এভিয়েশনে হিউম্যান রিসোর্সের ব্যয় মিটাতে পৃথিবীর অনেক এয়ারলাইন্সকেই হিমশিম থেতে হচ্ছে। কোনো এয়ারলাইন্স তার অপারেশন কস্ট কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করলেই প্রথমেই স্টাফ কার্টেল করতে দেখা যায়, দেখা যায় বেতন কাঠামো পূনর্গঠন করতে, অর্গানোগ্রামকে পূনর্বিন্যাস করতে। বড় উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারির সময় সর্বপ্রথম যে খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা হচ্ছে এভিয়েশন, ট্যুরিজম এন্ড হোটেল ইন্ডাস্ট্রি। এই ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানাবিধ উপায়ে কস্ট কার্টেল করে অক্সিজেন সরবরাহ করার চেষ্টা করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এভিয়েশন এন্ড ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো স্বাভাবিকতা আসেনি।
সকল শিল্পের গতিশীলতা তখনই বজায় থাকবে, যখন আকাশপথের গতিশীলতা বজায় থাকবে। এই আকাশ পথকে সচল রাখতে আকাশ পরিবহনকে বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন দেশ কোভিড কালীন সময়ে এভিয়েশন এন্ড ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিকে নানাভাবে প্রনোদণা দিয়ে, বিভিন্ন ধরনের চার্জ বিশেষ করে এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ মওকুফ করে ইন্ডাস্ট্রিকে সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে বিভিন্ন দেশের এভিয়েশনের রেগুলেটরি অথরিটিসহ বিভিন্ন সরকারী সংস্থা। কিন্তু বাংলাদেশের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি বিশেষ করে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সসমূহ আসলে কতটুকু সহায়তা পেয়েছিলো তা ভাবনার বিষয়।
প্রনোদণা বলতে যা বোঝায় তা ছিলো জাতীয় বিমান সংস্থার জন্য। কোনো ধরনের চার্জ মওকুফ তো দূরের কথা উল্টো যাত্রীদের উপর এয়ারপোর্ট ডেভেলোপমেন্ট ফি, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফি নামে নতুন নতুন চার্জ আরোপ করা হয়েছে। যা দিন শেষে যাত্রীদের ভাড়ার উপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে।
উড়োজাহাজের জন্য জেট ফুয়েল সরবরাহকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত পদ্মা অয়েল কোম্পানি। সরকারী প্রতিষ্ঠান কিন্তু সর্বদাই লাভ-লস বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সেখানে বিপরীতচিত্রই ফুটে উঠছে প্রতিনিয়ত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে জেট ফুয়েলের রেকর্ড মূল্য বর্তমানে বিরাজ করছে। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এয়ারলাইন্সকে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য প্রদান করতে হয় ১১১টাকা আর আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য জেট ফুয়েল বাবদ প্রতি লিটারে খরচে করতে হয় ১.০৯ ডলার। এখানেও চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে দেশীয় এয়ারলাইন্স এবং ৯৫% অধিক যাত্রীই হচ্ছে বাংলাদেশী নাগরিক। অথচ এই অভ্যন্তরীণ রুটেই অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে দেশীয় এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশী নাগরিকদের।
একটি এয়ারলাইন্স এর যেকোনো রুটের অপারেশনাল কস্টের প্রায় ৪০%-৪৬% খরচই বহন করতে হয় জেট ফুয়েল খরচ বাবদ। অথচ এই করোনা মহামারির সময় থেকে এখন পরযন্ত গত ১৯ মাসে প্রায় ১৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে জেট ফুয়েলের মূল্য। ফ্লাইট পরিচালনার জন্য জেট ফুয়েলের জন্য প্রতি লিটারে প্রায় ১১ থেকে ১২ টাকা বেশী দিতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী দেশীয় এয়ারলাইন্সকে।
দেশের বেসরকারী এয়ারলাইন্স ও জাতীয় বিমান সংস্থার মধ্যে বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে যেকোনো খারাপ সময়ে রাষ্ট্র পাশে এসে দাড়ায় অথচ বেসরকারী এয়ারলাইন্স হিসেবে সর্বদাই সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কয়েকবছর আগে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা দেনা থেকে দায়মুক্তি দিয়েছিলো অথচ সেই সময়ে ব্যবসায় টিকে থাকতে না পেরে বিভিন্ন বেসরকারী বিমান সংস্থা বন্ধ করে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার কাছে পদ্মা অয়েল কোম্পানী প্রায় ২০০০ কোটি টাকা এবং সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বিভিন্ন চার্জ বাবদ প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার অধিক পাওনা। অথচ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আবার রাষ্ট্রীয বিমান সংস্থার বিভিন্ন অর্থ বছরে লাভের হিসাব দেখা যায়। এই ধরনের হিসাবে কি লাভ হয় নাকি আয় হয় তা কোনোভাবেই স্পষ্ট হয়ে উঠে না।
উড়োজাহাজের বিভিন্ন রুটের ভাড়ার ব্যাপারে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ১৯৯৯ কিংবা ২০০০ সালে জেট ফুয়েলের মূল্য ছিলো প্রতি লিটার প্রায় ২৫ সেন্ট, কিংবা ১৪ টাকা তখন ডলারের এক্সচেঞ্জরেট ছিলো প্রায় ৫০ টাকা, তখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের মিনিমান ভাড়া ছিলো প্রায় ৩০০০ টাকা। তৎকালীন সময়ে এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনোটিক্যাল চার্জসহ অন্যান্য চার্জ বর্তমানের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ ছিলো আবার বাংলাদেশের পার ক্যাপিটা ইনকাম ছিলো ১০০০ ডলারের কম। অথচ বর্তমানে জেট ফুয়েলের মূল্য প্রায় ১১১টাকা, পার ক্যাপিটা ইনকাম প্রায় ২৭০০ ডলার, এ্যরোনোটিক্যাল ও নন-এ্যরোনোটিক্যাল চার্জসহ অন্যান্য চার্জ পূর্বের তুলনায় প্রায় তিনগুন অথচ ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের মিনিমাম ভাড়া ৪৫০০টাকা। তারপরও একটি কমন বক্তব্য রয়েছে এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়া অনেক বেশী। এয়ারলাইন্সগুলোর আয়ের সাথে যদি খরচের খুব বেশী রকমের তারতম্য দেখা যায় তখন এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসা গুটিয়ে দিতে বাধ্য হয়্। গত ২৫ বছরে বাংলাদেশের এভিয়েশন সেক্টরে বিশেষ করে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স এর ৮ থেকে ৯টি এয়ারলাইন্স বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
নাইন ইলিভেন কিংবা করোনা মহামারির কারনে এভিয়েশন সেক্টরে নানাবিধ খরচের অবতারণা ঘটে। স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন করার কারনে আসন সংখ্যা সীমিতকরণ, রেগুরেটরি অথরিটির নির্দেশনা ইত্যাদি কারনে অপারেশন কস্টের আস্ফালন ঘটে অথচ আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আয় আর ব্যয়ের মধ্যে চরম বৈষম্য দেখা দেয়।
এয়ারলাইন্সগুলো সাধারণত কোনো উৎসবকে সামনে রেখে ভাড়ার তারতম্য ঘটায় না। বাংলাদেশে ঈদ-উল ফিতর কিংবা ঈদ উল আযহা কিংবা বিভিন্ন জাতীয় দিবসকে সামনে রেখে যাত্রীদের আকাশ পথ ব্যবহারের আধিক্য দেখা যায়। অনেক যাত্রী সেই সব দিবসকে সামনে রেখে অনেক আগে থেকেই ট্রাভেল প্ল্যান সাজিয়ে টিকেট সংগ্রহ হরে নেয়, ফলে কম ভাড়ায় ট্রাভেল করে থাকে। একই সময়ে ট্রাভেল করার জন্য শেষ সময়ে এসে অনেকে ট্রাভেল করার পরিকল্পনা সাজিয়ে থাকে, ফলে ভাড়ার ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে থাকে। তখনই যাত্রীদের কাছে মনে হয় এয়ারলাইন্সগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, সাধারণত ঈদের সময় একদিকে যাত্রীদের চাপ থাকে, যখন ভাড়া ক্যালকুলেশন করা হয়, তখন সেই বিষয়টিকেও মাথায় রেখে অপারেশন কস্ট বিবেচনায় ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।
সারা বছর যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে এয়ারলাইন্সগুলো যাতায়াত করে সেখানে এয়ারলাইন্সগুলো ঈদের সময় বিভিন্ন গন্তব্যে গড় যাত্রী থাকে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ। কারন হিসেবে ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক থাকার কারনে গড় যাত্রী কম হয়ে থাকে।
এয়ারলাইন্স পরিচালনার ব্যয় আর আয়ের বৈষম্যই এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকাই দূরূহ করে তুলছে বাংলাদেশের বেসরকারী বিমান সংস্থাসমূহকে। খরচের খাতগুলো যাতে অযাচিতভাবে এভিয়েশন ব্যবসায় প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সেইদিকে কঠোরভাবে দৃষ্টিপাত করা উচিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম,মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স