ওয়াদুদ ভূইয়া: একটি বিষয় আমার মাথায় গত প্রায় ১০ বছর ধরে প্রায়ই ঘুরপাক খায়। অনেক সময়ই এই বিষয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে জাগে, সময়ের অভাবে ক্ষ্রান্ত দিই। আজ আবার মাথায় আসায়, লিখতে বসলাম। আমার জানা মতে বা ধারনা মতে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকদের সংখ্যা অনেক বেশি। এর প্রমাণ হচ্ছে, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিএনপিপন্থী সাংবাদিক প্যানেলের জয়ী হওয়া। অথচ এটি একটি প্রমানিত সত্য যে, গণমাধ্যম থেকে বিএনপি উপকৃত হবার বদলে সবসময় ক্ষতিগ্রস্থই বেশি হয়েছে। অর্থাৎ নিজেদের এতো বেশি সমর্থক সাংবাদিক থাকা সত্বেও বিএনপি গণমাধ্যম থেকে সুবিধা পাচ্ছে না।
আমি কোনো অনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বা সুবিধার কথা বলছি না। আমি নায্য সুবিধার কথা বলছি। যে হিসেবে গণমাধ্যমে বিএনপি’র সমালোচনা করা হয়েছে বা হচ্ছে, সেভাবে কি আওয়ামী লীগের করা হয়েছে বা হচ্ছে? বিএনপি সরকারে থাকাকালেও মারাত্মকভাবে একপেশেভাবে সমালোচিত হয়েছে, আবার বিরোধীদলে থেকেও হচ্ছে। আন্দোলন করলে বলে, হরতাল করে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করে। আর না করলে বলে, বিএনপি আন্দোলন করে না কেন বা বিএনপি আন্দোলন করতেই পারে না! কিন্তু বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারী নির্বিচারে গুলিব্র্ষণ ও গণ-গ্রেফতারের প্রসঙ্গটি কেই উচ্চারণ করতেও রাজী নয়।
দল বা সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগ বিএনপি’র চেয়ে ভালো করছে – এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। একটি গণমাধ্যমের স্বতন্ত্র সম্পাদকীয় নীতিমালা থাকে। সেই নীতিমালা অনুযায়ীই সেই গণমাধ্যম পরিচালিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে অনেক সময় সেই ‘নীতিমালা’ ধরে রাখতে গিয়ে সাংবাদিকতার মূল নীতিমালা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হয় – এই কথায় বোধকরি সবাই আমার সাথে একমত হবেন। প্রতিবেদন বা মতামত লেখার সময় এখনও শতভাগ পেশাদারিত্ব নিয়ে সবসময় এই দেশের সাংবাদিকরা কাজ করছেন বা করতে পারছেন বলেও আমার মনে হয় না। তাই নিজেদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির একটা ছাপ থাকবেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিএনপি’র এতো বেশি সাংবাদিক থাকা সত্বেও আমরা সেই ছাপ খুঁজে পাওয়া তো দূরে থাক উল্টোটাই বেশি চোখে পড়ে কেন? এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর একই। প্রত্যেক সংবাদপত্রের পলিসি নির্ধারন করেন মালিকপক্ষ ও সম্পাদক। এটাই যেন এ দেশের রীতি। এর বাইরে যাবার সুযোগ কারও নেই, এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের হর্তাকর্তারা বিএনপি-বিরোধী। বহুল প্রচলিত সংবাদপত্রের প্রায় সবগুলোরই মালিক ও সম্পাদক বা গুরুত্বপূর্ন পদগুলোতে বসে আছেন বিএনপি-বিরোধীরা। ফলে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিকরা সেই বেঁধে দেয়া নীতিমালার বাইরে যেতে পারেন না। আমি বলবো না, সেসব সম্পাদকের বা কর্মকর্তার এই পদে থাকার যোগ্যতা নাই। বাংলাদেশ জন্মের আগ থেকেই এ দেশে বাম-প্রগতিশীল বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িতরাই অধিকাংশই ছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মী। এখনও সেই অবস্থা পাল্টায়নি। তবে পেশাদারিত্ব অল্প হারে হলেও, এখন বাড়ছে, এটাও সত্যি। বাম রাজনীতিতে জড়িতরা মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ বা অন্যান্য বিপ্লবী ধ্যান ধারণার সাথে জড়িত থাকেন। এর ফলে তাদের মেধা-মননে লেখনী জিনিসটা গেঁথে যায়। সেই কারণেই কিনা কি জানি, এই সাংবাদিকতা জগতে এদের অবস্থান ও কতৃত্ব বেশ ঈর্ষনীয়। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বেশিরভাগ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন পদাধিকারী সাংবাদিকরা সেই কাতারে পড়েন। এদের কেউ কেউ হয়তো কোনো কারণে এখনকার সরকারের বিরোধীতা করছেন। কিন্তু এদের বেশিরভাগেরই মধ্য-ডান বিএনপি’র চেয়ে মধ্য-বাম আওয়ামী লীগই বেশি পছন্দ। এই পছন্দ রক্ষা করতে গিয়ে তারা অনেক সময়ই সাংবাদিকতার মূল আদর্শ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্যুত হন। তাদের এই বিচ্যুতি বা পক্ষপাতিত্বের প্রভাব অনেক ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায়। তাদের প্রভাবে প্রতিবেদক অনেক সময়ই অনেক সত্য প্রকাশ করতে পারেন না। একজন আওয়ামীপন্থী বা বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নিজের সমর্থিত দলের বিরুদ্ধে গিয়ে সাধারণত মিথ্যা বলবে না। কিন্তু বাধ্য হলে তারা তাদের অপছন্দনীয় দলের অনেক নেতিবাচক সত্যও তুলে ধরতে পারে না। ঠিক এই জায়গায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিএনপি, মানুষ পায় নেতিবাচক ধারনা। এই কারণে নেতিবাচক প্রচারণা বিএনপি’র চেয়ে আওয়ামী লীগকে অনেক কম পোহাতে হয়েছে এবং হচ্ছে।
গণমাধ্যম শিল্পে চাকুরী অনেক বড় বিষয়। চাকুরী গেলে, নতুন চাকুরী খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। তাদের চাকুরীর কোনো গ্যারান্টি নেই। কখন যাবে, কখন আসবে, সেটা বলা মুশকিল। চাকুরী পাওয়া আর চাকুরী যাওয়া – দুইটিই অধিকাংশ সময় নির্ভর করে ব্যাক্তিগত সম্পর্কের উপর। বাংলাদেশে নতুন সাংবাদিকরা একটি কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। সেটি হলো সাংবাদিকতায় উপরে উঠার সিড়িই হলো সিনয়র সাংবাদিক বা পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক পক্ষের সাথে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক। আবার কর্তাবাবুদের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে প্রাপ্ত চাকুরির স্থায়িত্ব। তাই বাধ্য হয়েই চুপচাপ অনুগত থেকে কাজ করে যেতে হয় এখানে। নিজের পেশাদারিত্ব ও সত্য প্রকাশের সুযোগ খুব কমই আসে। এদিকে সম্পাদক সাহেবরা সারা বছর খালেদা-হাসিনা’র একনায়কতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু নিজেদের মিডিয়া হাউজে তাদের একনায়কতন্ত্রের কথা ভুলে যান। এই নিয়ে কথা বলবে কে? সেখানে একাধিপত্য খুব বেশি চলে। একজন পরিচিত সাংবাদিক জানালেন, আমরা সারাদেশে বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে লিখি। কিন্তু আমাদের মধ্যেই তো সবচেয়ে বড় অনিয়ম চলে। সরকার সাংবাদিকদের জন্য একটি বেতন-স্কেল বানালো। কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্বেও সেই বেতন-স্কেল মানছে কয়টি মিডিয়া হাউজের কতৃপক্ষ? গুটিকয়েক মিডিয়া হাউজ ছাড়া কেউই সেই স্কেলে পর্যন্ত বেতন দেয় না। বরং অফিস থেকে বলে দেয়া হয় বেতন কত সেটা যাতে বাইরে বলা না হয়! চাকুরির নিরাপত্তাহীনতা, স্বল্প বেতন – এই বিষয়গুলোই অধিকাংশ সাংবাদিকদের বাধ্য করে অনৈতিক সুবিধা নিতে। তারা না হয় অনৈতিক খবর প্রকাশ করে বা হূমকি দিয়ে কিছু আদায় করে নিতে পারেন, কিন্তু যেই সংবাদকর্মী ডেস্কে বসে কাজ করছে, তার কী অবস্থা? এদের মধ্যে যদিও গুটিকয়েক আবার মফঃস্বল সাংবাদিকদের থেকে কিছু সুবিধা নিয়ে থাকেন।
বিনাশুল্কে নিউজপ্রিন্ট আমদানির লাইসেন্সের আওতায় আমদানিকৃত কাগজ বেশিরভাগ মালিকই বিক্রি করে দেন। সেটা নিয়ে কি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে কেউ? না। কারণ সবাই তো মাসতুতো ভাই, কেউ কারো বিরুদ্ধে পারতপক্ষে যান না। সর্বত্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু সাংবাদিকরা নিজেরাই যে নিজেদের গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের কাছে পরাধীন, এই কথা বলবে কে?
ধরুন উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, আমি কোনো বড় মিডিয়া হাউজের মালিক বনে যাই, আমাকে বা আমার কর্মকাণ্ডকে অপছন্দ করে, এমন সাংবাদিকরাও আমার বিরুদ্ধে আর লিখবে না এবং আমার প্রতি তাদের চাপা একটি মেকি সম্মানবোধ বেড়ে যাবে। কারণ যে কোনো সময়ই ঐ সাংবাদিকের আমার মিডিয়া হাউজেই চাকুরীর প্রয়োজন হয়ে পড়তে পারে। গণমাধ্যমে চাকুরীর ব্যাপারটি যে অত্যন্ত ভঙ্গুর জিনিস সেটা আগেই বলেছি। তাই যে কোনো সময়েই আমার হাউজে আসতে হতেই পারে তাদের। এ ভাবনা থেকে আমি যতই খারাপ ও সমাজে অপরাধী হিসেবে স্বীকৃত ব্যাক্তি হই না কেন, তারা আমার ব্যাপারে নিরব থেকে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করবে।
অনেক আগে একটি বিদেশী পত্রিকায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ‘কর্পোরেটীয়’ হয়ে যাওয়া নিয়ে লেখালিখি হয়েছিল। বাংলাদেশের বড় কর্পোরেট হাউজের ধর্ণাঢ্য মালিকরাই এখন অধিকাংশ গণমাধ্যমের মালিক বনে যাচ্ছেন রাতারাতি। আপনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধনীদের কাতারে আসলেই, আপনার গণমাধ্যম থাকাটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। এতে করে অনেক কর্পোরেট কোম্পানির অনিয়মের খবর বের হবে না। উন্নত বিশ্বে সংবাদপত্র মালিকদের প্রভাব কম থাকে, তবুও কিছুটা হলেও থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম খোলাই হচ্ছে নিজেদেরকে ভবিষ্যৎ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য বা নিজেদের অপকর্ম ও অবৈধ কার্যক্রমকে আড়াল করার ঢাল হিসেবে ব্যাবহারের জন্য। একটু খেয়াল করে দেখুন, প্রায় সিংহভাগ গণমাধ্যমের মালিক হচ্ছেন বিভিন্ন কর্পোরট হাউজের মালিক, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিমাণ কম নয়। আবার একজনের একটি গণমাধ্যম থাকার অর্থ হলো, অন্য গণমাধ্যমগুলোকেও একটি বার্তা দেয়া। তা হলো, আমার বিরুদ্ধে বেশি বাড় বেড়ো না বাপু, তোমার সকল কিচ্ছা আমিও ফাঁস করে দিতে পারি। ফলে নিজেদের মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি ও সমঝোতা হয়ে যায়, একজন আরেকজনকে ঘাঁটাবে না। মিডিয়াকে এই বিপদজনক কর্পোরেট-করণের ব্যাপারেও কেউ সোচ্চার নয়। সোচ্চার হওয়ার জায়গাটা কোথায়? যেটি সোচ্চার হওয়ার জায়গা, সেই গণমাধ্যমের মালিকেরাই তো চান না, তাদের বিরুদ্ধে কেউ সোচ্চার হোক। এই সমঝোতার নীতির কারণে সমাজের ও রাষ্ট্রের অনেক অপকর্ম ফাঁস হয় না। কারণ এসব ধর্নাঢ্য ব্যাক্তিরা সবসময় সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখে। ফলে তারা সরকারকেও ঘাঁটাতে চান না। অথচ এটি গণমাধ্যমের সংজ্ঞায় পড়ে না। তাদের এই নীতির প্রতিফলন ঘটে নিজেদের গণমাধ্যমের পলিসিতে। এর ফলে গণমাধ্যমে সরকারের অনেক অবৈধ কর্মকান্ড ফুটে উঠে না। এর মানে এই নয় যে, এসব গণমাধ্যম পরাধীন। বরং নিজেদের কর্পোরেট বাণিজ্য বাধাহীনভাবে প্রসারিত করার জন্যই তারা সত্যকে আড়াল করে সরকারের ওকালতি করে এবং সাংবাদিকদের সেভাবেই লিখতে বাধ্য করে। অথচ খেয়াল করে দেখুন কতো গালভরা শ্লোগান এদের। কারও ‘অসঙ্কোচ প্রকাশে দুরন্ত সাহস’, কারও ‘হাত বাঁধা থাকলেও চোখ খোলা’ থাকে, কেউ আবার ‘আংশিক নয় একেবারে পুরোপুরিই সত্য’, কারও আবার ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’। কিন্তু আদৌ কি তাদের শ্লোগানের মর্যাদা তারা রাখতে পারছে? নাকি এগুলো মেকি শ্লোগান? এর উত্তর আপনাদের জানাই আছে। অথচ এই গনমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাদের ভিত্তিই যদি এত দুর্বল হয়, তাহলে রাষ্ট্র তো দুর্বল হবেই, সরকার তো যা খুশী তা করবেই।
পিবিএ/হক