পিবিএ,ঢাকা: নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ এর আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান ওরফে গুনবী চলতি বছরের মে মাসের প্রথম দিকে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। তিনি কুমিল্লা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দুগর্ম এলাকায় আত্মগোপন করেন। জুনের শেষের দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পুনরায় স্থান পরিবর্তন করে বান্দরবানে অবস্থান নেন। সেখানে ২-৩ দিন অবস্থান করেন। এরপর কয়েকবার তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা করেন।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) রাতে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-৪ এর অভিযানে রাজধানীর শাহ আলী থানার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে গুনবীকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় উগ্রবাদী বই ও লিফলেট।
শুক্রবার (১৬ জুলাই) বিকেলে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার মাহমুদ হাসান ওরফে গুনবী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর মাদরাসায় ভর্তি হয়। ২০০৮ সালে সে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া থেকে তাইসির দাওরায়ে হাদিস শেষ করে। এরপর সে ঢাকাসহ কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিল। পাশাপাশি ধর্মীয় মতাদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সে ২০১০ সাল থেকে ওয়াজ শুরু করে। ২০১৪ সাল থেকে ধর্মীয় বক্তব্যে উগ্রবাদীত্ব প্রচারে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। এছাড়া সে ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গুনবী প্রথমে হুজির সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে জসিম উদ্দিন রহমানির সঙ্গে তার পরিচয় সূত্রে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ওই ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সে আনসার আল বাংলা টিমের (আনসার আল ইসলাম) সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। জসিম উদ্দিন রাহমানি গ্রেফতারের পর গুনবি উগ্রবাদীত্ব প্রচারক হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে।’
তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার জঙ্গি মাহমুদ হাসান গুনবী আনসার আল ইসলামের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মাদরাসায় খণ্ডকালীন, অতিথি বক্তা বা দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষকতা বা পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। ওই মাদরাসায় সম্পৃক্ত হয়ে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটিয়ে থাকে বলে জানা যায়। সে মাদরাসাগুলোতে উগ্রবাদী বক্তব্য প্রদান ও একইসঙ্গে উগ্রবাদী বইয়ের বিস্তারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহী করে তোলে। পরবর্তীতে সেই উগ্রবাদী বই সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষকদের উগ্রবাদী লেকচার প্রদানে উদ্বুদ্ধ ও উগ্রবাদী বই তৈরি, প্রকাশ, প্রণয়নে সহায়তা করে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাহমুদ হাসান গুনবী ওরফে হাসান একজন দর্শন পরিবর্তনকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে। সে আনসার আল ইসলামের (এবিটি) পক্ষে অন্যতম একজন দর্শন পরিবর্তনকারী। দর্শন পরিবর্তনের কৌশল সম্পর্কে গ্রেফতার গুনবি জানায়, বিভিন্ন কার্যক্রম গোপন আস্তানায় বিশেষ প্রশিক্ষণ মাধ্যমে দেয়া হয়। যেখানে প্রশিক্ষণার্থীরা আত্মীয়-স্বজন, পরিবার বন্ধু বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। প্রশিক্ষণার্থীদের বাইরের জীবন, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান ইত্যাদি থেকে দূরে রাখা হয়। এরপর তাদের মস্তিষ্কে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ভয়ভীতি তৈরি ও স্বাভাবিক জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জাগ্রত করা হয়ে থাকে। ফলে প্রশিক্ষণার্থীদের ভেতর আবেগ, অনুভূতি, বুদ্ধিমত্তা, পারিবারিক বন্ধন, বিচারিক জ্ঞান ইত্যাদি লোপ পায়। এভাবে কোমলমতিদের নৃশংস জঙ্গি হিসেবে গড়ে তোলা হয়।’
উল্লেখ্য, গত ৫ মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে রাজধানী থেকে গ্রেফতার জঙ্গি আল সাকিবের (২০) মতাদর্শ পরিবর্তন ও পরবর্তীতে তাকে আত্মঘাতী পন্থায় উদ্বুদ্ধকরণে গুনবির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, ‘গুনবী হাসান একজন আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা। সে নিজ পেশার আড়ালে জঙ্গিবাদ প্রচার করে থাকে। সে একাধিক ধর্মীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর তার ঘনিষ্টদের মধ্যে বেশ কয়েকজন জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতায় ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। তার মধ্যে সাইফুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, আনিছুর রহমান ও হাসান উল্লেখযোগ্য।’
তিনি বলেন, ‘সংগঠনের অভ্যন্তরে উগ্রবাদী মতাদর্শের প্রচারে সে “ছায়া সংগঠন” পরিচালনা করত। যাদেরকে “মানহাজী” সদস্য বলা হয়। সদস্যরা সংগঠনের ভেতরে জঙ্গি সদস্য তৈরি করত। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিত। সে “দাওয়াত ইসলাম” এর ব্যানারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্তির বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তারা বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিক অনুশোচনা জাগ্রত করার কৌশল অবলম্বন করে। এছাড়া সে মাহফিলের আড়ালে জঙ্গি সদস্য নিয়োগ দিত।’
তিনি বলেন, ‘গুনবী হাসান বাংলাদেশকে উগ্রবাদী রাষ্ট্র পরিণত করতে উগ্র মতাদর্শ প্রচার, পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠক করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সুযোগ সন্ধানের অপপ্রয়াস চালিয়েছে বলেও জানায়।’
এলিট ফোর্সের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায়। সে কুমিল্লা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে গমন করে এবং দুগর্ম এলাকায় আত্মগোপন করে। জুনের শেষের দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে সে পুনরায় স্থান পরিবর্তন করে বান্দরবানে অবস্থান নেয়। সেখানে ২-৩ দিন অবস্থান করে। পরবর্তীতে সে লক্ষ্মীপুরের চর গজারিয়া ও চর রমিজে ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করে বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত করে। আবারও সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা টের পেয়ে ওই স্থানও ত্যাগ করে। অতঃপর সে উত্তরবঙ্গে আত্মগোপনের ও প্রয়োজনে দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা করে।’
পিবিএ/জেডএইচ