গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে চুরি, জেল হাজতে ব্যাংক কর্মকর্তা

পিবিএ,জামালপুর: গ্রাহকদের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে টাকা চুরি করে অনলাইনে অন্য ৫টি হিসাবে স্থানান্তর করায় জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক জামালপুরের মেলান্দহ বাজার শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মাসুদুর রহমানকে। মাসুদুর রহমান বিভিন্ন সময় কয়েকটি হিসাব থেকে ৭৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা তোলে আত্মসাৎ করেন। সোমবার (২৫ নভেম্বর) রাতে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম তাকে মেলান্দহ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পর মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) তাকে জেলহাজতে পাঠিয়েছেন আদালত।

মেলান্দহ শাখা ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম পিবিএকে জানিয়েছেন, রোববার সকালে মেলান্দহ উপজেলার দুবাই ফেরত প্রবীণ ব্যক্তি মো. রফিকুল ইসলাম তার সঞ্চয়ী হিসাবে টাকার পরিমাণ জানতে চান। কোনো টাকা নেই, ব্যাংক থেকে এই তথ্য জানোনো হলে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী তার ২১ লাখ টাকা ছিল উল্লেখ করে ওইদিনই শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।

অভিযোগের প্রেক্ষিতে সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মাসুদুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন শাখা ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম। মাসুদুর রহমান এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর না দেওয়ায় ব্যাংকের স্টোর রুমে তাকে আটকে রেখে বিভিন্ন হিসাব খতিয়ে দেখা হয়। কয়েকটি হিসাবে গড়মিল ধরা পড়লে শাখা ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম কৃষি ব্যাংকের ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ে অবহিত করেন বিষয়টি। বিভাগীয় মহাব্যবস্থাপক মো. দিদারুল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে সোমবার বিকেলে চার সদস্যদের একটি টিম মেলান্দহে পৌঁছে গ্রাহকের টাকা চুরির ঘটনায় তদন্ত কাজ শুরু করেন। তদন্তে টাকা চুরির ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় ওই রাতেই তাকে মেলান্দহ থানায় সোপর্দ করা হয়।

ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে ২১ লাখ টাকা খোঁয়া যাওয়া গ্রাহক রফিকুল ইসলাম তাৎক্ষণিক প্রাথমিক তদন্ত টিমের কাছে অভিযোগ করে তার টাকাগুলো ফেরত চেয়েছেন। গ্রাহক রফিকুল ইসলাম পিবিএ’কে বলেন, ‘আমার হিসাবে ২১ লাখ টাকা জমা ছিল। এরপর আর টাকা জমা দেই নাই। টাকা তুলিও নাই। তাহলে আমার এতগুলো টাকা গেলো কোথায়। আমি আমার টাকা ফেরত চেয়ে আবেদন করেছি।’

এদিকে ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম টাকা চুরির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ওই দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে ব্যাংকের স্টোর রুমে আটক রাখলেও তাকে এ ঘটনা থেকে বাঁচাতে অপতৎপরতা শুরু করেন। ব্যাংকটির আরেক গ্রাহক মেলান্দহের স্থানীয় ঠিকাদার মো. রোকনুজ্জামান চৌধুরীকে রবিবার রাতে ব্যাংকে ডেকে নিয়ে তার কাছ থেকে ধার হিসেবে ১৮ লাখ টাকার একটি চেক লিখে নেন। চেকটি দেওয়া হয় দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানের নামে। কিন্তু ব্যবস্থাপক ওই টাকা সোমবার ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। ব্যবসায়ী রোকনুজ্জামান চৌধুরী সোমবার সকালে গ্রাহক রফিকুল ইসলামের হিসাবে ২১ লাখ টাকা না থাকাসহ বেশ কয়েকজন গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি জানতে পারেন। তখন রোকনুজ্জামান চৌধুরী বুঝতে পারেন যে তার কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকার চেক ধার হিসেবে নিয়ে অন্য গ্রাহকের টাকা আত্মসাতকারী মাসুদুর রহমানকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। রোকনুজ্জামান চৌধুরী সোমবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তিনি তার ১৮ লাখ টাকার চেকটি ফেরত পাননি। ধারণা করা হচ্ছে এই ১৮ লাখ টাকার চেকটি কোনো একজন গ্রাহকের হিসাবে জমা করা হয়েছে। যেহেতু চেকটি জমা করা হয়েছে সেহেতু শাখা ব্যবস্থাপক এই ধার করা টাকাও ফেরত দিতে পারছেন না।

গ্রাহক রোকনুজ্জামান চৌধুরী পিবিএ’কে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যবস্থাপক অন্য গ্রাহকের চুরি করা টাকার হিসাব মিলাবে তা আমি রবিবার রাতে বুঝতে পারিনি। আমার ১৮ লাখ টাকার চেকটি ফেরত চেয়েছি। চেক না দিতে পারলে নগদ টাকা নিয়েই আমি ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাবো।’

ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম পিবিএ’কে বলেন, ‘আমি কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি না। টাকা আত্মসাতকারী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানের তো শাস্তি হবেই। প্রাথমিকভাবে ১১ জন গ্রাহকের মোট ৭৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমান পাওয়া গেছে। এই টাকাগুলো জেলার দেওয়ানগঞ্জ ও ঢাকার ৫টি ব্যাংকের ৫টি একাউন্টে অনলাইনে স্থানান্তর করে আত্মসাত করা হয়। এজন্য তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা এবং তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। তবে গ্রাহক রোকনুজ্জামান চৌধুরীর কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা ধার নেওয়া বিষয়টি স্বীকার করেন।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ময়মনসিংহ বিভাগীয় মহাব্যবস্থাপক দিদারুল ইসলাম মজুমদার এ প্রসঙ্গে পিবিএ’কে বলেন, ‘কৃষি ব্যাংকের মেলান্দহ বাজার শাখার দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ব্যাংকের গ্রাহকদের হিসাব থেকে অন্তত টাকা উত্তোলন করে আত্মসাত করেছেন বলে ধারণা পাওয়া গেছে। তার কথা এখনই বিশ^াস করা যাচ্ছে না। টাকার পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। কতজন গ্রাহকের টাকা সরিয়ে কোথায় জমা রাখা হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। আপাতত ব্যাংকের পক্ষ থেকে মেলান্দহ থানায় একটি মামলা দায়ের করে দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ও অডিট টিম এই শাখায় এসে তদন্ত শুরু করবেন। তদন্ত শেষে জানা যাবে কতজন গ্রাহকের হিসাব থেকে মোট কত টাকা সরানো হয়েছে। এ ঘটনার সাথে যেই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের কোনো কর্মকর্তার অপকর্মের দায়ভার গ্রাহক বহন করতে যাবে কেন। তাই গ্রাহকদের টাকাগুলোও কিভাবে ফেরৎ দেওয়া যায় আমরা সেইদিকটাও মাথায় রেখে কাজ করছি।’

মেলান্দহ থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রেজাউল ইসলাম খান পিবিএ’কে বলেছেন, সোমবার রাতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক মেলান্দহ শাখার ব্যবস্থাপক ৭৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা চুরির একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি দুদক এর সিডিউলভুক্ত হওয়ায় জিডি হিসেবে গ্রহণ করেন আসামীকে আাদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। সেই সাথে অভিযোগটি নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের জন্য দুদক টাঙ্গাইল সমন্বতি জেলা কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।

পিবিএ/রাজন্য রুহানি/এমএসএম

আরও পড়ুন...