পিবিএ ডেস্ক: গত ১১ এপ্রিল প্রথম দফা ভোট গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ভারতের ১৭তম লোকসভা নির্বাচন। লোকসভা নির্বাচনে কোন দল বা পক্ষ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে তা এখনই জোরালোভাবে বলা যাচ্ছে না।
তবে ক্ষমতাসিন দল বিজেপি ও তার শরিকরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হলেও নিশ্চিত নয়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিশ্বচিত করে বলতে পারছে না বিরোধী দল কংগ্রেসও।
তবে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বার বার উচ্চস্বরে বলছেন, বাংলার নেতৃত্বেই দিল্লিতে সরকার গঠিত হবে। তবে কোন অঙ্কে সেটা সম্ভব তা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন কেউই।
কংগ্রেসের নেতৃত্বেই জোট করে সরকার গঠনের চেষ্টা হবে বলে মনে করেন বিরোধীদের একাংশ ।
সরকার গঠন নিয়ে চারিদিকে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। দেশ-বিদেশে সব জায়গায় একটিই প্রশ্ন- কে হচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। আপাত দৃষ্টিতে এই নির্বাচনী লড়াইটা ত্রিমুখী মনে হলেও এখনো মনে হচ্ছে মূলত সিটিং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধীর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর লড়াই হচ্ছে।
মোদি ও রাহুলের কথা সামনে থাকলেও ফল প্রকাশের পর যদি দেখা যায় বিজেপি দল হিসেবে এককভাবে ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২ আসন পায়নি তখন তৃতীয়পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দাবি উত্থাপিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
এ পর্যন্ত জরিপের অনুমান, বিজেপি ১৬০-১৭০টির বেশি আসন পাবে না। মোদির মন্ত্রিসভার মন্ত্রী রামদাস আটওয়ালও প্রকাশ্যে বলেছেন, বিজেপি গতবারের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। নির্ভর করতে হবে শরিকদের উপরেই। এমনকি উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের হিন্দিবলয়খ্যাত রাজ্যে আসন খোয়াবে বিজেপি।
এদিকে ইতিমধ্যে সরকার গঠন করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে আঞ্চলিক দলগুলো। এ বছর মোদি হাওয়ার পড়তি গতি বুঝে ভেতরে ভেতরে দৌঁড়ের বেগ আরও বাড়িয়েছেন সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীরা।
এবারের ভোটে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ বা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ- কোনো জোটই এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না, সেই হাওয়া ছড়াচ্ছে।
ফলে মমতা ব্যানার্জি, মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, নবীন পাটনায়েক, চন্দ্রবাবু নাইডু, জগনমোহন রেড্ডি, কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মতো নেতাদের কদর বাড়ছে। নাম-ডাকে বড় হয়ে ওঠা এ আঞ্চলিক দলগুলোর হাতেগোনা কয়েকটি আসন বড় জোটের সঙ্গে মিলিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়তে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।
এ নিয়ে তেলেগু দেশম পার্টির নেতা তথা অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু সর্বপ্রথম জোট গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছেন। গত সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে চন্দ্রবাবু বলেছেন, মমতার নেতৃত্বে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত হবে। তিনিই সবাইকে সংগঠিত করছেন। চন্দ্রবাবু বলেছেন, মমতা বাংলার বাঘই শুধু নয়, দেশের বাঘিনী।
দিল্লিতে গিয়ে চন্দ্রবাবু কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও দেখা করেন। ভোট শেষ হওয়ার পরপরই বিজেপিবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে বৈঠকে বসার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন চন্দ্রবাবু।
আগামী ২১ মে অথবা ২৩ মে ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর বিরোধী দলগুলো মহাজোট গঠন নিয়ে আলোচনায় বসতে পারে। উত্তরপ্রদেশে ‘ক্ষুদ্র’ মহাজোটের চাপে কিছুটা বিড়ম্বনায় বিজেপি। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বসপা), অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি (সপা) ও অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি) নিয়ে গঠিত মহাজোট বিজেপিকে টক্কর দিচ্ছে। গতবার বিজেপি উত্তরপ্রদেশের ৮০ আসনের মধ্যে ৭১টি পেয়েছিল। এখানে ব্যাকফুটে চলে গেছেন অখিলেশ। আর মারকুটে আছেন মায়াবতী।
নিজের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর হাবভাব এনে ফেলেছেন মায়াবতী। ভোটের পারদ চড়িয়ে মায়াবতী বলছেন, যেভাবে উত্তরপ্রদেশে তার বসপা সরকার উন্নয়ন করেছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলতেই পারেন, ‘বসপার জাতীয় প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য ফিট, সে তুলনায় মোদি আনফিট।’
ওদিকে পশ্চিমবঙ্গে ৪২ আসনের ৪২টিই আঁচলে বেঁধে বসে আছেন মমতা। ভারতজুড়ে মোদিবিরোধী তবলা বাজিয়ে বেড়াচ্ছেন। মোদির মসনদ পোড়াতে এবার মমতাই কাঠখড় পোড়াচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।
ফল ঘোষণার আগেই নাম দিয়েছেন ‘এক্সপায়ার মোদি’। কলকাতাভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রজত রায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনে মনে স্বপ্ন বুনছেন মমতা। গত দুই বছর ধরে সেই স্বপ্ন লালন করছেন তিনি। আঞ্চলিক নেতাদের সংগঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।’
রজত মনে করেন, ‘ভারতে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হলেও বিজেপির দিকে দুলবে না মমতা। পশ্চিমবঙ্গে ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোটার। ফলে ঝুঁকি নেবেন না মমতা।’
ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট এবং ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, আসন সংখ্যার বিশ্লেষণে মোদিবিরোধী পক্ষের পাল্লাই এখন পর্যন্ত ভারী বলে মনে হয়। তবে, বাহুবল, অর্থবল, কট্টর ক্যাডার বাহিনী, সাংগঠনিক শক্তির বিবেচনায় এবং নেতৃত্বের ক্যারিশমায় মোদি ও তার জোট এনডিএ এগিয়ে আছে।
তিনি বলেন, বহুমাত্রিক দিক বিবেচনায় এত বড় নির্বাচনে সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া ব্যক্তি পর্যায়ে তো নয়ই, কোনো সংস্থার পক্ষেও সেটা অনেক কঠিন কাজ। এ পর্যন্ত যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় ২৩ মে ফল প্রকাশের পর ভারতবাসী একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পাবে। তখন সেটি আরও আগ্রহোদ্দিপক বিষয় হবে।
শুরু হবে সরকার গঠনের দৌড়ঝাঁপ এবং দরকষাকষি। তাতে মমতা ব্যানার্জি, অখিলেশ যাদব, মায়াবতি এবং বিহার ও দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক দলগুলো সরকার গঠনের বেলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। তাতে কার ভাগ্য খুলবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এখনো মোদি এবং তারপর রাহুলের পাল্লাই ভারী।
পশ্চিমবঙ্গের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত তার এক প্রবন্ধে লেখেন, ১৩০ কোটি লোকের বেশির ভাগই মনে করে, যেভাবে তিনি পাঁচ বছর ধরে জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালিয়েছেন, তাতে আরো একবার তাকে সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। সম্প্রতি পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপির পর্যুদস্ত হওয়া সেটাই ইঙ্গিত করে।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে চলছে তুমুল লড়াই। এই নির্বাচনে মোদি ও রাহুলের কথা সামনে থাকলেও শেষ পর্যন্ত হিসেব এমন নাও থাকতে পারে। কী হবে সেটা দেখার জন্য ফল প্রকাশের দিন ২৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
পিবিএ/হক