পিবিএ ডেস্ক: সূরা দুখানের শুরুতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনিতে।’ এখানে আরবি ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রাত দ্বারা কোন রাত উদ্দেশ্য তা নিয়ে তাফসিরকারকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশের মতে ‘লাইলাতুল কদর’ বা শবেকদর উদ্দেশ্য।
‘শবেবরাত’ ফার্সি শব্দ। এর অর্থ মুক্তির রাত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এ রাতে আল্লাহ পাক দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বান্দাদের ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, কে আছ পাপমুক্ত হবে, আমি পাপমুক্ত করব। কে আছ অভাব-অনটন থেকে মুক্তি চাওয়ার, আমি মুক্তি দিব। কে আছ রোগ-শোক থেকে মুক্তি পেতে আমি মুক্তি দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন।’ এ কারণে রাতটি সাধারণ মুসলমানদের মাঝে ‘শবেবরাত’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তবে কোরআনের ভাষায় এ রাত ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ (বরকতময় রাত) এবং হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা মধ্য শাবানের রাত। বরকতময় এ রাতটিকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে দুই শ্রেণির মানুষ প্রান্তিকতার শিকার। একটি শ্রেণি পুণ্যময় এ রাতটিকে এমনভাবে উদযাপন করে, এ রাতের মাহাত্ম্যের সঙ্গে যার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। তারা এ পবিত্র রজনিতে এমনসব রুসুম-রেওয়াজি কাজকর্ম করে যা অনুচিত ও স্পষ্টত বেদাত। অপরদিকে আরেকটি শ্রেণি এ মহিমান্বিত রাতের ফজিলত ও মর্যাদা অস্বীকার করে। তাদের দাবি, শবেবরাতের ইবাদত-বন্দেগি কোরআন-সুন্নাহ সম্মত নয়। প্রকৃতপক্ষে এ উভয় শ্রেণিই সঠিক পথ থেকে দূরে রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, শবেবরাতে ভারসাম্যপূর্ণ আমলের কথা বিভিন্ন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোনো রূপ না দিয়ে এবং রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে নিজের শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগি করা, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ পাঠ করা এবং আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত।
কোরআনের আলোকে শবেবরাত
সূরা দুখানের শুরুতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে।’ এখানে আরবি ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রাত দ্বারা কোন রাত উদ্দেশ্য তা নিয়ে তাফসিরকারকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশের মতে ‘লাইলাতুল কদর’ বা শবেকদর উদ্দেশ্য। আর হজরত ইকরিমাসহ একদল তাফসিরকার বলেন, এর দ্বারা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান উদ্দেশ্য। (তাফসিরে কাবির, তাফসিরে রুহুল আমানি, তাফসিরে রুহুল বায়ান, তাফসিরে খাযেন, তাফসিরে তাবারি প্রভৃতি)। উভয় মতের মাঝে সমন্বয় করা হয় এভাবে যে, আল্লাহ পাক শবেবরাতে কোরআন অবতীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর শবেকদরে কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। হজরত থানভি (রহ.) তার ‘ওয়াজ ও তাবলিগ’ কিতাবে বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, কোরআনের অবতরণ দুইবার হয়েছে। এক রাতে অবতরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং আরেক রাতে তার বাস্তবায়ন হয়েছে। আল্লামা আবুস সাউদ তার সুপ্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থে লিখেন, লাইলাতুম মুবারাকা উদ্দেশ্য শবেকদর। কেউ কেউ বলেছেন, এর উদ্দেশ্য শবেবরাত। এ রাতে কোরআনুল কারিমের অবতরণ আরম্ভ হয়। অর্থাৎ শবেবরাতে কোরআন মজিদ লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয় এবং হজরত জিবরাইল (আ.) তা তখতির মধ্যে লিপিবদ্ধ করেন। (তাফসিরে আবি সাউদ)। ইমাম রাজি (রহ.) এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার শেষে লিখেছেন, শবেবরাতে লওহে মাহফুজ থেকে কোরআন অবতরণ শুরু হয় এবং শবেকদরে এসে তার সমাপ্তি ঘটে। (তাফসিরে কবির : ১৪/৩৪১)। তাফসিরে জালালাইনে উল্লেখ রয়েছেÑ লাইলাতুল মুবারাকা শবেকদর অথবা শবেবরাত। যে রাতে কোরআন সপ্ত আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হয়।’ মোটকথা, কোরআনে বর্ণিত ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ দ্বারা শবেরবাতের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। তাফসিরের কিতাবগুলোয় শবেবরাতের আরও চারটি নাম পাওয়া যায়। তা হচ্ছেÑ লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুর রহমাহ, লাইলাতুস সক, লাইলাতুল মুবারাকা।
হাদিসের আলোকে শবেবরাত
একাধিক হাদিস দিয়ে শবেবরাতের আমল এবং এ রাতের বিশেষ মর্যাদা প্রমাণিত। এখানে কয়েকটি হাদিস সনদের মানসহ উল্লেখ করা হলো : ১নং হাদিস: মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ১৫ শাবানের রাতে সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ এই হাদিসটি ইমাম তাবরানি মুজামুল কাবির এবং আওসাতে, ইমাম ইবনে হিব্বান তার ইবনে হিব্বানে, ইমাম বায়হাকি শুআবুল ঈমানে, হাফেজ আবু নুআইম হিলায়াতে, হাফেজ হায়সামি তার মাজমাউজ জাওয়াদ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। হাদিসটির সনদ সহিহ। ইমাম মুনজিরি, আল্লামা ইবনে রজব, কাসতালানি, জুরকানি এবং অন্যান্য হাদিস বিশারদ এ হাদিসটি আমলযোগ্য বলেছেন। শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানি (রহ.) তার সিলসিলাতুল আহাদিস সাহিহা গ্রন্থে এ হাদিসের সমর্থনে আরও আটটি হাদিস উল্লেখ করার পর লিখেছেন, সমষ্টিগতভাবে এ হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহিহ প্রমাণিত হয়। তারপর আলবানি (রহ.) ওই সব লোকের বক্তব্য খ-ন করেছেন, যারা কোনো ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবেবরাতের ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই।
২নং হাদিস : আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, শাবানের ১৫ তারিখ রাতে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় সৃষ্টিকুলের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং দুই শ্রেণির লোক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। দুই শ্রেণির লোক হচ্ছে হিংসুক এবং অন্যায়ভাবে হত্যাকারী।’ (মুসনাদে আহমদ : ২/১৭৬, তারগিব-তারহিব : ৪/২৩৯, সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা : ৩/১৩৬)। শায়খ আলবানি এ হাদিসটিকে হাসান সাব্যস্ত করেছেন। বিশিষ্ট হাদিস পর্যালোচক মুহাক্কিক আল্লামা শুয়াইব আরনাউত এভাবে মন্তব্য করেছেনÑ হাদিসটি অন্যান্য হাদিসের সহযোগিতায় সহিহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
৩নং হাদিস : উম্মুল মোমিনিন আয়শা (রা.) বর্ণনা করেন, এক রাতে আমি হুজুর (সা.) কে বিছানায় পেলাম না। আমি তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। দেখতে পেলাম, তিনি জান্নাতুল বাকিতে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার প্রতি অবিচার করবে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে তাশরিফ নিয়েছেন। হুজুর (সা.) বললেন, শাবানের ১৫ তারিখ রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের ভেড়া-বকরির পশমগুলোর চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ১/১৬৫, ইবনে মাজাহ : ৯৯, বায়হাকি শুআবুল ঈমান : ৪/১২৬, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১০/৪৩৮)। হাদিসটি হাসান এবং সহিহ লিগায়রিহি স্তরের। মুসনাদে আহমদের মুহাক্কিক বিশিষ্ট হাদিস পর্যালোচক আল্লামা হামজা যাইয়াত এই হাদিস সম্পর্কে বলেছেন, “ইসনাদুহু হাসানুন’ হাদিসের সূত্র হাসান স্তারের।”
শবেবরাত সম্পর্কে আরও অনেক সাহাবি থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন, আবুবকর সিদ্দিক, আলী, মুসা আশাআরি, আবু সালাবা খুশানি, আবুহুরায়রা, আউফ বিন মালেক, কাসির ইবনে মুররা, উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) প্রমুখ।
শবেবরাতের হাদিসগুলোর ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের চূড়ান্ত অভিমত
সালাফি আলেম আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরি বলেছেন, শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ফলে বোঝা যায়, শরিয়তে তার ভিত্তি আছে।’ (তুহফাতুল আহওয়াজি : ৩/৪৪২)।
মুহাদ্দিস আসর আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি বলেছেন, শবেবরাতের ফজিলত সহিহ হাদিসগুলোয় এসেছে। (আরফুশ শাযি : ১৫৬)।
আল্লামা নাসির উদ্দিন আলবানি (রহ.) শবেবরাত সম্পর্কীয় সব হাদিসের সনদ বিস্তারিত পর্যালোচনা করে বলেছেন, সব সূত্রের সমষ্টির কারণে শবেবরাত সম্পর্কীয় হাদিস নিঃসন্দেহে সহিহ।’ (সিলসিলা : ৩/১৮৩)।
সমকালীন বিশিষ্ট হাদিস পর্যালোচক শায়খ শুআইব আরনাউত মুসনাদে আহমদের টীকায় শবেবরাতের হাদিসগুলো পর্যালোচনা করে এমনই মন্তব্য করেছেন। পরিশেষে বলব, আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এই উম্মতকে ‘উম্মাতান ওয়াসান’ তথা মধ্যপন্থি উম্মত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সুতরাং ইসলামের প্রতিটি আমল যথাস্থানে রেখে আদায় করতে হবে। বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি কোনোটিই কাম্য নয়। ইসলাম ভারসাম্যতার ধর্ম এবং ইসলামের সব শিক্ষাই প্রান্তিকতা মুক্ত। আল্লাহ পাক আমাদের সহিহ বুঝ ও সহিহ আমল করার তৌফিক দান করুন।
লেখক: মাহবুবুর রহমান নোমানী, মুহাদ্দিস-জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী
পিবিএ/এফএস