বকশীগঞ্জ সীমান্তে ঘাটে ঘাটে বিট দিয়ে আসছে ভারতীয় গরু ও মাদক

গরু পাচারকারী সিন্ডিকেটের মূলহোতা রাজ্জাক। ছবি : পিবিএ

রাজন্য রুহানি,পিবিএ,জামালপুর: ঘাটে ঘাটে বিট দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসছে ভারতীয় চোরাই গরু ও মাদক। জামালপুরের বকশীগঞ্জ সীমান্তের দুটি স্পট দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঢুকছে ভারতীয় চোরাই গরু। গরুর সাথে রাখালেরা বহন করে নিয়ে আসছে ইয়াবা ও মদ। বিজিবি, পুলিশ, সাংবাদিক ও স্থানীয় নেতাদের বিট দিয়ে এই গরু চোরাচালান ও মাদক পাচার সিন্ডিকেট সচল রেখেছে বকশীগঞ্জের লাউচাপড়া ডুমুরতলার মজিবর রহমানের ছেলে রাজ্জাক। ওর ডান ও বামহাত বৈষ্ণবপাড়ার হাবিল উদ্দিনের ছেলে ফিরোজ ও তরমুজপাড়ার আব্দুস সামাদের ছেলে ইউসুফ। এই তিনজনের সক্রিয় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চলছে সীমান্তে অপ্রতিরোধ্য চোরাচালান, ভাগ-বাটোয়ারা ও বিক্রি।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, সীমান্তের ১০৮৮ নম্বর পিলারের নো ম্যানস ল্যাণ্ডের ভারতের অংশে কিছু জায়গাজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া চোখে পড়ে না। এখান দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঝর্নার ঝারা। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই অংশ দিয়েই ঢুকছে বেশিরভাগ গরু ও মাদক। এই এলাকায় ভারতের অংশের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার ঝারা প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। চোরাচালান সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে ধানুয়া কামালপুরের সোমনাথ পাড়ার এই ঝোরাটাই ব্যবহার করছে। ১০৯১ নম্বর পিলারের সীমান্ত দিয়েও আসছে চোরাই পণ্য। এছাড়া লাউচাপড়া এলাকায় আরও একটি ঝোরাও ব্যবহার করছে চোরাচালানের হোতা রাজ্জাকের কর্মীরা। রাত হলেই বকশীগঞ্জের সোমনাথপাড়া, বৈষ্ণবপাড়া, লাউচাপড়া, তরমুজপাড়াসহ সীমান্ত এলাকার লোকজন নেমে পড়ে এই চোরাচালান চক্রে। প্রায় প্রতি ঘরেই রয়েছে চোরাচালান সিন্ডিকেটের কর্মী।

বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, মাদকের চালান হাতে পাবার জন্য সাইকেল, মোটর সাইকেল নিয়ে স্থানে স্থানে অপেক্ষা করছে তরুণ ও যুবকেরা। ভটভটি ও পিকআপ দাঁড়িয়ে আছে গরুর চালান নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেবার জন্য।

গোপন সূত্র জানিয়েছে, ১১ ফেব্রুয়ারি ১০টি, ১৭ ফেব্রুয়ারি ৪৪টি, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২৭টি, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১০টি, ২৯ ফেব্রুয়ারি ৪৫টি গরু ও মহিষ এনেছে রাজ্জাক সিন্ডিকেটের কর্মীরা। এই গরু ও মহিষগুলো বিক্রি হয়েছে ইউসুফের বাড়ি থেকে। গরু আনার সময় রাখালেরা শরীরের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আনে ইয়াবা ও ভারতীয় মদ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশক’জন গরু পাচারকারী পিবিএ’কে জানায়, ১০৯১ পিলারের কাছে বৈষ্ণবপাড়ার সামাদের ছেলে রেজাউল ও আবুল মাথাপিছু ৫’শ টাকার বিনিময়ে ১৫ থেকে ২০ জনের দল মই দিয়ে সীমান্তের কাঁটাতার পাড় করে দেয় রাখালের ছদ্মবেশী গরু পাচারকারীদের। আগে থেকেই অপেক্ষমাণ ওপারের গারো বাড়িতে ভারতীয় গরু পাচারকারীরা সংগ্রহকৃত গরু বাংলাদেশের চোরাকারবারীদের হাতে তুলে দেয়। রাতের আঁধারে সোমনাথ পাড়ার ১০৮৮ পিলার ও বৈষ্ণবপাড়া এলাকায় ১০৯১ পিলারের কাছ দিয়ে গরু পাচারকারীরা সীমান্তের কাঁটাতার কাতানি দিয়ে কেটে কখনোবা চোঙ্গা দিয়ে গরু সীমান্তের এপারে পাচার হয়ে আসছে। পাচারকারীরা রুট ব্যবহার করে পাহাড়ের ঝোরা। ঝোরা দিয়ে এনে লাউচাপড়ার সীমান্ত সড়ক পার করে পাহাড়ি পথে পাচার হয়ে আসা গরু ল্উাচাপড়ার তরমুজপাড়ার ইউসুফের বাড়িতে নিয়ে আসে রাখালবেশী গরু পাচারকারীরা। এ পথে মহিষের চালানও আসে বলে জানিয়েছেন সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি মানুষজন।

ইউসুফের বাড়িতেই গরু ও মহিষ কেনাবেচা হয়। ভোরে গরু ও মহিষ কিনে বাড়ির পাশে রাস্তায় ব্রিজের কাছে অপেক্ষমাণ ভটভটি ও পিকআপে করে নিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকা হতে আগত বেপারীরা। গরু ও মহিষ বিক্রির ভুয়া দালাল দেয় ইউসুফ। কর্ণঝোরা বাজারের নামে এই ভুয়া চালান ব্যবহার করা হচ্ছে। ভটভটি, পিকআপ ও ট্রাক ভর্তি গরু লাউচাপড়া বাজার থেকে বাট্টাজোড়-বকশীগঞ্জ-জামালপুর-শেরপুর হয়ে দেশের নানাস্থানের হাটবাজারে যাচ্ছে।

গরুর সাথে পাচার হয়ে আসা ইয়াবা ও ভারতীয় মদের চালান চলে যায় মাদক ব্যবসায়ী গরু চোরাকারবারীর মদদদাতা মুক্তার হোসেনের ছেলে সম্রাটের কাছে। এই মাদক বাটোয়ারা ও বিক্রি করে রাজ্জাকের আরেক কর্মী মফিলের ছেলে ওয়াল। লাউচাপড়া বাজার এখন ইয়াবা, ভারতীয় মদ ও গাঁজা পাচারের ডাম্পিং স্টেশন। এসব মাদক নানা কৌশলে মাদক পাচারকারীদের হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।

স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার নূরল হক, ৯নং ওয়ার্ড যুবলীগের আহবায়ক জুয়েল, সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, ফজর আলী ও মুক্তার হোসেন নামে এই পঞ্চপান্ডবের ছত্রছায়ায় ভারতীয় গরু পাচারের গডফাদার রাজ্জাক ফ্রিস্টাইলে গরু চোরাচালান করে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই।

একাধিক সূত্র হতে জানা গেছে, সীমান্ত গলিয়ে গরু আসার পর সেই গরু নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয় রাখালেরা। প্রত্যেক রাখাল গরুপ্রতি পায় ২হাজার টাকা। এছাড়া গরু প্রতি বিজিবি ক্যাম্প পায় ৫শ, থানা ২শ, হাইওয়ে পুলিশ ২শ, ডিবি ২শ, স্থানীয় নেতাকর্মী ২শ ও সাংবাদিক ১শ টাকা। গরু চোরাকারবারী ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বকশীগঞ্জের ইত্তেফাকের সাংবাদিক শাহীন আল আমীন প্রতি গরু ১’শ টাকা নিয়ে সিন্ডিকেট করে পত্র-পত্রিকায় গরু চোরাচালানের সংবাদ প্রকাশ না হওয়ার জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সিন্ডিকেটের মধ্যে গরু পাচারের চাঁদা ভাগ-বাটোয়ারা করতেন তিনি নিজেই। সাংবাদিক শাহীন আল আমীন চাঁদাবাজি মামলায় বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছেন। তিনি জেলে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

গরু পাচারের অভিযোগ নিয়ে গরু পাচারকারী হোতা আব্দুর রাজ্জাকের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, পুলিশ, বিজিবি, সাংবাদিক ও নেতাদের টাকা দেই। সকলকে টাকা দিয়েই সীমান্তের ওপাড় থেকে গরু আনছি। তিনি দম্ভের সুরে আরও বলেন, আপনে প্রশ্ন করার কে? আপনারে কেন উত্তর দিমু? যারা গরু কারবারের সাথে জড়িত, তারা কিন্তু ভয়ংকর। আপনেরা এখানে নিউজ করতে আসছেন, ডরভয় লাগেনা? আমি চাইলে আপনেরা এখান থেকে ফিরে যেতে পারবেন বলে হুমকি-ধমকি দেয় সাংবাদিকদের।

বকশীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আব্দুর রহিম পিবিএ’কে জানিয়েছেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি। গরু পাচারের হোতা রাজ্জাকের নাম শুনেছি। পাচার হওয়া প্রতি গরু বাবদ বকশীগঞ্জ থানা ২’শ টাকা নেয় এমন অভিযোগ আমার জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে গরু পাচারের সাথে জড়িতদের আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কামালপুর সাতানিপাড়া বিজিবি’র বিওপির ক্যাম্প কমান্ডারের সাথে অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কোনো প্রকার কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

জামালপুরের পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন পিবিএ’কে বলেন, সীমান্তে গরু পাচারের বিষয়টি বিজিবির। সীমান্তে গরু ও মাদক পাচার হয়ে চোরাচালানকারীদের বকশীগঞ্জ-জামালপুরের সড়ক পথ ব্যবহার করতে দেয়া হবেনা। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশ সুপার আরও বলেন, গরু পাচারে বকশীগঞ্জ থানা, হাইওয়ে ও ডিবি পুলিশের নামে টাকা আদায় বিষয়ে আমার জানা নেই। চোরাকারবারী রাজ্জাক পুলিশের নামে টাকা আদায় করে থাকলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে এবং পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিজিবি ৩৫ ব্যাটালিয়ন জামালপুরের অধিনায়ক লে. কর্ণেল এসএম আজাদ পিবিএ’কে বলেন, সীমান্তে গরু পাচারের মেসেজ আমিও পেয়েছি। তবে পাচারকারীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি জানা নেই। এ ঘটনার সাথে বিজিবির কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং পাচার রোধে সীমান্তে টহল জোরদার করা হবে।

পিবিএ/রাজন্য রুহানি/এমএসএম

আরও পড়ুন...