গাজী মনিরুজ্জামান,খুলনা ব্যুরো: মালিকের অভাবে অযতœ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে প্রায় শতাব্দীকালের পুরনো খুলনার ঐতিহ্যবাহী উদ্যান ‘প্রেমকানন’। বাগানের ভেতরে বড় বড় ঘাস আর জংলা। নিয়মিত পরিস্কার না করায় ফুলবাগানটিও নষ্ট হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, প্রেমকাননে আগে মানুষ ভীড় করতো সকাল-সন্ধ্যা। এখন আর কেউ ঘুরতে আসেন না। সংস্কারের নামে সারাক্ষনই গেট বন্ধ থাকে। ফলে বাইরে থেকে কেউ এলেও ভিতরে ঢুকতে পারেন না। অপরদিকে, উদ্যানটির সঙ্গে যুক্তরা এর হারানো দিনের সেই আকর্ষণীয় রূপ ফিরিয়ে আনতে উন্মুখ। কিন্তু উপযুক্ত লোক না পাওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রায় ১০০ বছর আগে বাংলা ১৩৩৫ সালের ২৫ মাঘ ইংরেজি ১৯২৮ সালে নগরীর কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে জোড়াগেটের পশ্চিমপাশে নুরনগর এলাকায় প্রায় ৫ বিঘা জমির উপর মাড়োয়ারী পাট ব্যবসায়ী মঙ্গলচাঁদ চুনীলাল মেহতা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায়, মাড়োয়ারী জমিদার মঙ্গলচাঁদ চুনীলাল ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। শ্রীকৃষ্ণ-রাঁধার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় গড়ে তোলেন ‘প্রেমকানন’ নামের এই উদ্যান। আবার কেউ বলেন, খুলনার বড়বাজারের শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দিরে পূজার ফুলের জোগান মেটাতেই ধর্মানুরাগী চুনীলাল মেহতা প্রতিষ্ঠা করেন প্রেমকানন।
প্রেমকাননের মূল ফটক লোহার তৈরী। গেটের ওপরে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা আছে ‘প্রেমকানন’। কাননে প্রবেশের জন্য কোন টাকা লাগে না। ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে কাননের প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গা ভরে গেছে জংলায়। অথচ আগে প্রবেশ পথ দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়তো দক্ষ কর্মীর হাতে কামিনী বা ঝাড় জাতীয় গাছ শৈল্পিকহাতে ছেঁটে বানানো হাতি, পেখমমেলা ময়ূর, লাঙল কাঁধে চাষী, হরিণ, ঘোড়া, সোফাসেট, শিয়াল পন্ডিত ছাত্রদের পড়াচ্ছেন ইত্যাদির কাঠামো। কথিত আছে, গভীর রাতে এখানে জীন-পরীর আনাগোনা দেখা যেত। তবে এখন এসবের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সবই এখন প্রেমকাননের অতীত ইতিহাস।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষিকা সাবেরা সুলতানা বলেন, একসময় বাহারী ফুলের বাগান, সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো মাটির রাস্তা, স্বচ্ছ পানির পুকুর, পুকুরের সঙ্গে মেলানো মন্দির, গাছের তৈরী পশু-পাখি, বসার জায়গা, সম্পূর্ণ নেট দিয়ে ঘেরা কারূকার্যময় ‘পরীর ঘর’ দৃষ্টি কাড়ে বিনোদনপ্রেমী মানুষের। সব মিলিয়ে যে কারও মন ছুঁয়ে যাওয়ার মত জায়গা প্রেমকানন। এটি ছিল সে সময় প্রেমিক-প্রেমিকাদের তীর্থস্থান। ফুল বাগান আর বাঁধানো পুকুরঘাটের পাশে বসে তারা সময় কাটাতো। সিনেমার শুটিং পর্যন্ত হয়েছে এখানে। ঈদ, পূজা কিংবা সরকারি ছুটির দিনে বিনোদনপ্রেমীরা এখানে ভীড় জমাতো। আড্ডা চলতো সকাল থেকে রাত অবধি। কিন্তÍু সময়ের পরিবর্তনে আজ আর তেমনটি নেই।
প্রেমকাননের দোতলা ভবনের গায়ে লেখা আছে, ‘খুলনা বাজারে স্থাপিত শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ ভগবানের চরণকমলে প্রেমকানন বাগিচা অর্পণ করা হইল। দাস মঙ্গলচাঁদ চুনীলাল, ২৫ শে মাঘ, ১৩৩৫ সাল।’ মঙ্গলচাঁদ চুনীলাল উদ্যানটি মন্দিরকে দান করার সময় সেখানে একটি দোতলা পাকা বাড়ী ও পুকুর ছিল। বাড়ীতে ছিল দামী আসবাব পত্র, চিত্রকলা, তৈজসপত্র ইত্যাদি।
১৯৫০ সাল পর্যন্ত মন্দিরের পক্ষে মঙ্গলচাঁদ চুনীলালের বড় ছেলে প্রেমসুখ মেহতা (বর্তমানে প্রয়াত) বাগিচাটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। তখনো পূর্ব ভারতের উড়িষ্যার অধিবাসী ভীম, অর্জুন, মাধবসহ কয়েকজন মালী বাগানটির পরিচর্যা করতেন। সত্যনারায়ণ মন্দির থেকে তখন ভগবান জিউর শোভাযাত্রা প্রেমকাননে যেত। সেখানে মেলা বসতো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানকার প্রায় সব কিছুই লুটপাট হয়ে যায়। দোতলা ভবনটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়। অরক্ষিত হয়ে পড়ে প্রেমকানন।
প্রেম কাননের কেয়ারটেকার শিবু প্রসাদ রায় জানান, তিনি প্রায় ২২ বছর ধরে মালী হিসেবে বাগান পরিচর্যা করছেন। মালী শিবু আরো বলেন, এখন এখানে বিয়েসহ নানা রকমের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে এরজন্য বাড়তি কোন টাকা দিতে হয়না। শুধু পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কিছু টাকা এবং বিদ্যুৎ বিল যা আসে তা পরিশোধ করতে হয়। পূজা কমিটি বছরে একবার এখানে রথ পূজা করেন। যা ১২-১৫ দিন ধরে চলে। এসময় পূণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর ভীড়ে মুখরিত হয় প্রেমকানন।
প্রেমকাননের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন খুলনার বড়বাজারের সেবাইত এস্টেট অব শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য গোপী কৃষাণ মুন্ধড়া। প্রেমকাননের দুরবস্থার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খুলনার প্রেমকানন একটি ঐতিহ্যবাহী উদ্যান। আমরা এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনতে চাই। কিন্তু দক্ষ মালীর অভাবে গাছের ডালপালা ছেঁটে পশুপাখির অবয়ব তৈরী করা যাচ্ছেনা। তেমন কেউ পেলে উপযুক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করবো। এছাড়া আমরা প্রেমকাননের ভিতরের পুকুরে থাকা বিরল প্রজাতির কচ্ছপও সংরক্ষণ করতে চাই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, প্রেমিক-প্রেমিকারা এখানে আসলে তাদের লাঞ্চিত করে মোবাইল, টাকা ছিনতাই করে নেয় একটি চক্র। যে কারণে ভয়ে আর এখানে কেউ আসতে চায়না।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এ্যাডঃ মোঃ বাবুল হাওলাদার বলেন, প্রেমকাননকে যদি ঢেলে সাজানো হয়, ঠিকমত পরিচালনা করা হয়, তা হলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসবেন। শহরের লোকজনও চিত্তবিনোদনের জায়গা পাবেন। সৌন্দর্যপ্রিয় নগগরবাসীর পক্ষে তিনি দ্রুত প্রেমকাননের পুরানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান।