‘কোরবানির’ ইতিকথা

পিবিএ ডেস্কঃ কোরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরব’ ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করাই কোরবানি। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর নামে পশু জবেহ করাকে কোরবানি বলে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট কিছু হালাল পশু জবাই বা কোরবানি করা হয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত ৩৪)

হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুল ও তাঁদের অনুসারীরা কোরবানি করেছেন। ইতিহাসে হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে প্রথম কোরবানির সূত্রপাত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল তখন একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না।’ তাঁদের একজন বললেন, ‘আমি তোমাকে হত্যা করবই।’ অপরজন বললেন, ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ২৭)

তারপর আল্লাহর নবী হজরত নূহ (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.) ও হজরত মুসা (আ.)-এর সময়ও কোরবানির প্রচলন ছিল। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ-প্রেমে স্বীয় পুত্রকে কোরবানি করার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আদিষ্ট হন। তিনি পর পর তিন দিন দৈনিক ১০০ করে মোট ৩০০ উট কোরবানি করেন। কিন্তু তা কবুল হলো না, বারবার আদেশ হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি করো।’ শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন, প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে হবে।

হজরত ইসমাইল (আ.) নিজের জানকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রতি এটা ছিল আল্লাহর পরীক্ষা। তাই পিতার ধারালো ছুরি শিশুপুত্রের একটি পশমও কাটতে পারেনি; পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে দুম্বা জবাই হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টাপ্রেমে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কোরবানি। আত্মত্যাগের সুমহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পশু কোরবানি করাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাঁদের স্মরণে এ বিধান অনাদিকাল তথা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের (কোরবানির) গোশত এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত ৩৭)

কাল পরিক্রমায় প্রতিবছর পবিত্র হজের পরে ঈদুল আজহা ফিরে আসে, যার প্রধান আকর্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কোরবানি। ঈদের দিন কোরবানিকে কেন্দ্র করে ধুমধামের সঙ্গে চলে মনের পশুপ্রবৃত্তি ত্যাগের মহোৎসব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্লমন হও।’ (ইবনে মাজা, তিরমিজি)
কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনদের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া মুস্তাহাব। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ এতিমখানা বা গরিব-মিসকিনদের দান করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত, দীন-দুঃখীরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষ্যে কেবল ভোগ নয়, ত্যাগ-তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত অকাতরে বিলিয়ে দিতে হবে এবং দান-সাদকা করতে হবে। হালাল উপার্জন, তাকওয়া ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার অপরিহার্য শর্ত।

ঈদুল আজহা শিক্ষা দেয় আল্লাহপ্রেমে তাকওয়া ও মনের একাগ্রতা নিয়ে কোরবানি করতে হবে, লোক দেখানোর জন্য নয়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ঈদুল আজহা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; এর প্রকৃত রূপ হলো মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর নামে উৎসর্গ করা। তাই উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা প্রভৃতি গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু ও কোরবানির পশুর মধ্যে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

পিবিএ/এমআর

আরও পড়ুন...