আমজাদ হোসেন শিমুল: করোনা ‘ল্যাটিন’ শব্দ। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় ‘বীরের মুকুট’। করোনা সত্যিই যেন ‘মুকুট’ পড়ে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে ওড়াচ্ছে তার ক্ষত্রিয়ের বিজয় কেতন! হিংস্র দানবের মূর্তপ্রতীক নিয়ে ইতোমধ্যেই পৃথিবী থেকে করোনা কেড়ে নিয়েছে তিন লাখ ছুঁই ছুই তাজা প্রাণ! দানবের মূর্তি ধারণ করে পাকড়াও করেছে প্রায় অর্ধকোটি মানবকে! আর সেই সাথে বিশ্বের সাড়ে ৭’শ কোটির অধিক মানুষকে করে রেখেছে ঘরবন্দি!
করোনার নির্মম ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে পারেনি পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ প্রিয় মাতৃভূমি ছোট্ট বাংলাদেশ! ইতোমধ্যেই দেশে পৌনে তিন শত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে ঘাতক করোনা! আক্রান্ত করেছে ১৭ হাজার মানুষকে। অদৃশ্য এই শক্তিটি দেশের ১৭ কোটি বাঙালিকে দেড় মাসেরও অধিক সময় ধরে করে রেখেছে গৃহবন্দি! দিন যতই গড়াচ্ছে বাংলাদেশে করোনার থাবা ততবেশি ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। এভাবে আরও কতদিন গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে তা জানে না কেউই। নিরব-নিস্তবদ্ধ বাংলাদেশের সবকিছুই ‘লকডাউন’ অবস্থান থাকায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। দেশের জনগণকে করোনাযুদ্ধ থেকে বাঁচাতেই কিন্তু সবকিছু ‘লকডাউন’ করে দেয়া হয়েছে। দেশের মানুষকে বাঁচাতেই লাখ লাখ কোটি টাকার এই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ।
তবে আশ্চর্যের বিষয়টি হলো- বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে করোনা ধূমপায়ীদের বেশি আক্রমণ কিংবা আক্রান্তদের মধ্যে বেশি মারা যাচ্ছে। করোনার ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে পৃথিবীর অনেক দেশে তামাকের উৎপাদন, বিপণন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনার ভয়াবহতা থেকে রক্ষায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ধূমপায়ীদের ধূমপান ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি পুরোপুরি ভিন্ন! আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, করোনার এই ভয়াবহ সংকটে তামাকের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা পুরোদমে চালিয়ে যাওয়ার আলাদা অনুমতি দেয়া হয়েছে! তামাকের কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে দেদারছে মৃত্যুর বিপণন তৈরী করা হচ্ছে।
তাহলে স্বার্থটা আসলে ঠিক কোথায়! অর্থনীতির চাকা কিন্তু করোনার চাপে একেবারে পিষ্ঠ হয়ে গেছে। ঘোষণা এসেছে আপাতত এই লকডাউন পুরো মে মাস জুড়ে অব্যাহত থাকবে। এতে এই ২ মাসে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দঁড়াবে কমপক্ষে দুই লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের মোট উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ। দেশের এতোই যখন ক্ষতি হচ্ছে তাহলে কেন এই করোনাকে বাঁচিয়ে রাখতে তামাক কোম্পানিগুলোর রমরমা বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হবে? করোনাকালে তামাকখাত থেকে ঠিক কতটাকা রাজস্ব পাওয়া যাবে! যার জন্য করোনার এই ভয়াবহত সময়েও ধূমপায়ীদের ধূমপানে নিরুৎসাহিত না করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে?
করোনার পৈশাচিকতা থেকে বাঁচার হয়তো এখনো সময় আছে! এজন্য তামাকের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মৃত্যুর বিপণন করা অনতিবিলম্বে বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। করোনার ভয়াল ছোবল থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্টদের ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে চালাতে হবে ব্যাপক প্রচারণা। সেই সাথে আসন্ন বাজেটে উচ্চহারে তামাকের কর বৃদ্ধি করে কৌশলে তামাকজাত পণ্যকে নিরুৎসাহিত বা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
ধূমপায়ীদের করোনা ঝুঁকি বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা মানুষের শরীরে আঘাত করার প্রধান স্থানই হলো ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্র। যারা ধূমপান করেন তাদের ফুসফুস কিংবা শ্বাসতন্ত্র আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত থাকে। অধিকাংশ ধূমপায়ীই নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টে ভুগে থাকেন। তাই ধূমপায়ীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয় এমনিক আক্রান্ত ধূমপায়ী রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনাও অনেক বেশি থাকে।
‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা গেছে- অধূমপায়ীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সংখ্যক ধূমপায়ী জটিল অবস্থায় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তাদের কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হয়েছে। এরপরও তাদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছে। এছাড়া ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) এক গবেষণা বলছে, দিনে একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। স্ট্রোক বা মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরণের ঝুঁকিও বাড়ে ৩০ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরো বেশি, ৫৭ শতাংশের মত। কিন্তু বাংলাদেশে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেছে- করোনা ভাইরাসে মৃত্যু ব্যক্তিদের অধিকাংশ হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন। এখানেই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ধূমপায়ীদের করোনায় আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি।
আবার বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর) এর ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য মতে- বাংলাদেশে নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বেশি। বর্তমানে দেশে ৬৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৩২ শতাংশ নারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। অর্থাৎ নারীর চেয়ে পুরুষ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি করোনায় আক্রান্ত। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ বলছে, ২১-৩০ বছর বয়সীদের করোনা শনাক্ত বেশি হচ্ছে। এ জনগোষ্ঠীর ২৬ শতাংশই করোনা আক্রান্ত। তবে বৃদ্ধদের আক্রান্ত সংখ্যা কম হলেও মৃত্যু বেশি ঘটছে। ৬০ বছরের ওপরে জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর হার ৪২ শতাংশ। তবে বেশির ভাগ মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অন্যান্য একটি শারীরিক জটিলতা যেমন ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ ইত্যাদিক ছিল।
এখন আমরা একটু দেখবো যে, কেন বাংলাদেশে করোনায় নারীর চেয়ে পুরুষ দুই-তৃতীয়াংশ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে? কিংবা তরুণ-যুবারা কেন করোনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে? সহজেই যদি আমরা এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাই তাহলে ‘গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাট্স) ২০১৭’ এর বিশ্লেষণের দিকে নজর দিই। গ্যাট্স এর বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে- ‘বাংলাদেশে ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব) মানুষ তামাক সেবন করে। নারীদের মধ্যে এই হার ২৫.২ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ।’
এই বিশ্লেষণ থেকে অনেকখানি প্রতীয়মান হয় যে, নারীর চেয়ে পুরুষ করোনায় বেশি আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ হলো ধূমপান। কিংবা তরুণ প্রজন্ম করোনায় আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণও কিন্তু একই। আবার ৬০ বছরের বেশি জনগোষ্ঠীর যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের অধিকাংশ হৃদরোগ, স্ট্রোক কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগ ছিল। এসব রোগও কিন্তু ধূমপানের কারণেই হয়। এতো এতো জ্বলন্ত উদাহরণের পরও বাংলাদেশে কেন মৃত্যুর বিপণনকারী তামাক কোম্পানিগুলোকে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে? কিংবা যারা ধূমপান করে তাদেরকে ধূমপান ছেড়ে দিতে কেন জোরেসোরে উৎসাহিত প্রদান করা হচ্ছে না?
আমরা জানি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো-বাংলাদেশ (বিএটি-বি) তে সরকারের প্রায় দশ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। হয়তো বিএটি-বি কিংবা জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জিটিআই) থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে- সরকারের এই রাজস্ব আয়ের চেয়ে তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগে অনেক বেশি অর্থ খরচ হয়? অর্থাৎ তামাকখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ্য রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়। তাহলে কেন তামাক কোম্পানিগুলোকে সংশ্লিষ্টরা এতো বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করছে? তাই আমরা মনে করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন তামাক কোম্পানিগুলোকে এভাবে পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যদিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই পরিকল্পনায় চির ধরানো হয়েছে।
আমরা যদি একটু ভাবি যে, করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসন দিনরাত কতই না পরিশ্রম করছে। করোনার কারণে অর্থনীতির চাকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। কিন্তু যেই তামাকের কারণে করোনা আত্রান্ত কিংবা মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে সেই তামাক কোম্পানির ব্যবসা কেন বন্ধ করা হচ্ছে না? তাই করোনার ভয়াল ছোবল থেকে প্রিয় মাতৃভূমির ১৭ কোটি মানুষকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই ‘মৃত্যুর বিপণনকারী’ এই তামাক কোম্পানির কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হোক।
আরেকটি বিষয় সেটি হলো- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মুলের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি কিন্তু একদিনে নির্মুল করা সম্ভব নয়। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই তামাকপণ্যের প্রতি জনসাধারণকে নিরুতসাহিত করতে হবে। এটি সম্ভব প্রতিবছরের বাজেটে উচ্চহারে তামাকের কর বৃদ্ধির মাধ্যমে। তাই আসন্ন ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে তামাকপণ্যের ওপর আমাদের কিছু কর প্রস্তাবনা রয়েছে। সেগুলো হলো-
১. সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে (নিম্ন এবং প্রিমিয়াম) নামিয়ে আনা। ২. বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেয়া। ৩. ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের (জর্দা ও গুল) মূল্য বৃদ্ধি করা এবং ৪. সকল তামাকপণ্যের খুচরামূল্যের ওপর ৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা।
এই কর প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা হলে যেটি হবে তাহলো- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ক্যাম্পেইন ফর ট্যোবাকো ফ্রি কিডসসহ ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মিলিত গবেষণা অনুযায়ী, উল্লিখিত তামাক-কর ও মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে। এছাড়াও ৩ শতাংশ সারচার্জ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় অর্জন করা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত এই অর্থ সরকার তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস এবং করোনা মহামারী সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে। একইসাথে দীর্ঘমেয়াদে ৬ লক্ষ বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং প্রায় ২০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাবেক শিক্ষার্থী