করোনা মোকাবিলায় ‘জাতীয় টাস্ক ফোর্স’ গঠন করুন : মির্জা ফখরুল

পিবিএ,মাহবুবুর রহমান: প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্যাকেজটি কলেবরে বড় হলেও এটি একটি শুভঙ্করের ফাঁকি, লোক দেখানো আইওয়াস মাত্র বলে মন্তব্য করেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, প্যাকেজটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রণোদনা বলা হলেও মূলত অধিকাংশই ব্যাংক নির্ভর ঋণ-প্যাকেজ যা বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ী মহলকে দেয়া হবে ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে। এতে সরকারের প্রণোদনা নিতান্তই অপ্রতুল।
শুক্রবার দুপুরে গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘‘ যেমন গার্মেন্টস মালিকদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ, শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের মালিকদের জন্য ৩০ হাজার কোটি ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের মালিকদের জন্য ২০ হাজার কোটি ঋণ, কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি ঋণ, ইডিএফ সম্প্রসারণ ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট ফিন্যান্স স্কীমে ৫ হাজার কোটি ঋণসহ সর্বমোট ৭৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও এর মধ্যে সরকারের ভুর্তকি বাবত দেবে ৩ হাজার কোটি টাকা মাত্র। অর্থাত ৭৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ প্যাকেজের মধ্যে মূলত সুদ ভুর্তকির ৩ হাজার কোটি টাকাই হচ্ছে সরকারি প্রণোদনা। অবশিষ্ট অর্থ সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের স্বাভাবিক ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিতরণ করা করবে। এতে সরকারের খরচ হবে ৩ হাজার কোটি টাকা বাদ বাকী অর্থ আসবে ব্যাংক সূত্র থেকে।”
আর্থিক ব্যাংকসমূহের দুরাবস্থা, প্রবাসী রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এবং চলমান তারল্য সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকসমূহ কিভাবে ৭৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজের জন্য অর্থ সংকুলান করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মির্জা আলমগীর।
এসময় তিনি, করোনাভাইরাস সংক্রামণের ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে ‘মহাদুযোর্গ’ মোকাবিরায় ‘জাতীয় টাস্ক ফোর্স’ গঠনের দাবি জানান।
তিনি বলেন, ‘‘ চতুর্দিকে অন্ধকার ও হতাশা। করোনা দুযোর্গের নানামুখী প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হবে বলে মনে হয় , এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুসমন্বিত ও সুবিবেচিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহন, ত্রাণ বিতরণ, বিভিন্ন সেক্টারে প্রণোদনা ও ঋণ প্যাকেজ বন্টন ইত্যাদি বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স গঠনের আমরা প্রস্তাব করছি।”
‘‘ এই টাস্কফোর্সে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ চিকিতসক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সশ্বস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি করে এই টাস্ক ফোর্সকে অর্থবহ ও গতিশীল করার মাধ্যমে কার্য্করী পদক্ষেপ গ্রহন করা এখন সময়ের দাবি। আমাদেরকে লড়াই করতে হবে এবং সেই লড়াইয়ে অবশ্যই আমরা জয়ী হতে হবে।”
টাস্কফোর্স গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ফখরুল বলেন, ‘‘ এখন যে পরিস্থিতি টাস্কফোর্স গঠন করলে সুসমন্বিত, সুচিন্তিত ও সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়ক হবে। নোভেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায় কোনো খাদ্যের ঘাটতি নয়, খাদ্য বন্টনে অনিয়ম, দুর্নীতি, সিদ্ধান্তহীনতা, সুশাসনের অভাব দুর্ভিক্ষের কারণ হতে পারে।”
‘‘ তাই এখনই খাদ্য ও ত্রাণ বন্টনে এবং করোনার পরবর্তী পুনর্বাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই প্রক্রিয়াটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।”
কারোনা এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অগ্রাধিকার বিষয়গুলো কী হতে পারে প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ সবার আগে এখন স্বাস্থ্য, চিকিতসা এবং টেস্ট টেস্ট টেস্ট প্রয়োজন। রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা দেয়াটা দেয়া সবচেয়ে আগে। যাদেরকে আইসোলেশনে নেয়া হচ্ছে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটা সমস্যা দেখা দিয়েছে যারা দিন আনে দিন খান-দিন মজুর যাদেরকে বলা হচ্ছে যে, ঘরে থাকো। ঘরে থাকলে তো খাওয়া আসছে না।”
‘‘ এদের কাছে খাদ্য পৌঁছানো, তাদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া উচিত, টপ অগ্রাধিকার পাওয়া প্রয়োজন। এটার জন্য উপযুক্ত হচ্ছে সামরিক বাহিনী। তারা স্থানীয় যে প্রশাসন আছে, জনপ্রতিনিধি আছে, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনগুলো আছে তাদের নিয়ে এই কাজটা সহজে করা যেতে পারে। অতীতে দুই-একবার এই কাজগুলো হয়েছে তাদেরকে নিয়ে। তাদের(সামরিক বাহিনী) সাংগঠনিক যে দক্ষতা, তারা চুরি-টুরির মধ্যে থাকবে না-এই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সময়ে।”
তিনি বলেন, ‘‘ আমরা ঐক্যের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাম গণতান্ত্রিক জোট বা বাম মোর্চার ঐক্যের একটি পরামর্শসভায়ও আমি যুক্ত হয়েছিলাম। আমরা কোনো রকমের সংকীর্ণতায় ভুগতে চাই না। আমরা মনে করি যে, এখন জাতীয় ঐক্যটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।”
বিএনপি কোনো কাজ করছে না বলে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীদের যেসব অভিযোগ করেছেন এই সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, ‘‘ বিষয়টা হচ্ছে যে, একটা রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে সরকার। সরকারের যদি জনগনের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না, মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট থাকে না। যার ফলে এটা সরকার উপলব্ধি করছে না যে, এখন যেটা দরকার সবাইকে একখানে আনা। তাদের মধ্যে একটা ধারণা সৃষ্টি করা যে, আমরা যা কিছু করছি-ঐক্যবদ্ধভাবে করছি। ভারতে দেখুন, সেখাকার প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে কথা-বার্তা বলেছেন সমস্ত বিরোধী দলের সঙ্গে। অন্যান্য রাজ্যের চিফ মিস্টিনারের সাথে উনি কথা বলছেন, কথা বলেই কিন্তু তিনি হয়ত তার কাজটাই করছেন। কিন্তু আলাপ-আলোচনা করে নিচ্ছেন সকলের সঙ্গে। সো দেট এভরি বডি উইল ফিল উই আর হিয়ার, উই আর অলসো কনট্রিবিটিং। এটা খুবই প্রয়োজন তো।”
‘‘ বিএনপি তো সবচেয়ে বড় দল। সেই বড় দলকে আপনি একেবারেই বাদ দিয়ে নিজের মতো করে কাজ করছেন, করেন। ফলো তো করছেন আমাদেরকেই দেখা যাচ্ছে। আমরা যা যা বলেছি সেই কাজগুলোই তো করছেন। সেইটাকে সুন্দর-সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে এই গালিগালাজগুলো বাদ দিয়ে, ওই সমস্ত কথা-বার্তা বাদ দিয়ে আসল জায়গাতে আসুন। যেটা আমরা বার বার বলছি, দুঃস্থ মানুষকে বাঁচানো হচ্ছে বড় কাজ।”
তিনি বলেন, ‘‘ কিভাবে আহজারি করছে গার্মেন্টসের শ্রমিকরা, কীভাবে আহজারি করছে গৃহকর্মীরা, এরা অত্যন্ত দুঃস্থ হয়ে গেছে এখন কাজ নেই। যে বস্তিতে তারা থাকে সেখানে ঘর ভাড়া দেয়ার উপায় নেই, সেখান থেকে তাদেরকে উচ্ছেদও করা হচ্ছে।”
‘‘ গ্রামের দিনমজুর, ক্ষেতমজুর, যারা রিকসা চালায়, ঠেলা গাড়ি চালায় ওদের সংখ্যা তো ৩ কোটি প্রায়। এই ইনফামাল সেক্টরের লোকজনের কথা চিন্তা করতে হবে। এই যে ফেরি করতো হকার, বাজারের আসতো এসব কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে…..।”
‘বিএনপির কর্মকান্ড’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই বিষয়ে কথা বলেছি, আমরা জগনরের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য লিফলেট বিতরণ করেছি, তাদেরকে মাস্ক দিয়েছি। দুর্ভাগ্য আমাদের তথ্য মন্ত্রী সাহেব সেগুলো দেখতে পান না। তিনি বার বার বলে যাচ্ছেন এবং আওয়ামী লীগের লোকেরাও বলে যাচ্ছে যে, আমরা কিছু না কাজ করেই শুধু কথাই বলছি। এটা একেবারেই সত্য নয়।”
‘‘ আমরা ইতিমধ্যে সারাদেশে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৪ মার্চ দলের নেতা-কর্মীদেরকে আহবান জানিয়েছিলেন যে, নিজেকে নিরাপদ রেখে দুঃস্থ এবং দুদর্শাগ্রস্থ মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রত্যেকটা জেলা, উপজেলায় আমাদের দল, সহযোগী সংগঠন, অঙ্গসংগঠনসমূহ তারা কাজ করছে। যুব দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্র দল, ড্যাব(ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন) ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে সর্বক্ষন। সিলেটের প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা মহানগরীর প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমাদের দলের নেতা-কর্মী খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। একইভাবে প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলাতে যারা প্রার্থী ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, এমপি ছিলেন তারা নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে তারা তাদের এলাকাগুলোতে দুঃস্থ মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেছেন। আমার ধারণা যে, সারাদেশে কমপক্ষে ৫ লক্ষ পরিবারের কাছে আমাদের সাহায্য ইতিমধ্যে বিতরণ কর। এটা অব্যাহত রয়েছে এবং অব্যাহত থাকবে।”
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সকালে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। সম্মেলনের শুরুতে করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক মাইনুদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেন এবং এই মহাদুযোর্গে চিকিতসক,নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, সামরিক বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী এবং গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ভুমিকার প্রশংসা করেন বিএনপি মহাসচিব।

পিবিএ/এমআর

আরও পড়ুন...