সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা একজন রাস্তায় পড়ে আছেন। আশপাশে ২৫–৩০ জন যুবক। একজনের পরনে কমলা রঙের গেঞ্জি, কালো প্যান্ট, মাথায় ছাই রঙের হেলমেট। পড়ে থাকা ওই ব্যক্তিকে কিরিচ দিয়ে কোপাতে থাকেন এই হেলমেটধারী। অন্য আরও তিন-চারজন তাঁকে পেটাচ্ছেন। এটি পুলিশের সংগ্রহ করা একটি ভিডিওর চিত্র। এ ঘটনা গত মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলের।
চট্টগ্রাম আদালত ভবনের অদূরে কোতোয়ালি থানা-সংলগ্ন সেবক কলোনির একটি বাসার সামনের রাস্তায় এভাবে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করা হয় আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে। কিরিচ হাতে কোপাতে থাকা যুবকের নাম চন্দন দাস। পেশায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মিছিল শেষে ফেরার পথে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যান সাইফুল। তখন তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
পুলিশ বলেছে, শুধু চন্দন দাস নন, আইনজীবীকে খুনের ঘটনায় ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নেন। কোপানোয় অংশ নেন চারজন। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ ইতিমধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো চট্টগ্রামের আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত অভিযোগে গতকাল আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর হয়। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে বাধা দেন তাঁর অনুসারীরা। তাঁরা প্রিজন ভ্যান আটকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা করে ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
তখনই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এ সময় আইনজীবীদের গাড়ি ভাঙচুর, ইটপাটকেল নিক্ষেপের প্রতিবাদে মিছিল বের করেন কিছু আইনজীবী। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মিছিল শেষে ফেরার পথে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যান সাইফুল। তখন তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
আইনজীবী হত্যাকাণ্ডে ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ভিডিও ফুটেজ ও গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে জানা গেছে। এঁদের বেশির ভাগকেই পুলিশ শনাক্ত করেছে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের সংগ্রহ করা ৫২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আইনজীবী সাইফুলকে কোপান ওম দাশ, চন্দন ও রনব। তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকলেও লাঠিসোঁটা দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকেন অন্যরা। সেখানে আরও ছিলেন ২৫-৩০ জন। তাঁদের মধ্যে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে রমিত দাস, সুমিত দাস, গগন দাস, নয়ন দাস, বিশাল দাস, আমান দাস, মনু মেথর ও রাজীব ভট্টাচার্যকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একজন রয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।
মঙ্গলবার থেকে সেবক কলোনির বেশির ভাগ বাসিন্দা ঘরে নেই। গতকাল বিকেলে সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, ঘটনার সঙ্গে কয়েকজন জড়িত থাকলেও এখন সবাই বিপদে পড়েছেন। নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেই দাবি জানান তাঁরা।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ ছিল আদালতের কার্যক্রম। আগের দিনের মতো গতকালও চট্টগ্রামের ৭৪টি আদালতে কোনো শুনানি হয়নি। সকালে জেলা আইনজীবী সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। কালো ব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ জানান আইনজীবীরা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী মো. হাসান বলেন, হামলা-ভাঙচুরের প্রতিবাদে সাইফুলসহ কিছু আইনজীবী প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে বান্ডিল রোডে যান। ওই সময় সশস্ত্র লোকজন তাঁদের ধাওয়া দেন। হোঁচট খেয়ে পড়ে যান সাইফুল। অন্যরা দৌড়ে প্রাণে বেঁচে যান।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরী গতকাল বিকেলে নিজ কার্যালয়ে বলেন, আইনজীবী হত্যাকাণ্ডে ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ভিডিও ফুটেজ ও গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে জানা গেছে। এঁদের বেশির ভাগকেই পুলিশ শনাক্ত করেছে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
জড়িত আসামিদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় পাওয়া গেছে কি না এ বিষয়ে ওসি বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনো পাওয়া যায়নি।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা তিন মামলায় গতকাল আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। তাঁরা হলেন রাজীব, ববি চৌধুরী, আবদুল কাইয়ুম, কৌশিক চৌধুরী, আবির দে, রবিন দাশ ও জুয়েল দাশ। এ নিয়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৫।
আইনজীবী সাইফুল হত্যার ঘটনায় তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র : প্রথম আলো