আজিজুল হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীসহ গ্রেফতার ১১

পিবিএ,ঢাকা: দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন মীরেরবাগ এলাকার ওরিয়েন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত স্কুলছাত্র আজিজুল ইসলাম (১৮) পিতা-মাতা ও তিন ভাইয়ের সংসারে সে সবার বড়। আজিজুলের পিতা একজন দিনমজুর। তিনি রাজমিস্ত্রীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। অভাবের সংসারে আজিজুলও লেখাপড়ার পাশাপাশি ইজিবাইক চালিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতো এবং তার লেখাপড়ার খরচ চালাতো।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আজিজুল প্রতিদিনের ন্যায় ইজি বাইক নিয়ে যাত্রী পরিবহন করার জন্য বাসা থেকে বের হয়। ঐদিন রাতে সে বাসায় ফিরে না আসলে তার পরিবারের লোকজন আজিজুল এর ফোনে কল দিয়ে তার ফোন বন্ধ পায়। অতঃপর আজিজুল এর পরিবারের লোকজন চিন্তিত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করতে থাকে। খোঁজাখুজির একপর্যায়ে ঐদিন আনুমানিক রাত ০৯:৩০ ঘটিকায় তাদের এক প্রতিবেশী রুমা বেগম ও তার ছেলে রবিউল (১০) জানায় ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকাস্থ একটি মোটর গ্যারেজের পিছনে অজ্ঞাত ৪/৫ ব্যক্তিরা আজিজুল’কে হত্যা করে তার ইজিবাইক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। উক্ত সংবাদ পেয়ে আজিজুলের পরিবারের লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে একটি কলাগাছের সাথে ভিকটিমের পরিহিত সুতি কাপড়ের বেল্ট দ্বারা গলায় ফাস লাগানো অবস্থায় আজিজুলের মৃতদেহ দেখতে পায়।

ঘটনার সংবাদ পেয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গমন পূর্বক আজিজুলের মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করত লাশ ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মিডফোর্ড হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে। অতঃপর আজিজুলের মাতা লাইলী বেগম (৪১) তার পরিবারের সাথে পরামর্শ করত ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে দুস্যুতাসহ একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর- ৮৩, তাং- ২০/০২/২০২৩ খ্রিঃ, ধারা- ৩৯৪/৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড।

ইতোমধ্যে হত্যাকান্ডটি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ঘটনাটি জানতে পেরে র‌্যাব-১০ এর একটি আভিযানিক দল চাঞ্চল্যকর ও ক্লু-লেস স্কুল ছাত্র আজিজুল হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত আসামীদের গ্রেফতার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে।

র‌্যাব-১০’র আভিযানিক দল ঘটনাস্থলের আশপাশ পরিদর্শন করে বিভিন্ন সিসি টিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে যাচাই বাছাই করত বিভিন্ন মানুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। পরবর্তীতে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য ও গোয়েন্দা তথ্যের সহায়তায় উক্ত হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটন করত গতকাল ৯ মার্চ ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা ১। মোঃ সাকিব (১৯), ২। মোঃ সজীব (১৯), ৩। মোঃ আরমান (২০), ৪। মোঃ আরাফাত (১৯), ৫। মোঃ হৃদয় (২০), ৬। মোঃ সাইফুল (২২), ৭। মোঃ সজীব (২৪), ৮। মোঃ জিতু (১৯) ও ৯। মোঃ ইব্রাহীম (১৯)’কে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারকৃত আসামীদের দেয়া তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্যের সহায়তায় র‌্যাব-১০ এর উক্ত আভিযানিক দল একই তারিখ পটুয়াখালী জেলার সদর থানাধীন বতলবুনিয়া এলাকায় একটি অভিযান পরিচালনা করে উক্ত হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত অপর আসামী মোঃ রায়হান গাজী (১৯)’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত আসামীদের নিকট ছিনতাইকৃত ভিকটিমের ইজিবাইকটির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তাদের দেয়া তথ্যমতে র‌্যাব-১০’র আভিযানিক দল গতকাল (৯ মার্চ ) ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন সাতপাখি খেজুরবাগ এলাকায় অপর একটি অভিযান পরিচালনা করে মোঃ আজিজুর রহমান (৪৫) এর গ্যারেজ হতে উক্ত ইজিবাইকটি উদ্ধার পূর্বক তাকে গ্রেফতার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক সন্ধ্যা ১৮:১৫ ঘটিকায় ভিকটিম আজিজুল ইসলাম (১৮) ও তার প্রতিবেশী রবিউল (১০) ইজিবাইক নিয়ে ইকুরিয়া আন্ডারপাসে অবস্থান করাকালে সাকিব ও আরমান সারিঘাট যাওয়ার কথা বলে ইজিবাইকে ওঠে। সারিঘাট যাওয়ার পথে হাসনাবাদ এলাকায় পৌঁছালে তাদের অপর তিনজন সহযোগী আরাফাত, সজীব ও রায়হান উক্ত ইজিবাইকে ওঠে। অতঃপর তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকাস্থ হোয়াইট হাউজ এর নিকট পৌঁছালে সাকিব গাড়ি থেকে নেমে অবস্থান নিয়ে জনসাধারণের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে।

অপর চারজন ইজিবাইকসহ আজিজুল’কে বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকার ক্লাস মটরস লিমিটেড নামক একটি বাস তৈরির গ্যারেজের পিছনে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যায়। অতঃপর দূর্বৃত্তরা আজিজুলের ইজিবাইকটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, এতে আজিজুল তার ইজিবাইকটি দিতে বাধা প্রদান করলে সজীব আজিজুলের প্রতিবেশী রবিউলকে ইজিবাইক থেকে নামিয়ে আটক করে রাখে। অন্যদিকে আরাফাত, আরমান ও রায়হান আজিজুল’কে উল্লেখিত গ্যারেজের পিছনে কলাগাছের নিচে নিয়ে গিয়ে তাকে মারধর করতে থাকে এবং একপর্যায়ে আরমান আজিজুলের বুকের উপরে উঠে দু’হাত ধরে রাখে, রায়হান মুখ চেপে ধরে এবং আরাফাত ভিকটিমের পরিহিত প্যান্টের বেল্ট খুলে তার গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা নিশ্চিত করে। অতঃপর হত্যাকারীরা রবিউলকে ঘটনাটি কাউকে না জানানোর জন্য বিভিন্ন প্রকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ভিকটিমের ইজিবাইকটি নিয়ে পালিয়ে যায়। উক্ত হত্যাকাণ্ডের পর তারা আইনের হাত থেকে বাচাঁর জন্য নিজেদের মোবাইলের সিম পরিবর্তন করে ফেলে।

পরবর্তীতে হৃদয়, জিতু ও ইব্রাহিম ছিনতাইকৃত ইজিবাইকটি হত্যাকারীদের নিকট হতে গ্রহণ করে ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ধানাধীন কালিগঞ্জ এলাকায় নিয়ে গিয়ে তাদের অপর সহযোগী সাইফুল এর নিকট হস্তান্তর করে। সাইফুল উক্ত ইজিবাইকটি তাদের অপর সহযোগী সজীবের নিকট হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে সজীব উক্ত ইজিবাইকটি সাইফুলের নিকট হতে গ্রহণ করে গ্যারেজ মালিক আজিজুর এর নিকট ২০,০০০/- টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে। অতঃপর উক্ত ইজিবাইক এর বিক্রয় লব্ধ অর্থ তারা সবাই মিলে বন্টন করে নেয়।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত আসামীরা বিভিন্ন সময়ে ইজিবাইক/অটো-রিক্সা ভাড়া করে তাদের সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে গিয়ে দেশীয় ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকিসহ বিভিন্ন প্রকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ইজিবাইক/অটো-রিক্সা ছিনতাই করে ২০,০০০-৫০,০০০/- টাকার বিনিময়ে গ্যারেজ মালিক আজিজুর এর নিকট বিক্রয় করত। উক্ত হত্যাকাণ্ডের পরেও গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা আনুমানিক ১৯:০০ ঘটিকায় তারা একইভাবে সারিঘাট এলাকায় একটি ইজিবাইক ছিনতাই করে। এছাড়াও গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন মনুরবাগ নামক স্থান হতে আরো একটি ইজিবাইক ছিনতাই করে বলে জানা যায়।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আজিজুর এর নিকট হতে জানা যায় যে, সে উক্ত হত্যাকাণ্ডের ইজিবাইকটি ২০,০০০/- টাকায় ক্রয় করে তার রং ও কাঠামো পরিবর্তন করে অন্যত্র বিক্রয় করার পরিকল্পনা করেছিল। এছাড়াও সে উক্ত হত্যাকান্ডে জড়িত চক্রটির নিকট হতে বিভিন্ন সময়ে চোরাই/ছিনতাইকৃত ইজিবাইক/অটো-রিক্সা স্বল্প মূল্যে ক্রয় করে সেগুলোর রং এবং কাঠামো পরিবর্তন করে অধিক মূল্যে অন্যত্র বিক্রয় করত।

গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

আরও পড়ুন...