ক্রিকেট বিশ্বকাপে অনলাইন জুয়ায় দেশ থেকে পাচার অর্ধ কোটি টাকা, গ্রেফতার ৪

বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের কার্যক্রম দেশে পরিচালনার মাধ্যমে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া চক্রকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- চক্রের অন্যতম মূলহোতা মো. নিশাত মুন্না (২০), মো. কামরুল ইসলাম শুভ (২৭), মো. সুমন (৩৫) ও মো. নাজমুল হোসেন বাবু (৩১)।

এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১৬টি মোবাইল ফোন, ১৮টি সিম কার্ড, ১টি সিপিইউ, ১টি মনিটর।

সোমবার (২৩ অক্টোবর) গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর মালিবাগে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, দেড় বছর ধরে চক্রটি বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের দেশিয় কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম মূলহোতা গ্রেফতার নিশাত মুন্না। তার নেতৃত্বে চক্রের ৭-৮ জন সদস্য বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের প্রচার, অ্যাকাউন্ট খোলা, মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অর্থ লেনদেন, হুন্ডির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশে অর্থ পাঠানোর সঙ্গে জড়িত ছিল।

মূলত ফুটবল বিশ্বকাপ, ক্রিকেট বিশ্বকাপ, আইপিএল, বিপিএল, বিভিন্ন ফুটবল লীগ/টুর্নামেন্ট ও অন্যান্য খেলাকে কেন্দ্র করে দেশেরে উঠতি বয়সের তরুণদেরকে টার্গেট করে এই অনলাইন জুয়ার প্রচার করতো চক্রটি।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ চক্রের কেউ বিভিন্ন বিদেশি বেটিং সাইটের বাংলাদেশের প্রচার/মার্কেটিংয়ের কাজ করত; কেউ আগ্রহী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সাইটের অ্যাকাউন্ট খুলে দিত; আবার কেউ অ্যাকাউন্ট করা ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তা হুন্ডির মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম পরিচালনাকারীর কাছে প্রেরণ করত।

কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে কন্টেন্টের সঙ্গে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন, সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন, সরাসরি মানুষের কাছে বলার মাধ্যমে এই জুয়ার সাইটের প্রচারের কার্যক্রম পরিচালনা করত। পরবর্তীতে বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী ব্যক্তিরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাকাউন্ট খুলত। কোনো নতুন গ্রাহক তাদের মাধমে বেটিং সাইটে অ্যাকাউন্ট খুললে তারা কমিশন পেত।

গ্রেফতাররা 1xBet, MeltBet, PariMatch, Velkiex, BjBaji Casino, Ludo Matchসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটের কার্যক্রম দেশে পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিল।

র‍্যাব মুখপাত্র আরও বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি কর্তৃক অনলাইন জুয়া বা বাজি সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপস এবং ওয়েবসাইট ইতোপূর্বে বন্ধ করা হলে তারা ডোমেইন পরিবর্তন করে পুনরায় অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে জুয়া চালু করে। তারা নামে বেনামে একাধিক সিম সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে অনলাইন জুয়ার অর্থ সংগ্রহ করতো এবং প্রাপ্ত অর্থ থেকে নিজেদের লভ্যাংশ রেখে অবশিষ্ট টাকা তারা হুন্ডির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশে অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম পরিচালনাকারীর কাছে পাঠাতো।

গ্রেফতাররা নিজেদের প্রাপ্ত লভ্যাংশের টাকা দিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলতো এবং লভ্যাংশের টাকা জুয়া খেলে নষ্ট করতো বলে জানায়। তারা অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে অদ্যাবধি অর্ধ কোটি টাকার অধিক অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানা যায়।

চক্রের মূলহোতা কে এই নিশাত মুন্না-

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার নিশাত মুন্না বিভিন্ন অনলাইন বেটিং সাইটের দেশিয় কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম মূলহোতা। সে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়লয়ে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত। সে ঘওঝঐঅঞ গটঘঘঅ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল এবং ঘরংযধঃ গঁহহধ (সাইলেন্ট কিলার) নামে একটি ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন রোস্টিং/বিতর্কিত ভিডিও তৈরি করে প্রচার করতো। গত দেড় বছর আগে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গ্রুপের বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখে অনলাইন জুয়ার প্রতি আশক্ত হয়।

তিনি বলেন, গ্রেফতার নিশাত অনলাইনের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বেটিং সাইটের প্রসারের জন্য ভিডিও বানাতে তাকে দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়। পরবর্তীতে সে অধিক অর্থ লাভের আশায় বিভিন্ন বেটিং সাইটের প্রচার ও অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হয়। সে তার ইউটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার তৈরিকৃত ভিডিওতে বিভিন্ন অনলাইন জুয়া সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করতো। সে তার প্রতিটি ভিডিওতে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ১০ হাজার টাকা করে গ্রহণ করতো বলে জানায়।

পরবর্তীতে নিশাত নিজেও অনলাইন জুয়ার কার্যক্রম শুরু করে। ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী ব্যক্তি তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে তাদেরকে অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়ার বিষয়ে গ্রেফতার কামরুলের কাছে প্রেরণ করে।

জুয়ার অ্যাকাউন্ট খুলে ৩০০ টাকা পেতেন কামরুল-

গ্রেফতার কামরুল স্নাতক শেষ করে একটি মোবাইল কোম্পানির সেলস রিপ্রেসেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করত। দেড় বছর আগে থেকেই গ্রেফতার নিশাতের সঙ্গে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে সে নিশাতের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত হয়।

কামরুল স্বল্প সময়ে অধিক অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন পরিচিত লোকদের অনলাইন জুয়ার সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে উদ্বুদ্ধ করতো এবং আগ্রহী ব্যক্তিদের অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে দিতো। সে প্রতিটি একাউন্ট খুলার জন্য ৩০০ টাকা কমিশন পেত।

মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায়ীর নামে নিবন্ধনকৃত সিম সংগ্রহ করত সুমন-

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার সুমন অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিল। সে রাজধানীর মালিবাগে স্টেশনারী ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা করত। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসার সুবাধে গ্রেফতার কামরুলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতার কামরুল তাকে স্বল্প সময়ে অধিক অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন বেটিং সাইটের অ্যাকাউন্ট খুলে দেয় এবং তার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ার সকল টাকা লেনদেন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। গ্রেফতার সুমন পরিচয় গোপন করে অনলাইন জুয়ার আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য সে কৌশলে তার পাশের একজন মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায়ীর নামে নিবন্ধনকৃত সিম সংগ্রহ করে, যাতে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট হিসেবে লেনদেন করা যেত।

পরবর্তীতে সুমন বিভিন্ন অনলাইন বেটিং সাইটের সকল প্রকার লেনদেন ওই মোবাইল সিমটি দ্বারা নিবন্ধনকৃত মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করতো। এছাড়াও সে নামে-বেনামে বিভিন্ন সিম সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেন করতো। গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয় অর্থ সে গ্রেফতা নিশাত মুন্না ও কামরুলের সহায়তায় হুন্ডির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশে অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম পরিচালনাকারীর কাছে পাঠাতো।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা করতেন নাজমুল-

র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেফতার নাজমুল নোয়াখালীতে থাই গ্ল্যাস ব্যবসা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা করতো। সে এক বছর আগে গ্রেফতার কামরুলের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত হয়। সে নোয়াখালী অঞ্চলে বেটিং সাইটের জন্য গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করতো এবং বেটিং সাইটে টাকা রিচার্জ/বেটিং সাইট থেকে টাকা উত্তোলনের কার্যক্রম পরিচালনা করতো।

এছাড়াও নাজমুলের নামে-বেনামে বিভিন্ন সিম সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেন করতো। সে গ্রেফতার কামরুল ও নিশাত মুন্নার সহায়তায় গ্রাহকদের থেকে প্রাপ্ত অর্থ পার্শ্ববর্তী দেশে অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম পরিচালনাকারীর কাছে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত ছিল।

আরও পড়ুন...