পিবিএ,যশোর: ঘর-সংসার ফেলে রাস্তায় রাস্তায় গাছ লাগিয়ে ও গাছ থেকে পেরেক তুলে বেড়ান যশোরের আবদুল ওয়াহেদ আলী সরদার। কাজটা তার পেশা নয় নেশা। গাছের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও রক্ষায় ব্রতচারীর মতো ঘুরে বেড়ান। গাছের গোড়ায় গিয়েতাদের বোবা কান্না শোনেন। তাদের এই কান্নার প্রতিকারে এখন বিল বোর্ডের পেরেকে ক্ষতবিক্ষত গাছের গভীরে ঢোকানো পেরেকগুলো দরদের সাথে তুলে গাছের কষ্ট নিবারণ করেন।
যশোর সদরের সাড়াপোল গ্রামে তার বাড়ি। তার বাড়িতে গেলে যে কেউ ভাববেন ভাংড়ি ব্যবসায়ী। উঠানে বড়সড় একটি লোহার ঢিবি। বোঝা যায় গ্রাম ঘুরে কুড়িয়ে এনেছেন। একদিন বেঁচে দেবেন ভাংড়ি আড়ৎদারের কাছে। কিন্তু না, তিনি ভাংড়ি ব্যবসায়ী নন। বিল বোর্ড টাঙানোর জন্য বেআইনিভাবে গাছে ঠোকা পেরেক তিনি তুলে ফেলেন। ওই ব্যতিক্রমী কাজ করতে গিয়ে এই লোহা তিনি পেয়েছেন। আর ওই পেরেক এক জায়গায় রাখায় বড় ঢিবির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ইতোমধ্যে ৬ মণ ১০ কেজি পেরেক তুলে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। সাড়ে ৮মাসে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গাছ থেকে তিনি এই পেরেক তোলেন।
ওয়াহেদ আলী সরদার পিবিএ’কে জানান, গত বছর ১৮ জুলাই যশোর টাউন হল মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের একটি মেহগনি গাছের পেরেক তোলার মধ্য দিয়ে তার এ অভিযান শুরু করেন। একটানা তোলেন গত ২০ মার্চ পর্যন্ত। ওই দিন পেরেক তোলেন চৌগাছা গরুহাটে। দীর্ঘ সাড়ে ৮ মাসে বিভিন্ন রাস্তার লক্ষাধিক গাছ থেকে পেরেক তোলেন। তিনি আবারো কাজ শুরু করবেন বলে পিবিএ’কে জানান। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই দীর্ঘ সময়ে তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। সুযোগের অভাবে বেশিরভাগ দিন গোসল হয়নি তার। তার ভাষায়, কাজ করতে করতে যেখানে রাত সেখানে কাত হয়েছেন, অর্থাৎ ঘুমিয়েছেন। এই ঘুমের জায়গা হলো পথের ধারের টি স্টলের বেঞ্চ অথবা স্কুল-কলেজের বারান্দা।
গাছে বিল বোর্ড টাঙানো বেআইনি। বিশেষ করে পেরেক ঠুকে বিল বোর্ড টাঙানো বড় অপরাধ। ওয়াহেদ আলী ক্ষোভ প্রকাশ কওে পিবিএ’কে বলেন, পেরেক তুলতে গিয়ে যাদের বিল বোর্ড সরানো হয়েছে তারা কিছু বলেনি, বলেছে অতি উৎসাহী পুলিশ। অথচ পুলিশ হলো আইন প্রযোগকারী সংস্থা।
‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২’ অনুযায়ী কোনো প্রকার প্রচার কাজে গাছ ব্যবহার করা যাবে না।কিন্তু রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংস্থা এ আইন পরোয়া করছে না। তারা প্রচার কাজে শুধু গাছ ব্যবহারই করছে না, নির্দয়ভাবে গাছে বড় বড় পেরেকও ঠুকছে।
আবদুল ওয়াহেদ সরদার দুঃখ, একদিক থেকে তিনি যে গাছের পেরেক তোলেন, অন্যদিকে সেই গাছে আবার পেরেক ঠুকে বিল বোর্ড টাঙানো হয়। বিষয়টির প্রতি বন বিভাগ ও প্রশাসনের কোনো নজর নেই। অথচ কাজটা কিন্তু তাদেরই। আইন বাস্তবায়নে তারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত।
আবদুল ওয়াহিদ সরদার পিবিএ’কে জানান, গাছের প্রতি প্রাণের টানে তিনি বাংলা ১৪১২ সাল থেকে গাছ লাগানো শুরু করেন। তিনি নিজের খরচে প্রায় ৯০ বিঘা জমিতে গাছ লাগিয়েছেন। তার রোপিত গাছের সংখ্যা সাড়ে ১৩ হাজার। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, জামরুল, কালোজাম, কাগজি লেবু, আমড়া, কামরাঙ্গা, জলপাই প্রভৃতি। নিজের জমি না থাকায় তিনি এই গাছ লাগান সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, পতিত জায়গা ও রাস্তার পাশে। যশোর কালেক্টরেটচত্বর, এসপি অফিস, পুলিশ লাইন্স এবং চৌগাছা, মণিরামপুর ও অভয়নগর থানাচত্বর, বাগআঁচড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, বেজপাড়া আনসার ও ভিডিপি ক্যাম্পচত্বর, স্টেডিয়ামপাড়া মিতালী সংঘসংলগ্ন এলাকা, ট্রাফিক অফিস, চেকপোস্ট, বিল হরিণার শ্মশানঘাট, সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের আটটি রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে তার রোপিত গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ওয়াহিদ সরদারের মহৎ কর্মের স্বীকৃতি ঘোষণা করছে। এ স্বীকৃতিকে অস্বীকার করতে পারেনি সরকারও। তাই তাকে প্রদান করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২১’। প্রধানমন্ত্রী তার গলায় পরিয়ে দেন ব্রোঞ্জ পদক। একইসাথে পান ২৫ হাজার টাকা।
পিবিএ/জেএইচ/এমএসএম