গ্রাম বাংলায় করোনার বিস্তার রোধে আমাদের দায়িত্ব !

মাহফুজার রহমান মন্ডল : ১৭ ই মার্চের পর হঠাৎ গ্রাম থেকে বোনের ফোন আসে; ফোন ধরতেই চেচিয়ে উঠে বলে তুই কি ঘুমিয়ে পড়ছিস বউ বাচাদের মেরে ফেলবি না কি? উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোকেই দিলো না; যা তা বকাবকি শুরু করলো। ফোনটা কেটে দিয়ে হতভম্ব অবস্থায় ভাবতে শুরু করলাম কিন্তু ভেবে লাভ কি ঢাকা থেকেতো গণপরিবহন একেবারেই চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ফোন ব্যাক করলাম আর বুঝিয়ে বললাম – কিভাবে যাবো সবকিছুতো বন্ধ কিছু দিন আগে বললে হয়তো যেতে পারতাম এই ব্যস্ত শহরে এতকিছু কি আর মনে থাকে পেটের যে জ্বালা, কি করে বুঝাবো? এবার বল দেখি কি করবো, কি করবি আর দেখছিস না বিদেশিরা এসে গেছে তাদের কি বাহার কেউ বিয়ে করছে, কেউ বিল্ডিং বানাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে আর ঢাকায় যারা চাকুরী করছে তারাও এসেছে। দলে দলে আড্ডা, গল্প , হাসাহাসি কতকিছু তোরা আসলে আমরাও না হয় কিছু করতাম। কি বলিস বুবু খবর দেখিস না দেশে কি হচ্ছে ? হ্যাঁ শুনেছি মরণ ব্যাধি করোনা ভাইরাস এসেছে তোমরা ঢাকায় থাকলে যদি কিছু হয়ে যায়। না না বুবু, স্বাস্থবিধি ও সামাজিক দুরুত্ব বজায় না রাখলে আমাদের আগে তোমরা আক্রান্ত হতে পারো। তাহলে আমাদের করণীয় কি? চিন্তা করিস না বুবু নিচের কিছুনিয়মগুলো মেনে চললে আল্লাহর রহমত আমরা সবাই ভালো থাকবো। তাহলে শুনো –

“আমাদের গণপরিবহন পরিহার করতে হবে। যারা জরুরি প্রয়োজনে গণপরিবহন ব্যবহার করবে তাদের অবশ্যই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেই গণপরিবহন ব্যবহার করবে। সবজায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সব ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাগম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ তা মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে অসুস্থ জ্বর সর্দি কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মসজিদে বা জনসংগমে না যাওয়াই ভালো।এছাড়া আমাদের কয়েকটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে যেমন – করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সহজ হবে যদি ঘনঘন সাবান-পানি দিয়ে হাত পরিস্কার করি, হাঁচি-কাশি দিতে হলে রুমাল বা টিস্যু পেপার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নিতে এবং যেখানে-সেখানে কফ-থুথু ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া কোলাকোলি ও করমর্দন থেকে বিরত থাকতে হবে।“

আমরা এতক্ষন ধরে যা পড়লাম আসলে তাই বাস্তব। যে ব্যাধির টিকা এখনো আবিষ্কার হয়নি বা আবিষ্কার হলেও ১৮ মাস পর ছাড়া প্রয়োগ করা যাবে না। তারচেয়ে ভালো হয় একটু নিয়মগুলো মেনে চলা। এরই ধারাবাহিকতায় আজ মেনে চলতে হবে কোয়ারেন্টাইন, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এবং লকডাউন। কারণ দেশে এখন জানুয়ারী’২০ থেকে বিদেশ ফিরত প্রায় ৬ লাখ লোক যারা কোভিড -১৯(করোনা ভাইরাস ডিজিজ-২০১৯) বহন করে আনতে পারে এবং কেউ কেউ এনেছেও বটে ফলে এপর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৬১, মৃত্যু ৬ ও সুস্থ হয়েছে ২৬ জন। তাহলে আমরা জেনে নেই কোয়ারেন্টাইন, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন কি?

কোয়ারেন্টাইন(১৪ দিন পর্যন্ত কাউকে কোনো নির্দিষ্ট রুমে রাখলে যদি তার ভেতরে জীবাণু থাকে তাহলে উপসর্গ দেখা দিবে আর উপসর্গ দেখা দিলে তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে), আইসোলেশন( যখন জীবাণুর উপস্থিতি ধরা পড়ে বা উপসর্গ থাকে তখন তাকে আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।), হোম কোয়ারেন্টাইন(কোন ব্যক্তি যখন বাড়িতেই কোয়ারেন্টাইনের সকল নিয়ম মেনে, বাইরের লোকজনের সাথে ওঠাবসা বন্ধ করে আলাদা থাকেন, তখন সেটিকে হোম কোয়ারেন্টাইন বলা হয়।), লকডাউন( কোন জরুরি পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষকে কোনো জায়গা থেকে বের হতে না দেয়া কিংবা ওই জায়গায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়াই হলো লকডাউন।)

এখন কথা হচ্ছে এই বিদেশ ফিরত বাঙালিরা কি এই নিয়ম মানছেন? না, মানছেন না? বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখা যায় বিদেশ ফেরতদের বিয়ে করা, বিল্ডিং করা, মিটিং করা, আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে তারা ব্যস্ত; তারা কি জানে না কতটুকু সচেতন থাকতে হবে? তাই সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন-এর ব্যবস্থা করেছেন যেহেতু কয়েক লাখ বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন তাই ওনাদের হোম কোয়ারেন্টাইন-এ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা যেন হোম কোয়ারেন্টাইন মানেন তার জন্য প্রশাসন কাজ করছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় খুব কম সংখক হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন বাকিগুলো কে কোথায় গেছেন তার কোন পাত্তা নেই তবে সরকার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের পাসপোর্ট বাতিলের জন্য এরপর ধীরে ধীরে তা কার্যকর হচ্ছে। এদিকে ঢাকা থেকে ঘর ফেরা মানুষগুলো মনে হয় ঈদের ছুটি পেয়েছে সঙ্গ পেয়ে অনেকটা মাতাল। যাইহোক সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনী জেলা প্রশাসনকে সহায়তায় নিয়োজিত রয়েছেন। দেশের ৬৪ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাদের স্ব স্ব জেলার প্রয়োজন অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনীর জেলা কমান্ডারকে রিকুইজিশন দিচ্ছে। ফলে জনগণকে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে দেশ তথা জাতি রক্ষা পাবে বলে আশাবাদী আমরা।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্যাখ্যা করেছে যে সংক্রামক রোগের আইন আছে, এই সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর আওতায় করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় না মানলে একজন ব্যক্তি এ আইনে অপরাধী বলে চিহ্নিত হতে পারেন। আইন অনুযায়ী, কোনো অস্থায়ী বাসস্থান বা আবাসিক হোটেল ও বোর্ডিংয়ে অবস্থানকারীদের কেউ এ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসককে জানাতে হবে। সরকারের নির্দেশে বিদেশফেরত প্রবাসী নাগরিকরা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন কি না তা নিশ্চিত করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু বেশিরভাগ প্রবাসীই তাদের পাসপোর্টে উল্লিখিত ঠিকানায় অবস্থান করছেন না। তবে ওনারা নিজ দায়িত্বে হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চললে জাতি সংক্রামক থেকে মুক্তি পাবে।

ইতিমধ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে যা আমাদের জাতির জন্য হুমকি স্বরূপ কিন্তু কি করিবে এই জীর্ণ শীর্ণ মানুষগুলো। পেটতো আর কথা মানে না তাই চাহিদার তাগিদে বাড়ির বাইরে দেখা যায়। তবে এদেরকে বেঁচে থাকা জন্য সরকার ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন সাথে আছে বেশকয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবিশেষ। এছাড়া অর্থ মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন – গৃহ-ভূমিহীনদের ঘর ও ৬ মাসের খাবার-টাকা দেওয়া হবে। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি- ভয় নেই, যতদিন প্রয়োজন ততদিন খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।

কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্টে তবে কিছু দিন আগে ইতালি ও ফ্রাঞ্চ -এ আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল। দিন যত যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তবে সামনে কোন দেশে সবচেয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে তা আল্লাহই ভালো জানেন। আমাদের দেশে যদিও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম তবে চার বছরের মধ্যে এই মৌসুমেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই বছরের মার্চে গত বছরের মার্চের তুলনায় এআরআইতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। কোভিড-১৯ পরীক্ষার কীট কম ছিল বলে বেশি পরীক্ষা করা যায়নি কিন্তু এখন কীট-এর সংখ্যা বেড়েছে তাই দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমরা আশাবাদী যে আক্রান্তের সংখ্যা যেন বেশি না হয়।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান(আইইডিসিআর) থেকে বলা হয়েছে জ্বর, সর্দি, কাশি মানেই কোভিড–১৯ নয়। তাই আতঙ্কিত না হয়ে আমরা সতর্ক হই। স্বাস্থবিধি ও সামাজিক দুরুত্ব মেনে চলি এটাই আমাদের কাম্য হোক।

লেখক : কবি – কলামিষ্ট

আরও পড়ুন...