খুলনায় সরকারি জমির সুবিধা ভোগ করছে ভাটা মালিকরা


শেখ হারুন অর রশিদ,পিবিএ,খুলনা: খুলনায় সরকারি জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য ইটভাটা। এ জন্য কোন প্রকার অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি ভাটা মালিকরা। জমি বাবদ বাড়তি কোন খরচ না থাকায় বেশিরভাগ ভাটা মালিক বেছে নিয়েছেন নদী তীরবর্তি চর ভরাটি জায়গা। এতে ভাটা মালিকরা লাভবান হলেও সংকুচিত হচ্ছে নদী। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে স্থানীয় পরিবেশ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, খুলনায় ৭০টি ইটভাটার জন্য প্রায় একশ’ একর চরভরাটি জমি দখল করেছেন ভাটা মালিকরা। এর মধ্যে রূপসা উপজেলায় ২০ একর, ডুমুরিয়া উপজেলায় ৩০ একর, তেরখাদা, দীঘলিয়া ও পাইকগাছা উপজেলায় ১৩ একর, কয়রা উপজেলায় ৭ একর নদীর চরের জমি দখল করে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়া জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও ফসলি জমিতেও অবৈধবভাবে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ইটভাটা। এসব ইটভাটার বেশিরভাগেরই কোন অনুমোদন নেই। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর পরিবেশ বিরোধী কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে প্রভাবশালী ভাটা মালিকরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রূপসা উপজেলার আঠারোবেঁকি নদীর চর দখল করে বেশ কয়েকটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। উপজেলা প্রশাসন কয়েক মাস আগে দুটি ভাটায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু ওই দুটি ভাটার মালিক আবারও ইট তৈরির কাজ শুরু করেছেন। পালেরহাট বাজারের খুব কাছে রাস্তার সঙ্গে যুক্ত করে দুটি ভাটার ইটের স্তুপ করে রাখা হয়েছে। রূপসা ও তেরখাদা উপজেলার সেনেরবাজার-কালিয়া সড়কের শোলপুর, মল্লিকপুর ও মোকামপুর গ্রাম এলাকায় ভৈরব ও আতাই নদীর তীরে সাতটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন মাত্র একটি ভাটার লাইসেন্স দিয়েছে। রূপসা উপজেলার ভৈরব নদের তীরে লাইসেন্সবিহীন দুটি ইটের ভাটা নদীর অনেকখানি গিলে খেয়েছে। ওই ভাটা দুটি উচ্ছেদ করার জন্য মাসপাঁচেক আগে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ওই ভাটা দুটি উচ্ছেদের জন্য তালিকা পাঠিয়েছে। তবে এখনো উচ্ছেদ হয়নি। ওই ভাটা মালিক একই নামে তেরখাদার মল্লিকপুর গ্রামে আরো একটি ভাটা গড়ে তুলেছেন। সেটিরও অনুমোদন নেই।

একইভাবে দিঘলিয়া উপজেলার চন্দনিমহল গ্রামে ভৈরব নদের তীরে গড়ে উঠা একটি ইটভাটার অনুমোদন নেই। কয়রা সেতুর কাছে কয়রা নদীর চরভরাটি প্রায় ৭ একর জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে সোহরাব ব্রীকস নামের ইটভাটা। এছাড়া কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁষে আমীর আলী ব্রীকস, ইসলামপুর গ্রামের কয়েক একর ফসলি জমি দখল করে সানা ব্রীকস নামের ইটভাটা চলছে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে। এসব ভাটায় ইট প্রস্ততের জন্য নদীর চরের পলি মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদীর চর দখল করে গড়ে উঠেছে ৩৫টির মত ইটভাটা। আইন উপেক্ষা করে গড়ে ওঠা এসব ভাটার বেশির ভাগই নদীর পাড় থেকে মাটি সংগ্রহ করছে। প্রতিবছর কয়েক ফুট করে বাঁধ দিয়ে তারা নদী দখল করেই চলেছে। এতে নদী ধনুকের মতো বেঁকে গেছে। তাছাড়া বেশির ভাগ ভাটা মালিকরা নদীর জায়গায় বেড়িবাঁধ দিয়ে সেখানে পুকুর তৈরি করে অবৈধভাবে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে পলি জমিয়ে মাটি সংগ্রহ করছেন। এতে একসময়ের প্রবল খরস্রোতা ভদ্রা নদী আজ শুকিয়ে মরতে বসেছে।

দেখা গেছে, পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই এসব ভাটার কয়েকটিতে কয়লার পরিবর্তে কাঠও পোড়ানো হচ্ছে। এদিকে ইট বহনের ফলে গুরুত্বপূর্ণ শোলগাতিয়া-দৌলতপুর সড়কটিও ভেঙে ব্যবহার অনুপযোগী হয়েছে। জেলার পশ্চিম প্রান্তের ইটভাটা মালিকদের নদী দখলের ফলে বিলীন হয়েছে খর্ণিয়া-শোভনা সড়ক। লোকালয় ও ফসলি জমির উপরে গড়ে ওঠা এসব ভাটায় ইট পোড়ানোর ফলে এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।
খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার নয়টি উপজেলায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইটভাটা রয়েছে ১১৭টি। এর মধ্যে রূপসায় ৪৯টি, ডুমুরিয়ায় ২৭টি, ফুলতলায় ১৩টি, পাইকগাছায় ১১টি, তেরখাদায় ছয়টি, বটিয়াঘাটায় চারটি, দিঘলিয়ায় তিনটি ও দাকোপে একটি ভাটার অনুমোদন রয়েছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলার ৯ উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ১৪২টি। এর মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র নেই ১১টির।

জেলার বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদন নিয়ে যেমন ইটভাটা গড়ে উঠেছে, তেমনি অনুমোদনহীনভাবেও অসংখ্য ভাটা গড়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রেই ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন উপেক্ষা করে ইট তৈরি করা হচ্ছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুসারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত উপজেলা, ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার করে কোনো ভারী যানবাহনে ইট অথবা ইট তৈরির কাঁচামাল পরিবহন করা যাবে না। আইন অমান্য করে ওই এলাকার বিভিন্ন সড়ক দিয়ে ট্রাকে ইট ও কয়লা বহন করা হচ্ছে। ইট-বালি বহনের কাজে ট্রলারের ইঞ্জিন বসানো যান (ট্রলি) ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনার পাশাপাশি যানজট হচ্ছে। ট্রলির কালো ধোঁয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়ছে স্থানীয়রা।

নদী দখল করে ইটভাটা স্থাপনের বিরুদ্ধে খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর তালিকায় রয়েছে খর্ণিয়ার শাহাজান জমাদ্দারের নুরজাহান ব্রিকস, গাজী আব্দুস সালামের সেতু ব্রিকস ও গাজী হুমায়ুন কবীর বুলুর কেবি-২ ব্রিকস। এরই মধ্যে ডুমুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরেজমিন তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় পরিচালক হাবিবুল হক খান বলেন, ‘নদীর জায়গা দখল ও স্থানীয় পরিবেশের ক্ষতি করে কোনোভাবেই ইটভাটা পরিচালনা করা যাবে না। অবৈধ এসব ভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।’

খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জিয়াউর রহমান বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটার তালিকা তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন রূপসা ও ফুলতলা উপজেলায় লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি ইটের ভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। ওই সব ভাটা মালিকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের আইন অনুযায়ী ভাটা পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

পিবিএ/এমএসএম

আরও পড়ুন...