লেখক অলোক আচার্য: বিশ্বে করেনার মহামারী চলছে। বেকারত্ব ও দারিদ্রতা ঘিরে ধরছে পৃথিবীকে। উল্লেখযোগ্য হারে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এর প্রভাব পরছে মানুষের জীবন যাপন, ক্রয় ক্ষমতায়। মানুষ বাধ্য হচ্ছে জীবন যাপনের মানে পরিবর্তন আনতে। করোনায় লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝরে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই সংখ্যা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। কোথায় গিয়ে এর তান্ডব থামবে তা হয়তো কারোরই জানা নয়। তবে একসময় তা শান্ত হবে। গত জুন মাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যু দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ ছুটি শেষে এখন জোনভিত্তিক লক ডাউন চলছে। কারণ জীবন জীবিকা দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা যায় না। কিন্তু এখন সবকিছু চললেও তা অনেকটাই থেমে থেমে। অনেকে যা সঞ্চয় করেছিল তাও কারো কারো শেষ হওয়ার পথে। ফলে ভবিষ্যতে কি হবে তার উত্তর অনেকের কাছেই নেই। সমাজের বিত্তবানরা হতদরিদ্রদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব মানুষের সংখ্যা নেহায়েত অল্প নয় যে তা রাতারাতি সবাইকে করা সম্ভব হবে। বেকারত্ব ঘিরে ধরছে এবং সেই সাথে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে। চাকরি হারানোর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যা দারিদ্রতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলছে। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর করোনা যেন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা। করোনাকালে পরিবর্তন হচ্ছে পেশা,জীবন ও জীবিকা। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা অনেকেই চাকরি হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। শহরের জীবন ফেলে ফিরছেন গ্রামের জীবনে। খরচ বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক চাকরিজীবির বেতন কমে গেছে বা একেবারেই পাননি।
যারা বাসা ভাড়া করে থাকতো তারা বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে কেবল বাসা ভাড়ার খরচ বাঁচাতে। সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করতে হচ্ছে। হয়তো তার সন্তান যে স্কুলে পড়ালেখা করতো সেখানে আর তারা পড়তে পারবে না। করোনা ভাইরাস পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। এই প্রভাব পরছে মূলত নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের জীবন যাত্রায়। ফলে মানুষ জীবন যাপন প্রক্রিয়া বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবিদের ক্ষেত্রে চাকরিচুত্যি,কম বেতনে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই যেন করোনাকালে একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসতে চলেছে তা খুব দ্রুতই শেষ হবে না। পরবর্তী দশকে অর্থনীতির এই ধারা বিশ^কে ভোগাবে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অর্থনীতিকে করোনার প্রভাব নিয়ে চিন্তা করতে হবে কয়েকটি দিক থেকে। বিবিসি রেডিওতে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিশ^ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যালপাস বলেন, করোনা ভাইরাস বিশে^র ৬ কোটি মানুষকে নতুন করে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। এ ৬ কোটির বেশি মানুষকে প্রতিদিন এক ডলারের কম অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হতে পারে। তিনি আরো বলেন, করোনা ভাইরাস অর্থনীতির জন্য এক বিধ্বংসী আঘাত। এটি ঠেকাতে লকডাউন শতকোটি মানুষের জীবন ও জীবিকায় প্রভাব ফেলেছে যা উদ্বেগজনক। তিনি আরও বলেন যে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ কেবল বেকারই নয়, অনানুষ্ঠানিক কার্মক্ষেত্রও হারাচ্ছে।
বিশ^ব্যাংক ও তার সহযোগীরা ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তবে এটা যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ঋণ ও ত্রাণ দেয়ার আহবান জানান তিনি। দারিদ্রতা মানুষের এমন এক অবস্থা যে তা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন দরকার হয় এবং সেই সাথে পর্যাপ্ত সুযোগের। প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থধান সৃষ্টি করারটাও সময়সাধ্য। কারণ এরই মধ্যে নতুন করে চাকরিরর বাজারে প্রবেশে অপেক্ষায় থাকবে অনেকে। পোশাক শিল্পে কর্মী ছাটাই হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক খাতে প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে করোনা কারণে ৭ কোটি মানুষ কর্মহীন এবং দারিদ্র্যসীমায় রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারি হিসেবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। করোনার কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরো ২২ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে হবে ৪৩ শতাংশ। করোনার কারনে নিন্ম আয়ের মানুষের ওপর চাপ বেড়েছে। অবস্থা এমন যে দারিদ্র্যতা আরও দারিদ্র্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ নিন্ম আয়ের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। যা দারিদ্র্যতা সমস্যাকে আরও প্রকট করবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) এর পূর্বাভাস মতে, চলতি অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে দেশে দারিদ্র্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি বেড়েছে আয় ও ভোগ বৈষম্য। মন্দার যে পূর্বাভাস বইতে শুরু করেছিল তা শুরু হয়ে গেছে। এবারের বিশ^ মন্দা ছাড়িয়ে যাবে ২০০৯ সালের মন্দাকেও। জীবনধারা পরিবর্তনের এই ধারা রোধ করা বা এর লাগাম টেনে ধরা সহজ হবে না। কারণ সবার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা বরাবরই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সেক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় যেমন যারা করোনার পূর্বেই বেকার ছিল, করোনার সময়ে যারা চাকরি হারিয়ে বেকার হলো এবং যারা আগামীতে চাকরির বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসছে এই তিন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে হবে। অর্থাৎ একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। করোনাকালের মহামারী আর কতদিন পৃথিবীতে বিরাজ করবে তা বলা সম্ভব না। কয়েকটি দেশের ভ্যাকসিন ট্রায়ালে রয়েছে। হয়তো খুব দ্রুতই চূড়ান্ত সফলতা আসবে। ততদিনে নতুন করে দারিদ্রতার শিকার হবে আরও বহু মানুষ। জীবন যাপন পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। চেনা শহর ছেড়ে নতুন ঠিকানায় পাড়ি জমাবে। সবকিছুই চলবে পরিবর্তনের নতুন ধারায়।
পিবিএ/এসডি