আহসান টিটু, ফকিরহাট (বাগেরহাট) : সুমন শরীফ, আসাদুজ্জামান মীর, রাতুল কুমার শীল, মিল্টন সাহা ও আল আমিন-এখনো ওদের কৈশোর পার হয়নি। বয়সটা হৈ চৈ করে কাটিয়ে দেওয়ার। অথচ, এ বয়সেই ওরা সোয়া লক্ষ বাসিন্দার শহরের এক গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে! শহরবাসীকে কোভিড-১৯ থেকে নিরাপদ রাখার এক ব্যতিক্রম যুদ্ধে শামিল হয়েছে ওরা। “আপনারা ঘরে নিরাপদে থাকুন, আমরা পৌঁছে দিবো আপনার যা প্রয়োজন” এ শ্লোগানে বিনামূল্যে হোম ডেলিভারী দিচ্ছে তারা।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট সদরে তাদের বাস। সিডর, আইলা, বুলবুল, আম্পানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে তারা স্বেচ্ছা সেবার প্রশিক্ষণ নিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট থেকে।
মানসিক প্রস্তুতি ছিল ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাসে রুখে দাঁড়ানোর। এর মাঝেই দুর্যোগ হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস! অপরিচিত এই রোগের বিরুদ্ধে শুরু হয় নতুন লড়াই। সংগঠিত হয় তারা। চলে পরিকল্পনা। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, মানুষকে ঘরে রাখতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ঘরে পৌঁছে দেবে এই কিশোরেরা। এক লাখ ২৫ হাজার বাসিন্দার শহর বাগেরহাটে বিনামূল্যে স্বেচ্ছাসেবী হোম ডেলিভারি সার্ভিস চালু হয়েছে। এই সার্ভিসের পেছনে তরুণদের সঙ্গে রয়েছে এই কিশোরের দল। এর জন্য রয়েছে, হটলাইন।
যে কোনো বাসিন্দা বাজারের যে কোনো পণ্য তাদের কাছে চাইতে পারে। তরুণরা বাজার থেকে সেটা সংগ্রহ করে পৌঁছে দেবে বাসায়। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিতে রয়েছে তাদের ভ্যান। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত চলে এই সেবা। কাঁচামাল ছাড়া অন্য পণ্য এই সময়ের বাইরেও নেয়া যাবে।
স্বেচ্ছাসেবক মো. আল আমিন হোসেন খান (১৬) প্রতিবেদককে বলেন, “আমরা সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত আমাদের এই সেবা দিয়ে থাকি। এছাড়া আমরা হটলাইনে কল করলে হোম ডেলিভারী ও দিয়ে থাকি। ঝুঁকি আছে জেনেও পরিবার আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়।”
বাগেরহাট শহরের সেবা গ্রহণকারী মরিয়ম খানম বলেন, “আমার বাসায় ছোট বাচ্চা আছে। তাই এই সময় প্রতিদিন বাইরে যাওয়া বা বাজার করাটা আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমার হাজবেন্ড ব্যাংকার। এই সময়ও তাকে কাজে যেতে হয়। তাই সে বাজার করার সময় পায় না। স্বেচ্ছাসেবীরা বাসায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ায় আমার খুব সুবিধা হচ্ছে।”
বাগেরহাট সদর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আসমাতুল ফাতিমা বলেন, “আমি দুই দিন, একদিন পর তাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার করি, রাতের বেলায় অর্ডার করলে সকালে ভেতর জিনিসগুলো বাসায় পৌঁছে যায়। বাজার করার লোক থাকলেও, ব্যস্ততার কারণে সময় মতো বাজার করতে পারি না। এখানে অর্ডার করলে সময়মত জিনিসগুলো পেয়ে থাকি।”
তবে বাজার পৌঁছে দেয়া এই স্বেচ্ছাসেবীরা ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে তাদের কাজের পরিসরও। বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করে দেয়া, যে সব বিল ব্যাংকে জমা দিতে হয়, সেগুলো জমা দিয়ে দেয়া সবই যেন তাদের দায়িত্ব। ১৮ বছরের বেশি বয়সীরা হাসপাতাল ও কারাগারে জীবাণুনাশক ছিটাতেও যায়!
শুরু থেকে এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকা স্বেচ্ছাসেবী তালুকদার নাজমুল কবির ঝিলাম বলেন, “আমাদের সারা বাগেরহাট চালু করার ইচ্ছা থাকলেও, বিক্রি করার জন্য ভ্যান এবং অর্থ সংকটের কারণে পারছি না। প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে সবজি কেনার পরিকল্পনা থাকলেও যানবাহন এবং অর্থ সংকটের কারণে সে পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।”
জেলা প্রশাসকের কাজ থেকে অনুমোদন নিয়ে কাজটি পরিচালনা করছে স্বেচ্ছাসেবীরা। এ ব্যাপারে তাদের প্রশংসা করে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোঃ মামুনুর রশিদ বলেন, “রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবকরা নানা দুর্যোগের সময় সহযোগিতা করেছে। করোনা ছাড়াও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে এই স্বেচ্ছাসেবীরা সহযোগিতা করেছে।”
পিবিএ/আহসান টিটু/এমএ