পিবিএ,রাজারহাট (কুড়িগ্রাম): কুড়িগ্রামে এবার খাদ্য বিভাগের বিরুদ্ধে খাদ্য শস্য সংগ্রহের বস্তা ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নতুন বস্তার পরিবর্তে ছেড়া,ফাঁটা ও নিম্ন মানের প্রায় ৮লাখ বস্তা ঠিকাদার সরবরাহ করে জেলার বিভিন্ন খাদ্য গুদামে। দুর্নীতি ধামা চাপা দিতে নিম্ন মানের ২লাখ বস্তা রংপুর ও নীলফামারী জেলায় পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদাম সেগুলো গ্রহণ না করেই ফিরিয়ে দেয়। ফলে ফাঁস হয়ে পড়ে কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য বিভাগের বস্তা কেলেংকারী। তোলপাড় শুরু হয় খাদ্য বিভাগে। পুরাতন বস্তা গুদামজাত করতে কুড়িগ্রাম সদর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাসহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং অফিস খরচ বাবদ প্রতি বস্তায় ১৬ টাকা করে প্রায় এক কোটি ২৮লক্ষ টাকা উৎকোচ নেবার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট খাদ্য বিভাগ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এর আগে গত অর্থবছরে গম, ধান ও চাল ক্রয়ে কুড়িগ্রাম খাদ্য বিভাগের বিরুদ্ধে কেলেংকারীর দালিলিক অভিযোগ ওঠে। এবার নতুন করে বস্তা কেলেংকারীর খবর টক অব দ্যা ডিস্টিকে পরিনত হয়েছে।
রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় গত ৮ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি থেকে নীলফামারী সদর এলএসডিতে এক লাখ (৩০ কেজি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন) খালি বস্তার চলাচল সূচি জারি করে। ১৩ সেপ্টেম্বর নীলফামারী সদর খাদ্য গুদামে খালি বস্তার চারটি গাড়ি প্রবেশ করে। নীলফামারী খাদ্য বিভাগ পুরাতন ও ছেড়া-ফাঁটা বস্তা হওয়ায় তা ফেরত দেয়। নীফামারী সদর এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিখিত অভিযোগে জানান, কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি থেকে পাঠানো বস্তা গুলো ২০১৫-১৬ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের বিভিন্ন খাতে ব্যবহৃত বিলি-বিতরণের স্টেনসিল ব্যবহার করা। অধিকাংশই ছেঁড়াফাটা ও মেরামত করা বস্তা। পুরাতন অনেক বস্তা উল্টে ক্যালেন্ডার করে সরবরাহ করা হয়েছে। ব্যবহারের অনুপযোগী এক লাখ বস্তা কুড়িগ্রামে ফেরত পাঠায় এবং বিষয়টি লিখিত ভাবে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে মহাপরিচালককে অবগত করেন। একইভাবে কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি থেকে ২ ট্রাক বস্তা রংপুর শঠিবাড়ী এলএসডিতে পাঠানো হয়। সেখানকার গুদাম কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামান রাশেদ নিম্নমানের বস্তা গ্রহণ না করে কুড়িগ্রামে ফেরত পাঠায়। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী থেকে রংপুরের কাউনিয়া এলএসডিতে পাঠানো আরো ২ ট্রাক বস্তার ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ কুড়িগ্রাম খাদ্য বিভাগ থেকে পাঠানো ২লাখ বস্তা নীলফামারী ও রংপুর জেলা খাদ্য বিভাগ ব্যবহার অনুপযোগী আখ্যা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা খাদ্য বিভাগ টেন্ডারের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম জেলায় ৮লাখ বস্তা সরবরাহ করে। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা উৎকোচের বিনিময়ে ৫লাখ বস্তা গ্রহণ করে শত ভাগ ভাল হিসাবে সার্টিফিকেট দেন। তিনি বস্তা প্রতি ৬টাকা হিসাবে ৩০লাখ টাকা উৎকোচ নেন। একই ভাবে অন্যান্য গোডাউনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উৎকোচ গ্রহন করে নিম্নমানের বস্তা গ্রহন করেন। জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে দিতে হয়েছে ৭টাকা দর হিসাবে ৮লাখ বস্তায় ৫৬লাখ টাকা। টিসিএফ ও অন্যান্য অফিস খরচ বাবদ ৩টাকা হারে ২৪লাখ টাকা বিতরণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে কোন পক্ষই উৎকোচের এই এক কোটি ২৮ লাখ টাকার দায় স্বীকার করেননি। কোন সদোত্তরও দিতে পারেননি, তাহলে কেন কয়েক বছরের পুরাতন ছেড়া-ফাটা বস্তা নতুন বস্তা হিসাবে গ্রহন করে প্রত্যায়ন পত্র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হল। নতুন বস্তার টেন্ডারে দর ছিল ৬০/৮০ টাকা। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে পুরাতন বস্তা ১০/১৫ টাকা দরে কিনে নেয়। আর এসব বস্তা উল্টে স্টেনসিল ব্যবহার ও ক্যালেন্ডার করে চালিয়ে দেয়।
ফুলবাড়ি এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম সরবরাহকৃত বস্তা ছেড়া-ফাঁটা ও নিম্নমানের হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তার গ্রহনকৃত প্রায় এক লাখ নিম্ন মানের বস্তার বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ নজরে রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি কেন এবং কিসের বিনিময়ে ছেড়া ফাঁটা বস্তা গ্রহন করে ভাল নতুন বস্তার প্রত্যায়ন দিয়েছেন এমন প্রশ্নের কোন জবাব দেন নি।
নীলফামারী সদর খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ শাহেদুর রহমান বলেন, নিম্নমানের এক লাখ বস্তা কুড়িগ্রামে ফেরত পাঠানো হয়েছে। গ্রহণ না করার জন্য ৫টি কারণ উল্লেখ করে একটি লিখিত জবাব উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর দেয়া হয়েছে বলে জানান।
কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা এই বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। উল্টো প্রতিনিধিকে রেসট্রিকশন এলাকায় অনুমতি না নিয়ে পারমিশন কে দিয়েছে বলে প্রশ্ন ছোড়েন তিনি? এরপর কোন কথা না বলে তার ব্যক্তিগত ব্যবহৃত একটি সাদা ‘কারে’ করে এলএসডি গুদাম অফিস ত্যাগ করেন। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি সাংবাদিকদের ফোন রিসিভ করছিলেন না। এমনকি অফিসেও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। দিনভর অপেক্ষ করে তার দেখা মিললেও তিনি খাদ্য বিভাগের নিজের অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। বরং এব্যাপারে জেলা খাদ্য কর্মকর্তার সাথে কথা বলার পরামর্শদেন।
কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমার বিরুদ্ধে পঁচা চাল ক্রয়ের অভিযোগ উঠেছে। তথ্য মতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর তার স্বাক্ষরিত ১৯-২০ অর্থ বছরের আমন চালের ৬২৯ বস্তা (৩১দশমিক ২৫০ টন) চাল রৌমারী খাদ্য বিভাগে পাঠানো হয়। মেসার্স নাজমা আজিজ পরিবহনের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এসব বস্তায় পচাঁ দুর্গন্ধযুক্ত চাল সরবরাহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সেখানকার এক খাদ্য কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরো বলেন, ‘কানিজ ফাতেমা এসব চাল ডিলার কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে কিনে রৌমারী খাদ্য গুদামে পাঠিয়েছেন। এই চাল বিতরণ করতেগেলে আমারা সমস্যায় পড়বো।’
কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান পুরাতন ও ছেড়াফাঁটা বস্তা খাদ্য গুদামে সরবরাহের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। বলেন,এ বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গত ২সেপ্টেম্বর রিপোর্ট জমা দেবার কথা থাকলেও এখনো তা দেয়নি। তবে মৌখিক ভাবে তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন। লিখিত ভাবে তদন্ত রিপোর্ট পেলেই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অফিসিয়ালি অবগত করবেন বলে জানান। তবে তিনি দাবি করেন, অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া মাত্র ঢাকায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে টেলিফোনে জানিয়েছেন। ফলে বস্তা সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল আটকেগেছে। সরকারের সাথে চুক্তির শর্ত মোতাবেক ক্রুটিপূর্ণ বস্তা তুলেনিয়ে নতুন বস্তা সরবরাহ করতে বাধ্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। আর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হয়েছে ঢাকা হেড অফিসের। আমাদের কাজ সঠিক মালামাল বুঝে নেয়া। এছাড়া বস্তা বাণিজ্যে উৎকোচসহ অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন।# (ছবি সংযুক্ত)
পিবিএ/প্রহলাদ মন্ডল সৈকত/এসডি