কেন গুম হওয়া ব্যক্তি ফিরে এসে মুখ খুলে না

হাসান আল জাভেদ: ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর। ছোট মেয়ে সামিহা জামানকে আনতে ধানমণ্ডির বাসা থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে বের হন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। কিছুক্ষণ পর বাসার ল্যান্ড ফোনে ফোন করেন তিনি। জানান, বাসায় কয়েকজন লোক আসবেন, যারা তার ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো নিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণ পর কালো টিশার্ট পরা, মাথার টুপি নাক পর্যন্ত নামানো সুঠামদেহী তিন ব্যক্তি বাসায় গিয়ে সাবেক এ কূটনীতিকের ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি নিয়ে যায়।

এর পর থেকে নিখোঁজ মারুফ জামান। দিন যায়, মাস পেরিয়ে বছর গেলেও তিনি আর ফিরে আসেন না। নিখোঁজ বাবার জন্য হৃদয়ে জমা শোক নিয়ে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনে যুক্ত হন সামিহা জামান। যারা গুম হয়েছেন, তাদের স্বজনদের নিয়ে গড়া এ সংগঠনের কার্যক্রমে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তিনি।

অবশেষে নিখোঁজ হওয়ার ৪৬৬ দিন পর হঠাৎ ফিরে আসেন মারুফ জামান। তার এ ফিরে আসায় অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগলেও তিনি কিন্তু নির্বাক, একদমই মুখ খুলছেন না। শুধু তিনিই নন, তার স্বজনরাও মুখ খুলতে নারাজ। নিরুদ্দেশ বা গুম হয়ে যাওয়ার পর ফিরে আসছেন যারা, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটছে। মারুফ জামানের মতোই তারা মুখ খুলছেন না; তাদের স্বজনরাও তা-ই। কিন্তু গুম বা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে; কিন্তু ফেরেননি, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল মনে করেন, গুম বলে কিছু নেই। কেউ হয়তো অপহৃত হন; কেউবা প্রেমসংক্রান্ত বা ব্যক্তিগত কোনো কারণে আত্মগোপনে থাকেন।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মুক্তিপণ বা ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্বে অপহরণের কিছুদিন পর অপরাধীরা দাবি আদায় করে ভুক্তভোগীকে মুক্তি অথবা লাশ ফেলে দেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে এসব অপরাধী চক্র ধরাও পড়ছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় বা অনির্দিষ্টকালের জন্য গুম বা তুলে নেওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। এ ক্ষেত্রে নিজের বা পরিবারকে বিপদ থেকে দূরে রাখতে অদৃশ্য শক্তিধর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আড়াল করতে বাধ্য হচ্ছেন ফিরে আসা ব্যক্তিরা।

এমন পরিস্থিতিতেই সারা বিশ্বের মতো আজ শুক্রবার বাংলাদেশেও পালিত হবে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশেও আজ কর্মসূচি পালন করা হবে। সংবাদ সম্মেলন করবে গুম হওয়া মানুষের স্বজনদের নিয়ে গঠিত প্লাটফর্ম ‘মায়ের ডাক’। প্রতি বছরের মতো এবারও সেখানে তুলে ধরা হবে গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের ভাষ্য ও অভিযোগ। তুলে ধরা হবে প্রিয়জন না থাকায় তাদের কষ্টের অনুভূতিগুলো এবং প্রিয়জনকে ফিরে পেতে সরকারের সহায়তা কামনা করা হবে এবং সম্মিলিতভাবে এর প্রতিকার দাবি করা হবে।

গুম হওয়া কোনো ব্যক্তি ফিরে এলে কেন মুখ খুলছেন না? এমন প্রশ্নে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আমাদের সময়কে বলেন, তারা আটক অবস্থায় এমন কিছু ভয়াবহ পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং তাদের এমনভাবে ভয় প্রদর্শন করা হয়, যাতে ফিরে এসে কোনোভাবেই মুখ না খোলেন। এটি তখনই সম্ভব হয় যখন গুম হওয়া মানুষগুলো কোনো সুশৃঙ্খল গোষ্ঠীর হাতে বন্দী থাকে এবং এই গোষ্ঠী রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে।

তিনি বলেন, এ অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতিতে এটি স্পষ্ট যে, তারা আসলে কাদের দ্বারা অপহৃত-গুম হয়েছিল। কথা বলতে না পারার মতো একটা ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারাই বলে দেয়, আসলে তারা কোন গোষ্ঠীর হাতে বন্দী ছিল। ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশে আনুমানিক ৭০০ জন গুমের শিকার হলেও জীবিত ফেরা কিংবা তাদের লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে, এমন মানুষের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম।

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫৩২ জন গুম হয়েছেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের ৩৯তম সভায় ৪৩২ জন গুম হওয়া ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে সংস্থাটি। সেই হিসাবে ৩৯তম সভার পর অর্থাৎ গত এক বছরে এ দেশে শতজন গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা বরাবরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর দায় চাপাচ্ছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ফিরে এসেছেন, তারা পরিবারের কাছে বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নির্জন কারাবাসে রাখার গল্প। এ নির্জন কারাগারগুলো ‘সেফ হাউস’ নামে পরিচিত। ঢাকা শহরেই রয়েছে এসব সেফ হাউসের অধিকাংশ। একাধিক ভুক্তভোগী বলেছেন, তাদের এক সেফ হাউস থেকে অন্য সেফ হাউসে স্থানান্তরও করা হয়েছিল।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৩৪৪ জন গুম হয়েছেন বলে ভুক্তভোগীদের পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে; ৬০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৩৫ জন ফেরত এসেছেন।

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় তেজগাঁওয়ের বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ ৬ জনকে। এর পর সুমনের শাহীনবাগের বাসার সামনে থেকে আরও দুজনকে তুলে নেওয়া হয়। সুমনের মা হাজেরা খাতুন আমাদের সময়কে বলেন, সেদিন তিনটি গাড়িতে করে সুমনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তাই আজও মাঝরাতে বাসার সামনের রাস্তার গাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙে। স্বপ্ন দেখি, আমার সুমন তাদের (আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর) গাড়ি থেকে নেমে কড়া নাড়ছে, মা আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু স্বপ্নগুলো সেখানেই বন্দি থাকে, বাকি রাত দু চোখে পানি ঝরে। কিন্তু ছেলে ফেরে না। আর এভাবে বেঁচে থাকতে হবে বলেই বেঁচে আছি। ৬ বছর হতে চলছে আর পারি না। তবে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছি।

সুমনের বড় বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসী বলেন, সুমনকে তুলে নেওয়ার ১-২ বছর ধরে আশায় ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি ইউনিট থেকে সুমনকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু এখন তারা কথাই বলছে না। মাঝে শুনেছি সুমনকে তুলে ভারতের শিলং বা হিমাচলে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সুমনের দুই মেয়ে হাফসা ইসশার ও আরওয়া বড় হয়েছে। ওরা বাবাকে ফেরত চাচ্ছে।

একই সঙ্গে তুলে নেওয়া হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জমান রানাকে। তার বড় বোন মিনারা আক্তার বলেন, একটা মানুষ মরে গেলে শোক-দুঃখ করে সব ভুলে যায়। কিন্তু যিনি গুম তাকে নিয়ে কেমন অনুভূত হয়। আশা করি প্রধানমন্ত্রী আমাদের কষ্ট বুঝবেন। ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল যশোরের কোতোয়ালি থানা পুলিশের বিরুদ্ধে ডেকে নেওয়ার অভিযোগ শাওন মির্জা নামে এক গাড়িচালককে। শাওনের বড় ভাই ফয়সাল মির্জা বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ করি, ভাই আমার আওয়ামী লীগ নেতার গাড়িচালক। কিন্তু ওর বন্ধু সাঈদের সঙ্গে প্রভাবশালী কন্যার নারীঘটিত বিষয়ে সমস্যা ছিল। তাই পুলিশ সাঈদকে ডেকে নেয়। হয়তো সাঈদকে গুম করার সাক্ষী না রাখতেই শাওনকে গুম করা হয়েছে অনুমান ফয়সালের।

২০১১ সালের ২৪ জুলাই উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন স্থানীয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান শিপন। এর পর তার স্ত্রী সামিয়া সুলতানা থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলার বদলে জিডি (সাধারণ ডায়েরি) গ্রহণ করেন। কিন্তু শিপন বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেই প্রশ্ন সামিয়া সুলতানার। আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, একটা গুম হলেও এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত করে ভুক্তভোগীদের খুঁজে বের করে দেওয়া। কিন্তু যারা ফিরে এসেছে তারা কথা বলছে না। আশা করছি সরকার আরেকটু তৎপর হবে, কারা গুম করছে তা খুঁজে বের করবে।

পিবিএ/বিএইচ

আরও পড়ুন...