মোহাম্মদ আব্দুল গফুর
সম্মান ও মর্যাদাপূর্ন মাস রমাদান
রহমত, বরকত, মাগফিরাত, আর নাজাতের বৃষ্টি হয়ে পবিত্র রমাদান আমাদে মাঝে আসে৷ আরবী মাসগুলোর মধ্যে এই রমাদান মাসকে বিশেষ ভাবে সম্মনিত করা হয়েছে৷ এই মাসে একটি ফরজ ইবাদাত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান , এই মাসের নফল ইবাদাত অন্য মাসের ফরজের সমান৷
রমাদান মাসে জান্নাতের দরজা সমুহ খুলে দেয়া হয় আর জাহন্নামের দরজা সমুহ বন্ধ রাখা হয় ৷ এই মাসে শয়তানকে বেধে রাখা হয় ৷ রমাদান মাসে এমন একটি রাত আছে ৷ যেই রাতকে পবিত্র কোরআনে লাইলাতুল ক্বদর
নামে সম্মানিত করেছে ৷ এই কদর সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
হে নবী শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? শবে-ক্বদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
রমাদান মাসের শেষ দশকের বেজোর রাতের যে কোন একটি রাত হতে পারে কদরের রাত ৷
রাসুল (সঃ) এই রাত সমুহে মসজিদে এতেক্বাফ থেকে বেশী বেশী আল্লাহকে স্বরণ করতেন, এবং সমস্ত ঈমানদারদের তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন৷
কোরআন নাযিলের মাস রমাদান
বছরের অন্য মাসগুলোর চেয়ে রমাদান মাসকে মর্যাদা ও সম্মানিত করার আসল কারণ হচ্ছে, এই মাসে কোরআন নাযিল হয়েছিল, এবং কদরের রাতের মর্যাদা ও সেই একই কারণে বৃদ্ধি করা হয়েছে৷ নিম্নের কোরআনের আয়াত গুলো পড়লে বিষয়টি আরো পরিস্কার হয়ে যায় ৷
যেমন : সুরা বাকারার – ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেন: রমযান মাস এই মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ, এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে রোযা পালন করে ৷ পাশাপাশি সুরা আল ক্বদরে শরুতেই আল্লাহ বলেছেন : আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে ৷
মানুষের জন্যই কোরআন
মানুষের প্রয়োজন সম্পর্কে তিনিই অধিক ভাল জানেন যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছন। তাই একজন মানুষের যেখানে যা যতটুকু প্রয়োজন তিনি তাকে দিয়েছেন, এবং তাকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন ৷
ঠিক এমনি করে পৃথিবীতে জীবন – যাপন করতে গেলে মানুষের যে একটা নিয়ম নীতির বা জীবন ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে তাতো আল্লাহ পাক ভাল করেই জানেন ৷ আর এজন্যই মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের জন্য একটি পরিপূর্ণ আইন বা জীবন ব্যাবস্থা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন৷
যুগে-যুগে পৃথিবীর সব মানুষের জন্যই নবী – রাসুলগণের মাধ্যমে এই জীবন ব্যবস্থা পাঠানো হয়েছে ৷ অতপর সর্বশেষ নবী হযরত রাসুল (সঃ) এর মাধ্যমে যে চুরান্ত ও স্থায়ী জীবন ব্যবস্থাটি তিনি দুনিয়ার মানুষের জন্য পাঠালেন সেটির নাম হচ্ছে আল কুরআন ৷
কুরআনী জীবন ব্যবস্থাই হলো ইসলাম
আমরা বুঝলাম যে, কুরআন হচ্ছে মানুষের জন্য cod of life পরিপুর্ন জীবন বিধান, একজন মানুষের জন্য তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন , রাষ্ট্রীয় জীবন , মোট কথা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা যা প্রয়োজন, এর সব কিছুর সমাধান এই কুরআনে আছে ৷ কুরআন বর্তমান মানুষের নিকট আছে একটি লিখিত বই বা কিতাব হয়ে, এই কুরআনে যে নিয়ম – নীতি বা বিধান আছে সেটাকেই বলা হয় ইসলাম ৷
অন্য কিছু গ্রহনযোগ্য হবেনা
আল্লাহ রব্বুল আলামীন কোরআনে ঘোষনা করেছেন : ইন্নাদ দ্বীনা ইনদালাহিল ইসলাম অর্থাৎ আমার নিকট একমাত্র মনোনিত জীবন ব্যবস্থা হল ইসলাম৷ উল্লেখিত আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে যে,
আল্লাহপাক পৃথীবিতে মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য একমাত্র কুরআনের বিধান বা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকেই নির্ধারন করেছেন৷ এছাড়া অন্য যে কোন মানব রচিত জীবন ব্যবস্থাকে মানুষ অনুসরন করলে তা আল্লাহর নিকট কোন অবস্থাতেই গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হবেনা৷
অতীতকালে এবং বর্তমানে অগনিত মতবাদের অসংখ্য মানব রচিত জীবন বিধান বা আইন মানুষকে হাতছানি দিয়েছে , এখনো দিচ্ছে ৷
এই সব মানুষের তৈরি বিধান পৃথীবিতে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, বর্তমানেও হবে বলে আশা করা নিন্তান্তই বোকামী ৷
সমাধান খুঁজতে হবে সৃষ্টি কর্তার কাছ থেকেই
যে ইঞ্জিনিয়ার মেসিন বানিয়েছে সেই মেসিন থেকে
সু-ফল পেতে হলে, সেই ইঞ্জিনিয়ার রচিত ক্যটলগ অনুসারে অবস্যই মেসিন পরিচালনা করতে হবে,
অন্যথায় কু-ফলই যে ভাগ্যে জুটবে তাতে সন্দেহ নাই৷
আল্লাহ পাকের জ্ঞ্যান, অতীত-বর্তমান, সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ, সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে আছে ৷
মানুষকে যেহেতু তিনি সৃষ্টি করছেন, তাই তিনিই জানেন কিসে মানুষের ভাল, কিসে মন্দ৷
তাই মানুষকে তার জীবনের সকল কিছুর সমাধান
একমাত্র তার সৃষ্টি কর্তার কাছ থেকেই খুঁজতে হবে৷
এবং তার রচিত ক্যাটলগ অনুসারে অর্থাৎ তার দেওয়া জীবন বিধান, সেই কুরআনের অনুসারে জীবন পরিচালনার করতে হবে৷ তবেই প্রকৃত পক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে৷
☀️যে কারনে রোযা পালন বাধ্যতামূলক
সুরা বাকারায় বলা হয়েছে : ‘‘হে ঈমানদারগন, রোযা তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববতিগণের উপর, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অর্জন করবে৷’’
উল্লেখিত আয়াতটি পড়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে, রোযা শুধু আমাদের উপরেই নয় পূর্বেও যারা ঈমানদার ছিল তাদের উপরও ফরজ ছিল৷ তাহলে রোযাকে গুরুত্ব দেওয়ার এমন কি কারন থাকতে পারে যে , যুগে-যুগে অন্য সবার উপরেও রোযাকে বলবৎ রাখা হয়েছিল?
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, উল্লেখিত আয়াতে রোযা থেকে তাকওয়া অর্জনের প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়েছে , বলা হয়েছে আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অর্জন করবে৷ অতএব আমরা বুঝতে পারলাম যে রোযা বাধ্যতামূলক করার মুল উদ্দ্যেশই হলো তাকওয়া অর্জন৷
☀️ তাকওয়া কি ?
তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে , আল্লাহ ভীতি, পরহেযগারী, বিরত থাকা, বেঁচে থাকা,ও আত্মশুদ্ধি৷
আর শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তার বিধি বিধান মেনে চলার নাম হচ্ছে তাকওয়া ৷
☀️ তাকওয়ার উদ্যেশ্য
তাকওয়ার যে অর্থ সমুহ আমরা বুঝেছি ,
এগুলো হচ্ছে এমন মৌলিক কিছু গুনাবলী যার মধ্যে এসব গুন সমূহের বিস্তার ঘটে তাকেই মুলত মুমিন বা মুত্তাকি বলা হয়৷ আর তাকওয়ার মুল উদ্যেশই হলো ঈমানদারদের মুত্তাক্বী করে গড়ে তোলা ৷
☀️ নবী- রসুলগন যে কাজটি করেছিলেন
দ্বীন শব্দের অর্থ – জীবন বিধান৷ কোরআন যেহেতু মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একটি পরিপুর্ন জীবন বিধান তাই এটির দাবী হচ্ছে যে, এটি পৃথিবীর মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতিষ্ঠিত লাভ করবে৷
মুলত আল্লাহর এই বিধানকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই যুগে-যুগে সমস্ত নবী রসুল ও তার সাহাবীগন চেষ্টা সাধনা করে গেছেন৷
এই প্রসঙ্গে সুরা আস সফের ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে : তিনি সেই সত্তা যিনি পৃথিবীতে রসুল পাঠিয়েছেন দ্বীনে হক্ সত্য বিধান সহকারে যেন অন্য সব বিধান এর উপর তিনি তাকে বিজয়ী করেন৷
☀️ এটি একটি ফরজ ইবাদাত
দ্বীনে হক্ , অর্থাৎ এই কোরআনের বিধান বাস্তবায়নের কাজটি সকল ঈমানদারদের উপর ফরজ৷ যেমন কোরআনে বলা হয়েছে :
ইয়া আক্বিমুছ্ ছলাত অর্থাৎ নামাজ কায়েম কর, আবার বলা হয়েছে ওয়া আক্বিমুদ দ্বীন অর্থাৎ
দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর৷ তাহলে বুঝা গেল নামাজের মতই দ্বীন কায়েম করাও ফরজ৷
☀️ বিশেষ প্রশিক্ষন ও রোযার দাবী৷
দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই ফরজ কাজটি করতে গেলে একজন ব্যক্তির মধ্যে যে ধরনের নৈতিকশক্তি, সাহস ও মনোবল প্রয়োজন তা অর্জন করতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ঈমানদারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছেন৷
সেই ব্যবস্থাটির নাম হচ্ছে মাহে রমাদানের রোযা৷
রোযা ব্যক্তিকে পাপাচার থেকে, নফস ও প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ সহ , সকল লোভ ও লালসা থেকে দুরে রাখে , এবং আল্লাহর ভয়ে অনাহারে থেকে , ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করার মাধ্যমে , অভাবী দরিদ্রদের অবস্থা উপলব্ধি করার যোগ্য করে গড়ে তোলে৷
এছাড়া আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন, আনুগত্য, নিয়মাবর্তিতা, সহ এমন আরো অনেক বিষয়ে প্রশিক্ষন দেয় যার মাধ্যমে বাস্তব জীবনে কোরআনের অনুসরন করা সহজ হয়ে যায়৷
মুলত এই রোযাই হচ্ছে পবিত্র কোরআনের, বাস্তব অনুসরনের মাস ব্যাপি প্রশিক্ষণ৷
তাই কোরআন নাযিলের এই মাসে কোরআনকে বুঝে-বুঝে অধ্যায়ন করা, এবং এর বিধি বিধানকে প্রথমত নিজে মেনে চলা, পাশাপাশি নিজের পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশি, সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়নের জন্য, রমাদানের এই মাস ব্যাপী প্রশিক্ষনকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে একজন মুত্তাকীন হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো যেমন রোযার দাবী, তেমনি প্রত্যেক ঈমানদারের ঈমানী দাবীও বটে৷