ছাড়া বৃত্তপুষ্প, মেঘাগমপ্রিয়, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবল্লভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, সর্ষপ, ললনাপ্রিয়, সুরভি, সিন্ধুপুষ্পও কদমের নাম। এর আদি নিবাস ভারতের উষ্ণ অঞ্চল, চীন ও মালয়ে। বিশ্বের নানা দেশে কদমগাছ দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, কম্বডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়ায় এই বৃক্ষ রয়েছে।
বর্ষার আগমন যখন চারপাশে, তখন তার সঙ্গী হতে গাছে গাছে দেখা মিলে আরেক অতিথির। গ্রীষ্মের প্রখরতা কমাতে যখন আম, জামসহ নানা ফলের ঘ্রাণে মুখর চারপাশ, তার পরই আগমন ঘটে বর্ষার সঙ্গী কদম ফুলের।
কদমের সংস্কৃত নাম কদম্ব। কদম্ব মানে হলো দয়া, বিরহীকে দুঃখী করে! প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে কদম ফুল। মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্য জুড়ে রয়েছে কদমের সুরভী মাখা রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাঁথা! ভগবত গীতা থেকে শুরু করে লোকগাঁথা, পল্লীগীতি ও রবীন্দ্র-কাব্য পর্যন্ত কদম ফুলের উল্লেখ রয়েছে। ভানুসিংহের পদাবলি, বৈষ্ণব পদাবলি ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে এসেছে কদম গাছের কথা। বহুল উপমায় বিভূষিত তার গুণগাথা।
কদম গাছ নিয়ে গ্রামবাংলার নানা ছড়া-কবিতাও রয়েছে। ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদম তলায় কে/হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামণির বে’- এমন বহু ছড়ায় এখনও কদমের সুষমা প্রকাশ পায় মানুষের মুখে মুখে। কদমগাছ বৌদ্ধধর্মের একটি পবিত্র গাছ। ভারতের পূর্বাংশে ভগবান কৃষ্ণের সঙ্গে জড়িত কদমগাছ। শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলা থেকে শুরু করে রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদ- সবকিছুতেই রয়েছে কদম গাছের নাম। আকাশজুড়ে কখনও কালো মেঘের ঘনঘটা কিংবা এক চিলতে রোদের মুখ কালো মেঘের ভিড়ে অথবা হঠাৎ করেই মুষলধারায় বৃষ্টি! জ্যৈষ্ঠের প্রখর রোদের পরে এমন প্রশান্তিই বলে দেয় বর্ষাকালের আগমন বার্তা। আষাঢ়-শ্রাবণ মূলত এ দুই মাস বর্ষাকাল। বাংলার পল্লী প্রান্তরে কদম গাছ দেখতে যায়। কদম গাছ দীর্ঘাকৃতি এবং বহুশাখাবিশিষ্ট। রূপসী তরুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কদম। কদমের কা- সরল, উন্নত, ধূসর থেকে প্রায় কালো এবং বহু ফাটলে রুক্ষ, কর্কশ। শাখা আজর এবং ভূমির সমান্তরালে প্রসারিত। পাতা হয় বড় বড়, ডিম্বাকৃতি, উজ্জ্বল-সবুজ, তেল-চকচকে। এর বোঁটা খুবই ছোট। নিবিড় পত্রবিন্যাসের জন্য কদম ছায়াঘন। এই গাছের উচ্চতা ৪০-৫০ ফুট পর্যন্ত হয়। শীতে কদমের পাতা ঝরে এবং বসন্তে কচি পাতা গজায়। কদমের কচি পাতার রঙ হালকা সবুজ। কদমের একটি পূর্ণ মঞ্জরিকে সাধারণত একটি ফুল বলেই মনে হয়।
কদম ফুল দেখতে বলের মতো গোল, মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস। এই ফুলের রং সাদা-হলুদে। তবে পাপড়ি ঝরে গেলে শুধু হলুদ রঙের গোলাকার বলের মত দেখা যায়। এই গাছের ফল মাংসল, টক এবং বাদুড় ও কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাদ্য। যদিও কাঠ বিড়ালী এখন বিলুপ্ত প্রাণী। বাদুড় এ অঞ্চল থেকে প্রায় বিলুপ্তির পথে।কদম গাছের ফুল ছাড়া আরও রয়েছে ফল। এ ফলগুলো দেখতে অনেকটা লেবুর মতো। কদম গাছের পাতা শীতকালে ঝরে যায় আর কচি সবুজ পাতা নিয়ে আগমন ঘটে বসন্তের। কদম ফুলের আছে আরও অনেক নাম। ললনাপ্রিয়, সুরভী, কর্ণপূরক, মেঘাগমপ্রিয়, বৃত্তপুষ্প ছাড়াও নীপ মানে পরিচিত এ কদম ফুল। কদমের একেকটি গাছ ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর সবুজ ঝরঝরে পাতার মাঝে থাকা গোলাকার কদম ফুল বর্ষা স্নানে আরও রূপসী হয়ে উঠে। কদম ফুল ছাড়া কদম গাছও বেশ উপকারী। সরু সবুজ পাতার ডালে ডালে গোলাকার মাংসলো পুষ্পাধার আর তার থেকে বের হওয়া সরু হলুদ পাপড়ির মুখে সাদা অংশ কদমকে সাজিয়ে তুলেছে ভিন্নভাবে।
একটি ফুলের মাঝে এত ভিন্নতার ছোঁয়াতে কদমফুলকে করে তুলেছে আরও গ্রহণযোগ্য। ফুলে ভরা কদমগাছ দেখতে অসাধারণ হলেও এর আর্থিক মূল্য তেমন একটা নেই। তাই কেউ গুরুত্ব দিয়ে কদম গাছ লাগায় না। প্রাকৃতিকভাবে যে গাছগুলো হয়ে থাকে অনেকে সেগুলোও কেটে ফেলে। কাঠ নরম বলে আসবাবপত্র তৈরি করা যায় না। কাঠ দিয়ে দেয়াশলাই ও বাক্সপেটরা তৈরি হয়ে থাকে। গাছের ছাল জ্বরের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাতার রস ছোটদের কৃমির জন্য খাওয়ানো হয়। ছাল ও পাতা ব্যথানাশক। মুখের ঘায়েও পাতার রস কার্যকর। কোনো কোনো অঞ্চলে কদম ফুল তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়।
‘কদম’ শব্দটির যদিও বহুবিধ ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়-মানুষের নাম থেকে শুরু করে মিষ্টি, চুলের ছাঁট, জায়গার নাম পর্যন্ত। বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল হয়তো পাওয়া যাবে না, যেখানে একটা-দুটো কদমতলী নেই। হাঁটা বা পা অর্থেও কদম শব্দের বহুল ব্যবহার আছে। কিন্তু সবরকম অর্থে ব্যবহার পেরিয়ে এই ‘কদম’ বাংলায় সর্বাধিক পরিচিত ফুলের নাম হিসেবেই। ফুল হিসেবেই কদম ছড়িয়ে আছে বাংলার আনাচে-কানাচে। তবে নাম যা-ই হোক, বাংলার বাদল দিনের কদমের কথা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সুন্দর করে আর কে-ই বা বলতে পেরেছে।
‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই প্রকৃতি পর্যায়ের গানের চরণ যেন দিনে দিনে আধুনিক জীবনে বর্ষা আবাহনের অনন্য ব্যঞ্জনায় পরিণত হয়েছে। যদিও সেই প্রথম কদম ফুল আজ আর বাদল দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে না। দিনপঞ্জির হিসেবে বর্ষা আসার আগেই সে প্রস্তুত হয়ে থাকে বাদল দিনের আগমনী বারতা নিয়ে। বাংলার বনে বনে বর্ষার বারিধারায় কদম ফুলের রেণু হয়তো এখনও ভেসে যায়। ভেসে ভেসে নদী-নালা-খাল-বিলে মিশে যায় কদমের অজস্র পাপড়ি। গাছে গাছে বর্ষার বাহারি ফুলের সঙ্গে ভিজে আরও দ্বিগুণ স্নিগ্ধতায় হেসে উঠে কেয়া-কদম। কদম গাছ ছাড়া কি গ্রাম হয়! সেখানে এরা অবহেলা-অনাদরেই বাড়ে ও বাঁচে। একসময় লোকালয়ের অগভীর বন-বাদাড়ে অঢেল ছিল। এখন সংখ্যায় কমে গেলেও বর্ষা এলেই কদম গাছের দিকে চোখ না ফেলে উপায় থাকে না। গাছজুড়ে একটা সুষম সমন্বয়ে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকে হলদে শরীরে সাদা সাদা বৃষ্টির মতো পাপড়ি নিয়ে বর্ষার কদম। খাল-বিলের উপচেপড়া জল যেমন শাপলাকে সাজিয়ে তোলে, ভাসিয়ে রাখে, তেমনি পরিবেশকে মাতিয়ে তোলে বর্ষার কদম ফুল। বর্ষা মানেই গুচ্ছ গুচ্ছ কদম ফুলের মিষ্টি সুবাস। তৃষ্ণায় কাতর বৃক্ষরাজি বর্ষার অঝোর ধারায় ফিরে পায় প্রাণের স্পন্দন। প্রাণীকুলও হয়ে ওঠে সজীব ও সতেজ। কিংবা বৃষ্টির অঝোর ধারায় মেঘের বিছানা পেতে দেওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ আজও হয়ে ওঠে স্মৃতিকাতর।
সবুজ পাতার মধ্যে সাদা-হলুদ মঞ্জরির ফুলের চিরচেনা কদম গাছ এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কদম ফুল। বাংলার বিভিন্ন জেলায় এক সময় প্রচুর কদম গাছ চোখে পড়ত। যান্ত্রিক সভ্যতা ও নগরায়নের যুগে মানুষের সামান্য প্রয়োজনে কদম গাছকে তুচ্ছ মনে করে কেটে ফেলছে। কদম ছাড়া বর্ষা একরকম বেমানান। প্রকৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে অন্য গাছের পাশাপাশি কদম গাছ রোপণ করা প্রয়োজন।
এসেছে কদম ফুলের দিন। চলছে আষাঢ়। বৃষ্টি যদিও থেকে থেকে ঝরেছে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে। তবুও বর্ষার নিজের মাস আষাঢ়। আর আষাঢ়ের বর্ষা-প্রকৃতির অনন্য অলঙ্কার কদম ফুল। কদম যেন বর্ষা ঋতুর প্রতীক। এবারের গ্রীষ্ম আগুন নিয়ে এসেছিল শহর-গ্রামে সবখানে। সেই অগ্নিদগ্ধ দিন পেরিয়ে এসেছে কাক্সিক্ষত বৃষ্টিধারার আষাঢ়। আষাঢ়ে দেখা যায় গাছের পাতায়, টিনের চালে কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার দিন। বর্ষা মানেই কর্দমাক্ত রাস্তা আর গাঁয়ের দস্যি ছেলেদের কদম ফুল নিয়ে হৈ-হুল্লোড়। পাপড়ি গুলো আলাদা করে একে অপরের গায়ে ছিটানো, গাড়ি বানিয়ে মেঠো রাস্তায় চালানো, কি যে আনন্দ উদ্দীপনা হায়রে লাফালাফি ঝাপাঝাপি এই কদমফুল নিয়ে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক।